স্বাধিকার বুলেটিন থেকে

আসন্ন চুক্তি : অধিকার প্রতিষ্ঠা না জলাঞ্জলি?

0


 [এই লেখাটি ১৯৯৭ সালের ১০ জুন ‘স্বাধিকার বুলেটিন’ (পিজিপি-পিসিপি-এইচডব্লিউএফ’র যৌথ মুখপত্র)-এর ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। যে সময় লেখাটি প্রকাশিত হয় সে সময় জনগণের সকল মতামত উপেক্ষা করে সরকার ও জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চুক্তির প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। সংবাদপত্রে জনসংহতি সমিতি তাদের পাঁচ দফা মূল দাবী থেকে অনেক বড় ছাড় দেয়ার খবর প্রকাশিত হয়। সে সময় স্বাধিকারের এ লেখায় মন্তব্য করে বলা হয়, ‘বাস্তবিক যদি সরকার ও JSS’এর মধ্যে এই ধরনের ঐকমত্য হয়ে থাকে, সেই ভিত্তিতে যদি JSS চুক্তি সম্পাদনের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে পার্বত্য চট্টগামের দুর্ভাগা মানুষের JSS কে কিছু বলার আছে।’ সিএইচটি নিউজের পাঠকদের জন্য লেখাটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো]  


।। রাজনৈতিক ভাষ্যকার।।

অবশেষে সরকার ও JSS এর মধ্যে “সকল বিষয়ে ঐক্যমত্য” প্রতিষ্ঠিত হয়ে অতি শীঘ্রই চুক্তি হতে যাচ্ছে। সরকারের সাথে বোঝাপড়া শেষে ১৫ই মে দুদুকছড়ায় ফিরে JSS নেতৃবৃন্দ জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেননি। সাংবাদিকদেরও থাকতে দেয়া হয়নি। যা আগের নিয়মের পুরো ব্যতিক্রম। (The daily Star, May 16, 1997)

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ, সবাইকে অবাক করে সেদিন শান্তিবাহিনীর সদস্যরাই উপস্থিত লোকজনকে চেক করেছে। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝে শিশু-কিশোর, মহিলা, খেটে খাওয়া লুঙ্গি-গামছা পরা তারপরে প্যান্ট শার্টপরা শিক্ষিত লোকজন এভাবে বিভাজন করে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে সংক্ষেপে দু’এক কথা বলে অনেকটা তড়িঘড়ি করে JSS নেতৃবৃন্দ স্থান ত্যাগ করেন। স্বেচ্ছা সেবকের দায়ত্বপালনকারী ব্যক্তিদের মধ্য থেকেও কাউকে কাউকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর এলাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি।

সীমান্তবর্তী দুদুকছড়াতে ইতিপুর্বে প্রতিটি বৈঠকের প্রাক্কালে যেখানে “মানুষের ঢল নামে”, “মিলন মেলা বসে” ও “উৎসবমুখর পরিবেশের” সৃষ্টি হতো। চুক্তিতে (?) উপনীত হবার এতবড় সাফল্যের(?) পরে সেদিন কেন দুদুকছড়াতে কোন আনন্দ-উল্লাস হয়নি এবং ঔঝঝ নেতৃবৃন্দ চুক্তির সাফল্য ও সার্থকতা ব্যাখ্যা না করে কেনই বা তড়িঘড়ি করে স্থান ত্যাগ করেছিলেন তা বেশ রহস্যময়।

বৈঠককে ঘিরে কয়েকটি দিক বেশ লক্ষণীয়, চতুর্থ দফা বৈঠকের তৃতীয় দিনেও সরকার ও JSS উভয়পক্ষের ঐকমত্য না হওয়ায় যৌথ প্রেস ব্রিফিং হয়নি। (The daily Star, May 14, 1997). সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির চতুর্থ বৈঠকের প্রথম দিনে সন্তু লারমা, সুধাসিন্ধু খীসা ও গৌতম চাকমা উপস্থিত থাকলেও, ১৪ মে দুপুরের পর কেবল চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাাহ ও সন্তু লারমা একান্তে বৈঠক করেন। তারা সকল বিষয়ে খুব সহজেই একমত হন। (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৫ মে ’৯৭)

উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ২১ ডিসেম্বর প্রথম দফা বৈঠকে “I am very much hopeful, definitely hopeful” বলে JSS প্রধান সন্তু লারমা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। নতুন সরকারের সাথে “নতুন উপলব্ধি” ও “নতুনত্বের” অনুভূতিও প্রকাশ করেন। পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে চতুর্থ বৈঠকটিই ছিল শেষ বৈঠক। এখন, উভয়পক্ষ অনেকটা কেবল চুক্তি সম্পাদনের দিনক্ষণ প্রতীক্ষা করছে মাত্র। আসন্ন চুক্তির পুরো দলিলটি প্রকাশ করা না হলেও, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মূল মূল বিষয়গুলো প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। চুক্তি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকাায় পরিবেশিত তথ্য বেশ কিছু দিক সুস্পষ্ট করে তুলেছে।

