অপহরণের পর মুক্তি পাওয়া মন্টি ও দয়াসোনা চাকমার ১৯টি সংগঠনের সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত

0

ঢাকা : পাহাড় ও সমতলের ১৯টি প্রগতিশীল নারী-যুব-ছাত্র সংগঠনসমূহের সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতে মিলিত হয়ে অপহরণের দুঃসহ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন সেনা-সৃষ্ট নব্য মুখোশবাহিনীর কবল থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও রাঙামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক দয়াসোনা চাকমা।

গতকাল শুক্রবার (২৭ এপ্রিল) ঢাকা তোপখানা রোডস্থ জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল কার্যালয়ে রাত পৌনে ৮টার দিকে এ সাক্ষাত অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। এসময় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দুই নেত্রীকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক নীতি শোভা চাকমা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক কইংজনা মারমা।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরূপা চাকমা ১৯ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সামনে অপহরণ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরার পর প্রায় মাসাধিককাল অপহরণকারীদের হেফাজতে থাকার দুঃসহ ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন মন্টি চাকমা। এসময় উপস্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। সবাই মনযোগ সহকারে প্রায় ৩৩দিন যাবৎ বন্দিত্বের দুর্বিষহ কাহিনী শোনেন।

তিনি অপহরণের গোটা সময়টাতে মৃত্যুর আশংকার মধ্যে ছিলেন উল্লেখ করে বলেন, আমাদেরকে প্রায় সময় ধর্ষণের হুমকি দেয়া হতো। বিশেষ করে মুখোশ সর্দার বর্মা ও প্রত্যয় (দাজ্জে) অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে গালিগালাজ ও বিভিন্ন হুমকি দিতো। শুধু তাই নয়, আমরা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার ভয়েও ছিলাম। কারণ, আমাদেরকে সবসময় সেনা ক্যাম্পের কাছাকাছি রাখা হতো এবং অপহরণকারী সন্ত্রাসীরা প্রায়ই মোবাইলে বাংলায় কথা বলতে শুনতাম। তাদের কথাবার্তা শুনে আমাদের মনে হতো তারা সেনাবাহিনীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চলেছে। আমরা একসময় বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিই। এভাবে থাকতে থাকতে একদিন একটা বাড়িতে আমরা একটা নতুন ব্লেড পেয়ে যায়। কোন অঘটন ঘটলে আমরা আত্মহত্যার করার জন্য দুজনে মনস্থির করে সেটা আমরা লুকিয়ে রাখি।

অপহরণের তিন দিনের মাথায় ২০ মার্চ আমাদেরকে জেএসএস সংস্কারপন্থীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মহালছড়ির মুবাছড়ি নামক এলাকার রাধামন বাজারে নিয়ে গিয়ে সংস্কারদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এরপর দুইদিন দুইরাত হেঁটে লংগদু ও দিঘীনালা সীমান্তবর্তী মেরুং নামক এলাকায় নিয়ে গিয়ে একজন সংস্কারপন্থী স্থানীয় নেতার বাড়িতে সশস্ত্র পাহারায় রাখা হয়। সেখানে আমাদেরকে একটা রুমে সারাদিন আটকিয়ে রাখা হতো। দুই-তিন দিন পর রাতে সশস্ত্র প্রহরায় গোসল করতে নিয়ে যেতো। শারীরিক নির্যাতন না চালালেও তীব্র মানসিক নির্যাতনের মধ্যে ছিলাম। এভাবে আপনাদের সামনে বেঁচে ফিরবো আশা করিনি।

তিনি আরো বলেন, ১৩ এপ্রিল মেরুং থেকে আমাদেরকে খাগড়াছড়িতে আনা হয়। তার আগে ৩ এপ্রিল হুমকি দিয়ে আমাদের কাছ থেকে একটি ভিডিও রেকর্ড করিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। তুজিম নামে একজন সশস্ত্র সন্ত্রাসীসহ আমাদেরকে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয়। খাগড়াছড়ি আসার পথে বহু আর্মি ক্যাম্প ও চেকপোস্টের সামনে দিয়ে আসলেও কোথাও গাড়ি থামানো হয়নি। সবচেয়ে আশ্চার্যের ঘটনা হলো খাগড়াছড়ির তেঁতুলতলাস্থ এপি ব্যাটালিয়ন গেইটে পাহারারত এপি ব্যাটালিয়ন সদস্যটির সামনে দিয়ে গাড়িটি গেইটের ভেতর ঢুকলেও সে কিছুই বলেনি। এমনকি তার কাছ থেকে মাত্র ৫০ গজের মধ্যে অস্ত্রসহ গাড়ি থেকে নামলেও তিনি সেদিকে দৃষ্টিপাত করেন নি।

