আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস : পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসব

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫
আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রকৃতিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৭২ সালে পবিবেশ দিবস পালনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ৫ জুনকে World Environment Day (বিশ্ব পরিবেশ দিবস) হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো এই দিবসটি উদযাপন করা শুরু হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর এই দিনে পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে আসছে। পরিবেশ দিবস প্রথম পালিত হয় সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। দিবসটি উপলক্ষ্যে পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই পরিবেশ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য টেকসই ও স্থিতিস্থাপক বিশ্ব তৈরিতে পরিবেশ রক্ষার বিকল্প নেই। বনভূমি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বনভূমি কেবল লক্ষ লক্ষ প্রজাতির আবাসস্থল নয়, তারা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন উজাড় হয়ে যাওয়ার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ব। বন উজাড়ের পাশাপাশি শিল্পায়ানের ফলে গ্রীণ হাউস গ্যাসের নিঃসরন ব্যাপকভাবে বাড়ছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালে কার্বন নিঃসরনের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৪০ বিলিয়ন টন, যা ২০২২ সালে তুলনায় ১.১% বেশি। কার্বন নিঃসরন বৃদ্ধি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ১৮৫০ সাল থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা রেকর্ড শুরু হবার পর ২০২৩ সাল ছিলো সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন ও প্রকৃতিতে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে নানারকম প্রাকৃত্রিক দুর্যোগ যেমন: অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বনায়ন ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩.৯২ বিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে। এই বনভূমির অর্ধেকেরও বেশি (প্রায় ৫৪%) বনভূমি রয়েছে পৃথিবীর মাত্র ০৫ টি দেশে- রাশিয়া (২০.১%), ব্রাজিল (১২.২%), কানাডা (৮.৬%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৭.৬%) এবং চীন (৫.৪%)। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট বনভূমি রয়েছে ১৪,৩২,৮০০ হেক্টর, যা পৃথিবীর মোট বনভূমি মাত্র ০.০০৪%।
পরিবেশ সুরক্ষায় একটি দেশের আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন সেখানে বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ ১৪.৪৭ ভাগ, যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কম বনভূমি ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুকিপূর্ণ তালিকায় প্রথম দিকে অবস্থান করছে। (তথ্য সূত্র: অনলাইন)

অবাধে পাহাড় ও বন-জঙ্গল কেটে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের একটি চিত্র। ফাইল ছবি
বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনসহ নানা বাণী প্রচার করলেও কার্যত কথিত উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও পর্যটন শিল্প সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসের এক মহোৎসব চলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এক সময় ঘন গহীন প্রাকৃতিক বনে আচ্ছাদিত ছিল। বাঘ, ভালুক, হাতিসহ বহু প্রাণীর অভয়ারণ্য ছিল এই এলাকা। এখন আর সে অবস্থা নেই। সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে পাকা সড়ক, অবাধে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে পর্যটন।
পর্যটনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে রাস্তাঘাট অন্যতম। কিন্তু যত্রতত্র আধুনিক পাকা রাস্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ও প্রকৃতির উপর কী বিরূপ প্রভাব ফেলছে তার কোন হিসাব রাখা হয় না। দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেদিকে পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, সেদিকের বন উজাড় হয়ে গেছে। ২০০৫—৬ সালে বাঘাইহাট থেকে রুইলুই পর্যন্ত পাকা সড়ক নির্মাণ করা হলে কয়েক বছরের মধ্যেই সাজেকের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল সাবাড় হয়ে যায়। কারণ পাকা সড়ক নির্মাণের কারণে ব্যবসায়ীদের সেখানকার গাছ আহরণের স্বর্ণ দুয়ার খুলে যায়। যেখানে যুগের পর যুগ জুম চাষ করেও বনের কোন ক্ষতি হয়নি, রাস্তা হওয়ার পর গাছ ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক চর্চায় ২/৩ বছরের মধ্যেই সেই বন ধ্বংস হয়ে যায়। আর বন্য হাতি, বাঘ ইত্যাদি প্রাণীগুলো হয় ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে নতুবা বিলুপ্তির পথে রয়েছে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত জুড়ে ১০৩৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে তিন শ কিলোমিটারের অধিক সড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্র্রাকশন বিভাগের ঠিকাদারীতে নির্মিত হচ্ছে এ সড়কটি। এ সড়ক নির্মাণে অবাধে কাটা হচ্ছে পাহাড়, উজাড় করা হচ্ছে বন, উচ্ছেদ করে দেয়া হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে পরিবেশের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে সে বিষয়ে কোন কিছুই ভাবা হচ্ছে না।
সরকার ও তার পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অবাধে পাহাড় কেটে, বন উজাড় করে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে সে বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন উজাড় হয়ে যাওয়ার ফলে ছড়া-ঝিরিগুলো মরে যাচ্ছে. আগের মতো আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ শুষ্ক মৌসুমে প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত লোকজন তীব্র পানির সংকটে পতিত হচ্ছে। অপরদিকে একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। ২০১৭ সালে পাহাড় ধসের কারণে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
সম্প্রতি সরকার লংগদু-নান্যাচর সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে গেছে। এ নিয়ে বন উজাড়, পাহাড় কাটাসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে নান্যাচর লংগদু এলাকার জনগণ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রকল্পটি বাতিলের দাবিতে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও বনজ সম্পদ কেবল পাহাড়ি বা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের নয়, তা দেশের সম্পদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের পরিবেশবাদীরা, বুদ্ধিজীবী তথা প্রগতিশীলরা সুন্দরবনের জন্য যতটা সোচ্চার, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় ততটা নীরব। কাজেই, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সকলকে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।