মতামত

ইউপিডিএফ – জেএসএস সংস্কারবাদী সংঘাত : দায়ী কে?

0

এম চাকমা

গত কয়েকদিন আগে থেকে ইউপিডিএফ এবং জেএসএস-সংস্কারবাদী অংশের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য সংঘাতের রূপ নিয়েছে। এতে কেবলমাত্র উভয় পক্ষের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের পরিবারগুলো এলাকা থেকে বিতাড়নের শিকার হয়েছেন তাই নয়, এর ফলে জনগণের আন্দোলনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু কেন এই সংঘাত এবং এর জন্য আসলে দায়ী কে ? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে কিছু বিষয় স্পষ্ট করার জন্য আমাদের বেশ পেছন থেকে আলোচনা শুরু করতে হবে।

ক. পটভূমি

এক। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি জেএসএস দুই ভাগ হয়ে যায়। রূপায়ন দেওয়ান ও সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ট অংশ মূল জেএসএস থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে তারা দীঘিনালায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে জেএসএস (এম.এন.লারমা) নামে নতুন একটি দল গঠন করেন, যা সংস্কারবাদী নামে অধিক পরিচিত।

দুই। দেশে বিগত জরুরী অবস্থার সময় ২০০৭ সালে সংস্কারবাদী দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক তাতিন্দ্র লাল চাকমা গ্রেফতার হন। তবে ৬/৭ মাস কারাগারে আটক রাখার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কথিত আছে কিছু শর্তের বিনিময়ে আর্মিরা তাকে ছেড়ে দেয়।

তিন। পেলে বন্দী থাকার সময় ২০০৭ সালের ১২ জুলাই সংস্কারবাদীদের সাথে ইউপিডিএফের একটি লিখিত সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। এতে একে অপরের উপর হামলা না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কোন দল কোন এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়। এই সমঝোতার পর খাগড়াছড়িতে সংঘাত বন্ধ হয় এবং শান্তি ফিরে আসে। সাধারণ জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সক্ষম হয়।

চার। কিন্তু তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলে ছাড়া পাওয়ার পর ধীরে ধীরে দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। তিনি তার দল ও ইউপিডিএফের মধ্যে স্বাক্ষরিত উপরোক্ত সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ‘দাগ দে-দি হি রাজনীতি’ (সামীনা দিয়ে রাজনীতি হয় না) বলে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও সংঘাত-মুখী তত্ত্ব হাজির করেন। তিনি ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে সংস্কারবাদী কর্মীদের ক্ষেপিয়ে তোলেন, তাদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিজের পক্ষে ভিড়িয়ে নেন এবং এভাবে তাদের দলে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। অবশ্য তার সাথেও ২০১১ সালের ১৪-১৫ মে অনুষ্ঠিত আলোচনা শেষে ইউপিডিএফের একটি লিখিত সমঝোতা হয়। এই সমঝোতায়ও অনেকটা পূর্বের সমঝোতার শর্তগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তিনি তার “দাগ” তত্ত্ব থেকে সরে আসতে ব্যর্থ হন এবং পূর্বের মতো আচরণ করতে থাকেন।

পাঁচ। এরপর সংস্কারবাদীরা ইউপিডিএফের সাথে স্বাক্ষরিত সমঝোতা একের পর এক লংঘন করতে থাকে। ‘দাগ’ ক্রস করে তারা ইউপিডিএফের জন্য নির্ধারিত (সমঝোতা মোতাবেক) এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন তৎপরতা চালাতে শুরু করে। যেমন ২০১২ সালে খাগড়াছড়ির শিবমন্দির এলাকায় গিয়ে তারা একটি চালের গাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি মাটিরাঙ্গায় একটি ব্রিফ ফিল্ডে চাঁদা না পেয়ে এক বাঙালি শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে। এসব ঘটনায় ইউপিডিএফ ও সাধারণ জনগণ চরম বেকায়দায় পড়ে। এ ধরনের আরো বহু ঘটনা রয়েছে, যা এখানে বিস্তারিত তুলে ধরা সম্ভব নয়। শুধু উদাহরণ হিসেবে এখানে এই দুটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো। তবে ইউপিডিএফ সমঝোতা-ঐক্য এবং জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সংস্কারবাদীদের এসব অপকর্ম হজম করতে বাধ্য হয়।

ছয়। সংস্কারবাদীরা শুধু ‘দাগ’ ক্রস করে ইউপিডিএফ-এর নিয়ন্ত্রিত ও সমঝোতা মোতাবেক নির্ধারিত সাংগঠনিক এলাকায় গিয়ে তাদের কার্যক্রম বিস্তার করেছে তাই নয়, তারা দীঘিনালা, মহালছড়ি, বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ি সদর সহ বিভিন্ন এলাকায় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউপিডিএফ ভুক্ত গণ সংগঠনের নেতা কর্মীদের উপর একের পর এক হামলা চালাতে থাকে।