১. স্বীকৃতি ও অধিকার প্রসঙ্গে: বৈঠকে জনসংহতি সমিতি সংবিধান পরিবর্তন করে পাহাড়ি জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত দাবী ছেড়ে দিয়েছেন। (সংবাদ, ১৫ মে ’৯৭)

২. শান্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে: জনসংহতি সমিতি বর্তমানের মত অবস্থানে থাকলেও শান্তিবাহিনী ভেঙে দেয়া হবে। তারা সমস্ত অস্ত্র সরকারের কাছে জমা দেবে। এর আগে শান্তি বাহিনীর হাতে যে সমস্ত অস্ত্র রয়েছে তার একটি হিসাব দাখিল করা হবে সরকারের কাছে। দেশের অন্যান্য ভূ-খন্ডের মতো পাহাড়ি এলাকায় সামরিক বাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট থাকবে। অপ্রয়োজনীয় সামরিক (Temporary) ক্যাম্প তুলে নেয়া হবে। সামরিক বাহিনী তাদের রুটিন কাজগুলো করবে। বিভিন্ন পাহাড়ে সামরিক বাহিনীর বর্তমান ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো বহাল থাকবে। (পূর্বকোণ, ১৫ মে ’৯৭)

৩. ভূমি ও সেটলার প্রসঙ্গে: সেটেলার প্রশ্নে ও জনসংহতি……যে দাবী তুলেছিল তা থেকে সরে এসেছে। ……১৯৮৭’র পর সরকার যাদেরকে সেখানে অভিবাসী করেছে, তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে। …… ভূমি প্রসঙ্গে জাতীয় কমিটি পাহাড়িদের ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার যে আশ্বাস দিয়েছে তাও মেনে নিয়েছে জনসংহতি সমিতি সমিতির নেতারা। (সংবাদ, ১৫ মে ’৯৭)।

বৈঠক সম্পর্কে বিবিসিকে দেয়া ১৬ মে সাক্ষাৎকারে সরকারী নেতা কল্প বাবু বলেছেন, দফাওয়ারী কোন আলোচনাই হয়নি। সেনাবাহিনী ও বহিরাগত প্রত্যাহারের প্রশ্ন উঠে না। সংবিধানও পরিবর্তন হবে না।

তিনি আরো আগ বাড়িয়ে এও বলেছেন, “…… আমরা সেই সব (সেনাবাহিনী ও বহিরাগত প্রত্যাহার, সংবিধান সংশোধন) চাই না।”

প্রাপ্ত তথ্যমতে, জনসংহতি সমিতি তাদের পাঁচ দফা মূল দাবী থেকে অনেক বড় ছাড় দিয়েছে। (সংবাদ, ঐ) বাস্তবিক যদি সরকার ও JSS’এর মধ্যে এই ধরনের ঐকমত্য হয়ে থাকে, সেই ভিত্তিতে যদি JSS চুক্তি সম্পাদনের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে পার্বত্য চট্টগামের দুর্ভাগা মানুষের JSS কে কিছু বলার আছে। নিজেদের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানার ও প্রশ্ন করার আছে। এভাবে যদি মূল দাবী ছাড়া দিয়ে চুক্তি হয়, তাহলে হতভাগা পার্বত্যবাসীদের অধিকার কি তাতে প্রতিষ্ঠিত হবে? মূল দাবী ছাড় দিতেই যদি হবে, তাহলে এত বছর এত লোকক্ষয় এত ধন সম্পন্ন ক্ষয় করে কি দরকার ছিলো দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম চালানোর? এভাবে যদি চুক্তিই হবে, তাহলে কেন মরিচিকার(?)- পেছনে মিথ্যা মোহ সৃষ্টি করে এতগুলো সম্ভাবনাময়ী তরুণের ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে তোলা হলো? ’৮৯ এর জুনে স্বৈরাচারী এরশাদের প্রবর্তিত “জেলা পরিষদ” ব্যবস্থা থেকে আসন্ন চুক্তি কোন দিকেই বা উন্নত?