খাগড়াছড়ি সদরের তেঁতুলতলায় সংস্কাপন্থী জেএসএস-এর একজন (পানছড়ি আয়তন চাকমা) নেতার বাড়িতে আমাদের রাখা হয়। সেখানে প্রায় ৫দিন আটকিয়ে রাখার পর গত ১৯ এপ্রিল আমাদেরকে রাত আটটার পর মুুক্তি দেয়। এরপর আমরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আাসি। মুক্তি দেয়ার সময় সন্ত্রাসীরা আমাদের অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিদের উপর তিনটা শর্ত চাপিয়ে দেয়। শর্ত তিনটি হলো– রাজনীতি বা সংগঠন করা যাবে না, গ্রাম থেকে বাইরে নব্য মুখোশ বাহিনীর সর্দার তপনজ্যোতি চাকমা (বর্মা)-এর অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়া যাবে না এবং কারা অপহরণ করেছে সে ব্যাপারে কারোর কাছে মুখ খোলা যাবে না।  এসব শর্ত ভঙ্গ হলে আমাদের ও অভিভাবকদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। ফলে আমি সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকে আক্ষরিক অর্থে মুক্তি পেলেও বাড়িতে এসে নতুন একটা বন্দিত্বের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখিন হই। রাতে ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারি না। সবসময় বর্মা ও দাজ্জেসহ মা’কে ফোন করে আমার খবরাখবর নেয়। সেই সাথে আর্মি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও আমি বাড়িতে রয়েছি কিনা খবর নিতে মাকে প্রতিনিয়ত ফোন করে। সন্ত্রাসীরা আমার হাতে ফোন দিতে নিষেধ করে। এজন্য বাড়ির লোকজন আমাকে পরিচিত লোকজনের বাইরে কারোর সাথে যোগাযোগ এমনকি কথা বলতেও দিতো না। এরকম একটা প্রচ্ছন্ন হুমকির মুখে গত ২৪ এপ্রিল আমি আমার সহযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হই। পরে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে আসি এবং সহযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হই।

তিনি আরো বলেন, আমি চলে আসায় সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বাবা ও বড় ভাইকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে এবং পুরো পরিবারকে এলাকা থেকে উচ্ছেদের ভয় দেখাচ্ছে। বর্তমানে আমার বাবা ও বড় ভাই সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গোটা পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। আমি আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছি।

দয়াসোনা চাকমা বলেন, ‘আপনারা ১৯টি সংগঠনের পক্ষ থেকে আমদের মুক্তির দাবিতে যেভাবে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন এজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। মন্টি দি বলার পর সে ব্যাপারে আমার আর বলার তেমন নেই। মুক্তি পাওয়ার পর আমরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাই। আমাকে নিয়ে বাবা-মা চিন্তায় চিন্তায় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমি মুক্তি পাওয়ার পর তারা খুশি হয়। একটা স্বাক্ষাত মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরতে পেরে আমার নিজেরও ভালো লাগছিলো। আমার এইচডব্লিউএফ-এর স্থানীয় সহযোদ্ধারা আমার সাথে সাক্ষাত  করতে আসে। আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। আমার মুক্তির কথা শুনে অনেক সাংবাদিক পরদিন আমাদের বাড়িতে যায়। আমার সহযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাতের সেই আনন্দঘন মুহুর্তগুলি অনেকে ক্যামেরা বন্দি করে এবং আমার ইন্টারভিউও নেয়। আমি সমস্ত কিছু খুলে বলি। কিন্তু পরে কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল, টিভি ও সংবাদপত্রে আমার বক্তব্যকে খন্ডিত বা যে যার মতো করে প্রকাশ করতে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। এতে আমার মনে হয়েছে অপহরণের ঘটনাকে হালকা করে দেয়ার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে কেউ কেউ এমনটা করেছে। তবে এটা ঠিক যে, অপহরণকারীদের মধ্যে দু’একজন আমাদের সাথে অন্যদের তুলনায় কিছুটা মানবিক ব্যবহারও করেছে’।

এরপর ছাত্র ফেডারেশনের এমএম পারভেজ লেনিন, সিপিবি নারী সেলের জলি তালুকদার, নারী মুক্তি কেন্দ্রের সীমা দত্ত ও সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের শম্পা বসুসহ অারো অনেকে বক্তব্য রাখেন।

তারা মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসায় স্বস্তি প্রকাশ করেন এবং অভিনন্দন জানান। একই সাথে  পরিবার দুটির উপর সেনাসৃষ্ট নব্য মুখোশবাহিনীর অব্যাহত হুমকিতে তারা গভীর উদ্ধেগ প্রকাশ করেন।

তারা প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মন্টি ও দয়াসোনা চাকমা অপহরণের পর নিয়ম মাফিক থানায় মামলা হয়েছে অথচ তাদের উদ্ধারের ব্যাপারে দৃশ্যমান কোন ভূমিকা তো ছিলই না, এমনকি মুক্তির পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন খোঁজ খবর নেয়া হয়নি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় উক্ত অপহরণ ঘটনার সাথে রাষ্ট্র জড়িত।

সভা থেকে মন্টি ও দয়াসোনা চাকমার মুক্তির দাবিতে ১৯ সংগঠনের ঘোষিত কর্মসূচীগুলো প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরো নতুন কর্মসূচী ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
_______
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More