সাত। এছাড়া তারা প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী ও আন্দোলন বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ সাজেকে সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল ও সেটলারদের বসতিস্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের অংশ হিসেবে জনগণ ইউপিডিএফের নেতৃত্বে বাঘাইহাট বাজার বয়কট করলে সংস্কারবাদীরা তার বিরোধীতা করে। সংস্কারবাদী নেতা সুদর্শন চাকমা বাঘাইহাট জোনের সাথে হাত মিলিয়ে বাজার খুলে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালায়। তবে জনগণ তার অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়। দীঘিনালায় বিজিবি কর্তৃক ২১ পরিবার উচ্ছেদের শিকার হলে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন সংঘটিত হয়। সংস্কারবাদীরা এই আন্দোলনে অংশ না নিয়ে বরং তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচারণা ও বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং আর্মিদের পক্ষ হয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে দীঘিনালা জোনের সেনারা নতুন করে সাধনাটিলা বনবিহারের জমি দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সংস্কারবাদীরা আর্মিদের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়ে ভান্তেকে প্রস্তাব দেয় তিনি যেন বিহারের জমির কিছু অংশ হলেও টাকার বিনিময়ে সেটলারদের কাছে বিক্রি করে দেন। সংস্কারবাদীদের এ ধরনের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী অপতৎপরতা জনগণের কাছে নিন্দিত হয়।

আট। সংস্কারবাদীদের সমঝোতা পরিপন্থী কার্যকলাপের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের সাথে ইউপিডিএফের দফায় দফায় বৈঠক হয়। বৈঠকে তারা ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না বলে বার বার অঙ্গীকার করে। কিন্তু বৈঠক থেকে উঠে যাওয়ার পরপরই পুনরায় তারা একই অপকর্ম শুরু করে। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ১৫-১৯ অক্টোবর দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কারবাদীদের সাথে ইউপিডিএফের তৃতীয়বারের মতো লিখিত সমঝোতা বা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে পূর্বের সমঝোতার শর্ত পালন করা, উভয় পার্টি থেকে বিচ্যুত বা ঝরে পড়া সদস্যদের কোন পক্ষের দলে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং উভয় পক্ষ মিলে দলত্যাগী ও উপদলীয় চক্রান্তে লিপ্ত বর্মা গংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এমনকি বিগত ইউপি নির্বাচনেও পারষ্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে যৌথ প্রার্থী দিয়ে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সংস্কারবাদীরা তৃতীয় বারের এই সমঝোতারও কোন শর্ত পালন করেনি। ইউপিডিএফের আহ্বান সত্ত্বেও তারা ইউপি নির্বাচনে যৌথ প্রার্থী দিতে সম্মত হয়নি। ইউপিডিএফ থেকে বিচ্যুতদের তারা সাদরে গ্রহণ করে তাদের দলে ভিড়িয়ে নেয়, এমনকি অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে এবং বর্মা গংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা বরং তাদেরকে উপদলীয় চক্রান্ত চালাতে আরো বেশী সহযোগিতা বাড়িয়ে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত আর্মিদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে দিয়ে নব্য মুখোশ বাহিনী গঠন করে দেয়। এখনো পর্যন্ত সংস্কারবাদীরা সন্ত্রাসী নব্য মুখোশ বাহিনীকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি অপহৃত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে জিম্মি করে রাখতে তারা মুখোশদের সহায়তা করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। এক কথায় সংস্কারবাদীদের সাহায্য সহযোগীতা ছাড়া বর্মারা কখনোই এধরনের চরম জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ড চালাতে সক্ষম হতো না।

নয়। সংস্কারবাদীদের বার বার সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন ও ‘দাগ’ ক্রস করে ইউপিডিএফ এলাকায় উস্কানিমূলক তৎপরতা অব্যাহত রাখার প্রেক্ষাপটে ইউপিডিএফ নেতৃত্ত্ব উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত সংস্কারবাদীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদের এলাকায় কিছু কিছু সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দেখা যায়, সংস্কারবাদীরা নিজেরা ইউপিডিএফ-এর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কার্যক্রম চালানোর জন্য ‘দাগ তত্ত্ব’ হাজির করলেও, তাদের এলাকায় ইউপিডিএফের সাংগঠনিক কার্যক্রম মেনে নিতে পারেনি। তারা নানাভাবে ইউপিডিএফের কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করে এবং নিজেরা না পারলে আর্মিদের দিয়ে ইউপিডিএফের উপর হামলা করে, ধরিয়ে দেয় অথবা নানাভাবে ক্ষতি সাধন করে।