ভূমি অধিকার এবং নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে অর্ধ লক্ষাধিক শরণার্থী কি ভরশায় দীর্ঘ একটি যুগ বিদেশ-বিভূঁই’এ মানবেতর জীবন কাটালো? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের সাথে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাকারী JSS নেতৃবৃন্দকে দিতে হবে।

সরকারের সাথে চুপিসারে বোঝাপড়া করেই JSS’র দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এতকাল যাবৎ যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে JSS সাধারণ নিরীহ মানুষকে সীমাহীন দুঃখকষ্ট মেনে নিয়ে ধৈর্য্য ধরতে বলেছে। ওষ্ঠাগত প্রাণ মানুষের মুখে গ্রাস থেকে ভাগ নিয়ে ভবিষ্যত সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে আন্দোলন চালিয়েছে। সরকারের সাথে ঐকমত্যের মাধ্যমে JSS সেই সব নিশ্চিত করতে সক্ষম হলো নাকি জনগণের আগে যতটুকু সম্ভাবনা ছিলো তাও অনিশ্চয়তার অটল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে? জনগণের এত ত্যাগ-তিতিক্ষার কি মূল্য থাকলো? পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা সমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ দুই যুগ লড়াই সংগ্রামে যে ক্ষয়-ক্ষতি হলো, তার ন্যায্য দাম উশুল হচ্ছে কি? পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অস্তিত্ব, ভবিষ্যত ও নিরাপত্তার বিধান JSS করতে পেরেছে কিনা তার বুঝ জনগণকে দিতে হবে।

এটা ঠিক যে, এত বছর যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে কষ্টকর লড়াই সংগ্রাম চলেছে, সেই লক্ষ্য পূরণ না হলে, জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কেবলমাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থ চারিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্যে কোন আপোষ রফা হলে তা JSS-এর প্রকৃত দেশ প্রেমিক সংগ্রামী বন্ধুদের পক্ষে মানা সম্ভব হবে না।

মনে রাখতে হবে যে, নিজের ইচ্ছায় আন্দোলনে শরীক হয়ে অস্ত্র ধরলেও জনগণের দাবী অর্জিত না হলে, কেবলমাত্র নিজের প্রয়োজনে বা স্বার্থে সেই অস্ত্র কারোর হাতে তুলে দিলে সেটা একধরনের “অস্ত্র ব্যবসার” মতো হবে। জনগণের দাবী পূরণ না হলে মাঝপথে আন্দোলন ভন্ডুল করা জনগণের সাথে প্রতারণা করার মতো।

জাতীয় আন্দোলনে কোন ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলে না। জনগণের প্রয়োজন ও স্বার্থে আন্দোলন চলে এবং গড়ে উঠে। জনগণের প্রয়োজন স্বার্থ, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত না করে, জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন কাজ করার অধিকার কারোর নেই। জনগণের সাথে ফয়সালা না হলে, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ফাঁকা বুলিই থেকে যাবে। এবং তা অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়, জলাঞ্জলি দেয়ার সামিল হবে।

আওয়ামী লীগকে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের মন্তব্যটিই স্মরণ করে দেয়া যায়, সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য অকার্যকর চুক্তির বদলে কার্যকর ও অর্থপূর্ণ চুক্তিই দেশের জন্য কাম্য। (২০ মে ’৯৭)

দেশের রাজনৈতিক দল বলে পরিচয়দানকারী বি.এন.পি ও জাতীয় পার্টিকে মনে রাখতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার ভবিষ্যতে কোনদিন আন্তর্জাতিক আদালতে শুরু হলে তাদের চেলা-চামুন্ডাদেরকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কাজেই, এই দুটো দল আর যাতে অপরাধের তালিকা না বাড়ায়, সেজন্য তাদের নীতিনির্ধারকদের এই দিকটি স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত। জামাতে ইসলামী দেশের শাসন ক্ষমতায় কোন বার অধিষ্ঠিত না হলেও যেভাবে সুকৌশলে প্রতিটি শাসকদলের সাথে যোগ সাজশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু উচ্ছেদ অভিযানে ভূমিকা রাখে, তা কারো অজানা নয়।

সময় সময় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের জিগির তুলে কিংবা অন্য কোন ইস্যু বানিয়ে সুবিধা করতে না পারলে ভারত বিরোধীতাকে পুঁজি করে নিম্নমানের রাজনীতি করার দিন শেষ হয়ে আসছে। দেশবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ আগের চাইতে অনেক সজাগ।

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তথা শান্তি স্থিতিশীলতা উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবিলম্বে সকল ধরনের ষড়যন্ত্র বন্ধ করে স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল দলকে দূরদৃষ্টি নিয়ে আেগিয়ে আসতে হবে।

পাহাড়ি জাতিসত্তা সমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।#

(সূত্র: স্বাধিকার বুলেটিন ৬, প্রকাশ: ১০ জুন ১৯৯৭)



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More