মানবাধিকার সংগঠনগুলো নীরব কেন?

0

মন্তব্য প্রতিবেদন
এ প্রশ্ন আজ কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের নয়, সারা দেশবাসীর। মিঠুন চাকমা খুন হন ৩ জানুয়ারী, অথচ আজ পর্যন্ত দেশের কোন মানবাধিকার সংগঠন এ জঘন্য হত্যার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মানবাধিকার নিয়ে যত সরব, নিজ দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার নিয়ে ততটাই নীরব। গুম, অপহরণ, ক্রসফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ – ইত্যাদি বিষয়ে এ সংগঠনকে কথা বলতে দেখা যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তো সংগঠনটি ন্যাক্কারজনভাবে উদাসীন। পিসিপি নেতা রমেল চাকমাকে যখন গ্রেফতার করে নানিয়াচর জোনে নির্যাতন করা হয়, তখন তার পরিবারের পক্ষ থেকে কমিশনের হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু কমিশন কোন প্রকার পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ কমিশন সময় মত হস্তক্ষেপ করলে রমেল চাকমাকে হয়তো বাঁচানো যেত। অপরদিকে বেসরকারী মানবাধিকার সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, অধিকার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় না, যদিও সমতলে সাম্প্রতিক গুমের ঘটনাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তারা বেশ সোচ্চার।

সঙ্গত কারণে পার্বত্যবাসীর মনে প্রশ্ন জাগে, মিঠুন চাকমা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সংগঠক বলেই কী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এ মৌনতার চর্চা? যদি তাই হয়, তাহলে এই সংগঠনগুলোর নিজেদের মানবাধিকার সংগঠন বলে দাবি করার কোন অধিকার থাকতে পারে না। কারণ মানবাধিকার কোন বিশেষ গোষ্ঠীর, বিশেষ দলের কিংবা বিশেষ মতবাদে বিশ্বাসী মানুষের জন্য হতে পারে না। মানবাধিকার সবার অধিকার। এমনকি শত খুনের অপরাধীকেও রাষ্ট্র তার ন্যায্য পাওনা বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।

সরকারের বিবেচনায় ও অগ্রাধিকারের তালিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুগুলো হলো প্রান্তিক অবস্থানে। একটি গণবিরোধী সরকারের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী আশা করা যায় না। কিন্তু সরকারের বাইরে মানবাধিকার সংস্থা, প্রগতিশীল দল ও সংগঠনগুলোও যখন সরকারের এই ভাবাদর্শে প্রভাবিত হয় তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না।

# নব্য মুখোশ বাহিনীর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত মিঠুন চাকমা

মিঠুন চাকমা হত্যার বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নীরব থাকার আরও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, তারা হয়তো মনে করছে এই হত্যাকা- পাহাড়ি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল। বাইরে থেকে এমন মনে হলেও বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। মূলতঃ গত বছর ১৫ নভেম্বর নব্য মুখোশ বাহিনী নামে জনগণের কাছে পরিচিত একটি সংগঠনের আবির্ভাব হওয়ার পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। এই সংগঠনটি নিজেদের যে নামেই অভিহিত করুক, তারা হলো সেনাবাহিনীরই সৃষ্টি। তারা সেনাবাহিনীর আশ্রয় প্রশ্্রয়ে ও মদদে জঘন্য হত্যাকা-সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে। মোট কথা মিঠুন চাকমার হত্যাসহ আমরা যা দেখেছি তা হলো রাষ্ট্র বা আরো সরল কথায় সেনাবাহিনী-পৃষ্ঠপোষিত সন্ত্রাস (state-sponsored violence).  সেনাবাহিনী নিজেদের আড়াল করতেই “ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক” নামটি ব্যবহার করেছে। আর এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে কেউ কেউ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, সেনাবাহিনী অতীতে এ ধরনের অনেক খুনী সংগঠনের জন্ম দিয়েছিল- যেমন লক্ষীছড়িতে বোরকা পার্টি, যার সেনা-নাম ছিল CHTNF ev Chittagong Hill Tracts National Front. এই সংগঠনটিও এক সময় লক্ষীছড়িতে সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে থেকে তুমুল সন্ত্রাস চালিয়েছিল। তাদের হাতেই খুন হয়েছিলেন ইউপিডিএফ নেতা রুইখই মারমাসহ আরো অনেকে। তবে জনগণের প্রবল প্রতিরোধের ফলে এই সংগঠনটি বর্তমানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

বোরকা পার্টি গঠনের বহু আগে ৯০ দশকের মধ্যভাগে (১৯৯৫) পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে সংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনী খাগড়াছড়িতে মুখোশ বাহিনী গঠন করেছিল। সেনাবাহিনীর দেয়া এই বাহিনীর নাম ছিল ‘পিসিপি-পিজিপির সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি’ বা ‘পিপিএসপিসি’।

পাহাড়ি সমাজের অধঃপতিত বখাটেরা ছিল এই মুখোশ বাহিনীর সদস্য। গণ প্রতিরোধের মুখে কয়েক মাসের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এরা খাগড়াছড়িতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকায় মুখোশ নেতাদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। উপরোক্ত দুই সংগঠন ছাড়াও শান্তিবাহিনীর আন্দোলন পর্বে সেনাবাহিনী টাইগার বাহিনী, লায়ন বাহিনী, গপ্রক বাহিনী ইত্যআদি নামে ঠ্যাঙারে বাহিনী গঠন করেছিল।

বর্তমানে নব্য মুখোশ বাহিনী হলো সেনাবাহিনীর অতীতের এসব সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নতুন ও উন্নত সংস্করণ ছাড়া কিছুই নয়। এদের ভূমিকা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার আলবদরদের মতো। রাজাকাররা যেমন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৃষ্টি, নব্য মুখোশ বাহিনীও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৃষ্টি। রাজাকাররা যেমন সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে ও সহায়তায় এ দেশের বুদ্ধিজীবী তথা শ্রেষ্ট সন্তানদের হত্যা করেছিল, নব্য মুখোশ বাহিনীও বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাই করছে। রাজাকারদের দ্বারা খুনের ঘটনাকে কেউ বাঙালিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল বলে অভিহিত করে না, করার ধৃষ্টতাও কেউ দেখাতে পারে না। তবে কেন নব্য মুখোশ বাহিনীর দ্বারা সংগঠিত খুন ও অন্যান্য অপরাধকে পাহাড়িদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল বলা হবে ? যারা মিঠুন চাকমা হত্যাকা-কে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল বলে প্রচার করতে চায় তারা সচেতনভাবে হোক অবচেতনভাবে হোক মূল অপরাধীদের আড়াল করতে ভূমিকা রাখছে।

তবে একটি কথা, বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো নব্য মুখোশ বাহিনীকে চিনতে না পারলেও রাজাকার পন্থী পত্রিকা নয়া দিগন্ত নব্য চিনতে মোটেই ভুল করেনি। আর তাই এই পত্রিকাটি নব্য মুখোশ বাহিনীর বক্তব্য পরম যতেœ ও গুরুত্ব সহকারে ফেরী করে বেড়াচ্ছে। আমরা আশা করি স্বাধীনতাপন্থী প্রগতিশীল পত্রিকাগুলো নয়া দিগন্তের মতো নীচে নামবে না। শেষে মানবাধিকার সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এ্যমনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল মিঠুন চাকমা হত্যার জোর তদন্ত দাবি করতে পারলে দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো পারবে না কেন? (সমাপ্ত)
——————

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More