খ. সংঘাতের অনিবার্যতা
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কারা চলমান ইউপিডিএফ-সংস্কারবাদী সংঘাতের জন্য দায়ি। মূলত: ছয়টি কারণে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। প্রথমত, সংস্কারবাদীদের এবং বিশেষত পেলে-সুদর্শন-শক্তিমান-অংশুমান এই চার কুচক্রীর ‘দাগ দে-দি হি রাজনীতি’র ভুল তত্ত্ব। তাদের এই তত্ত্ব সমঝোতাকে অস্বীকার করে এবং নতুন সংঘাতের বীজ বপন করে। দ্বিতীয়ত, সংস্কারবাদী গ্রুপে উক্ত চার কুচক্রীর প্রাধান্য লাভ এবং মডারেট বা প্রগ্রেসিভ অংশের কোনঠাসা হয়ে পড়া। তাদের প্রাধান্য লাভের কারণে ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারবাদীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়। তৃতীয়ত, সেনাবাহিনীর সাথে চার কুচক্রীর আঁতাত এবং আন্দোলনে অন্তরায় সৃষ্টি। যেখানে ইউপিডিএফ জনগণের বিভিন্ন ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে আন্দোলনে নিয়োজিত সেখানে সংস্কারবাদীরা তার বিপক্ষে অবস্থান নিলে সংঘাতের ক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়। চতুর্থত; সেনাবাহিনীর সাথে ষড়যন্ত্র করে বর্মাদের দিয়ে চার কুচক্রীর নব্য মুখোশ বাহিনী গঠন এবং তাদেরকে ইউপিডিএফ ও জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া। পঞ্চমত, সংঘাতে সেনাবাহিনীর ইন্ধন ও উস্কানি, যা সংস্কারবাদী চার কুচক্রীর সাথে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়মিত গোপন বৈঠক এবং মহালছড়িতে সংঘাতের শিকার পরিবারগুলোর কাছে সেনাবাহিনীর ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে স্পষ্ট। ষষ্ঠত, সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ। এই ক্ষোভের কারণ হলো সাধারণ জনগণ দেখতে পান যে, সংস্কারবাদীরা তাদের স্বার্থে আন্দোলনের কথা বলে কাড়ি কাড়ি টাকা উত্তোলন করলেও সেই টাকা দিয়ে নিজেরা আখের গোছাতো ব্যস্ত। তারা দেখতে পান সংস্কারবাদীরা আন্দোলন না করে জনগণের টাকায় সুরম্য অট্টালিকা, ট্যুরিষ্ট রিসোর্ট বানাচ্ছে এবং কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। জনগণের প্রশ্ন, পেলে যে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে সেগুলো সে কোথায় পেয়েছে? সুদর্শন রুইলুই মোনে (পাহাড়ে) কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে যে ট্যুরিষ্ট রিসোর্ট বানিয়েছে সে কি তার বাপ দাদার টাকায়? সংস্কারবাদীদের এইসব কান্ড দেখে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুদ্ধ হয়। মোট কথা, ইউপিডিএফ এবং সংস্কারবাদীদের মধ্যে চলমান সংঘাতের জন্য প্রধানত সংস্কারবাদীদের পেলে-শক্তিমান-সুদর্শন-অংশুমান এই চার কুচক্রীই দায়ি। এ ব্যাপারে সাধারণ জনগণের মনে কোন সন্দেহ নেই।

. সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এবং ইউপিডিএফ-এর সহনশীলতা
সংস্কারবাদীদের বার বার সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন ও চরম উস্কানিমূলক অপতৎপরতার পরও ইউপিডিএফ গত ১০-১১ বছর ধরে সীমাহীন ধের্য্য, সংযম ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এবং জনগণের আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে তারা এই সহনশীল মনোভাব প্রদর্শন করেছে, যাকে সংস্কারবাদীরা ইউপিডিএফের দুর্বলতা বলে মনে করে থাকতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ইউপিডিএফের ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙে দেয় বলে প্রতীয়মান হয়। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গত বছর নভেম্বর থেকে নব্য মুখোশ বাহিনী নান্যাচরে সংস্কারবাদী ও আর্মিদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পর পর দুই ইউপিডিএফ সদস্য ও সমর্থককে খুন করলেও ইউপিডিএফ সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এ বছর ৩ জানুয়ারী খাগড়াছড়ি শহরে সংস্কারবাদীরা মুখোশদের সাথে মিলে ইউপিডিএফ সংগঠক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর মিঠুন চাকমাকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে। এর কয়েকদিন পর তারা খাগড়াছড়ির কৃষি গবেষণায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ইউপিডিএফ এর এক কর্মীকে গুরুতর আহত করে। দিঘীনালায় আর্মিদের সহায়তায় সশস্ত্র হামলায় এক ইউপিডিএফ সদস্যকে খুন এবং অন্য ৩ জনকে আহত করে। হরিনাথ পাড়ায় গুলি করে এক ইউপিডিএফ সদস্যকে খুন করে। বাঘাইছড়িতে infiltrated এজেন্ট দিয়ে এক ইউপিডিএফ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করে। এভাবে সংস্কারবাদীরা একের পর এক ইউপিডিএফ সদস্যকে খুন ও জখম করার পরও ইউপিডিএফ পাল্টা কোন ব্যবস্থা নেয়নি, বরং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সর্বশেষ যে ঘটনার পর বর্তমান সংঘাতের শুরু তার উৎপত্তি এভাবে: ৯ এপ্রিল সংস্কারবাদীরা ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রিত এলাকা নানিয়াচরের ১৮ মাইলে গিয়ে উস্কানিমূলক ভাবে চাঁদা উত্তোলন শুরু করে। ইউপিডিএফ সদস্যরা এতে বাধা দেয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে ১১ এপ্রিল অর্থাৎ বৈসাবি উৎসবের একদিন আগে সংস্কারবাদীরা ঐ এলাকায় গিয়ে ইউপিডিএফ সদস্যদের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে জনি তঞ্চঙ্গ্যা ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। এই ঘটনার পর ইউপিডিএফ সমর্থকরা সর্বত্র প্রতিরোধ শুরু করে দেয়। এই প্রতিরোধ এখন প্রতিদিন বিস্তৃত হচ্ছে এবং এর ফলে তারা সর্বত্র কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। আর্মিদের সহযোগিতা ছাড়া আর তাদের পক্ষে নড়াচড়া করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

. সংঘাত নিরসন সম্ভব কিভাবে?
বর্তমান পরিস্থিতি হলো – একদিকে ইউপিডিএফ ও সর্বস্তরের আপমর জনগণ এবং অন্যদিকে সেনা-আশ্রিত সংস্কারবাদীরা। সংস্কারবাদীরা এখন কোনঠাসা হয়ে সেনাবাহিনীর উপর ভর করে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে খুন করে জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে টিকে থাকতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এতে তাদের শেষ রক্ষা হবে না। খুনের পর খুন করে নিরীহ মানুষজনের উপর উৎপীড়ন করে তারা জনগণের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত তাদের একদিন ধরতেই হবে। এর কোন ব্যতিক্রম ঘটবে না। ভালো কর্মের সুফল এবং কুকর্মের কুফল। এই কুফল তাদের ভোগ করতেই হবে, যেভাবে একাত্তরের রাজাকারদের তাদের অতীত কর্মের ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে।

সংস্কারবাদীরা যে খুন ও অপহরণের যজ্ঞে মেতে উঠেছে তা তাদের চরম হতাশারই বহিঃপ্রকাশ। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের খুবই সীমিত এলাকায় তারা তাদের এসব অপতৎপরতা সীমিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। অপরদিকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীলতা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব, আদর্শিক দৈন্যতা ও জনবিচ্ছিন্নতারই জ্বলন্ত প্রমাণ এবং এটা তাদের শক্তি নয়, বরং তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, যে দুর্বলতা নিয়ে কোন সংগ্রামে বা যুদ্ধে কখনো জয়লাভ করা যায় না। অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বহু দেশে জনবিচ্ছিন্ন বহু অপশক্তি ত্রাস সৃষ্টি করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু শেষ বেলায় তারা জনগণের সংগঠিত শক্তির উত্থানে খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে। কারণ দেখা গেছে জনগণকে সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখা যায় না, তারা কোন না কোন সময় প্রবল তেজে জেগে ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও বার বার জেগে উঠেছেন এবং আবার জেগে উঠবেন। আর তখন সেনা-আশ্রিত সংস্কারবাদী কুচক্রীরা পালানোর পথ পাবে না।

সবাই চায় চলমান সংঘাত বন্ধ হোক। তবে যে কারণে সংঘাতের সূচনা সে কারণগুলো দূর করা না হলে সংঘাত বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অর্থাৎ সংস্কারবাদীরা এবং বিশেষত চার কুচক্রীরা যদি তাদের ‘দাগ দে-দি হি রাজনীতি’র ভ্রান্ত তত্ত্ব বাদ না দেয়, সমঝোতার শর্ত পালন না করে, সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন না করে এবং নব্য মুখোশ বাহিনীকে ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে মদদ-দান বন্ধ না করে, তাহলে কীভাবে সংঘাত বন্ধ হবে? তাই সংঘাত বন্ধ করতে হলে সবার উচিত পেলে-শক্তিমান-সুদর্শন-অংশুমান চক্রের ভ্রান্ত নীতির বিরোধীতা করা। এ ক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে জেএসএস সংস্কারবাদীদের প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক অংশকে। এটাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনগণের প্রত্যাশা। (সমাপ্ত)
———————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More