ঢাকা : ইউপিডিএফ-এর সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা ও সাধারণ সম্পাদক রবিশংকর চাকমাসহ ১১৮ জন নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা বাতিল করার দাবিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ঢাকা শাখার উদ্যোগে আজ শুক্রবার (১১ মে) বিকাল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সম্মুখে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

পিসিপি ঢাকা শাখার সভাপতি রিয়েল ত্রিপুরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের সভাপতি মাসুদ খান, ইউপিডএফ সংগঠক মাইকেল চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এমএম পারভেজ লেলিন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের (ডিওয়াইএফ) সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা ও ঢাকার আহ্বায়ক রিপন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের (এইচডব্লিউএফ) কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরূপা চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সভাপতি বিনয়ন চাকমা ও এইচডব্লিএফ ঢাকা শাখার আহ্বায়ক কইংজনা মারমা।
সভা পরিচালনা করেন পিসিপি ঢাকা শাখার সহ-সভাপতি শুভাশীষ চাকমা।

সমাবেশে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদেশের জনগণ যে দীর্ঘ ২৪ বছর সংগ্রাম করেছিল সেই সংগ্রাম পরবর্তীতে একটা যুদ্ধে পরণত হয়েছিল। যে অন্যায় যুদ্ধ এদেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, সে যুদ্ধ শেষ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ আশা করেছিল এই নতুন রাষ্ট্রে বাঙালিসহ বিভিন্ন জাতি ও জনগণ সকলে সমান অধিকার তারা পাবেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও সে আশা পূরণ হয়নি।

তিনি পার্বত্য চট্ট্রগামে স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ১১ দফা নির্দেশনাকে সমালোচনা করে বলেন, সেখানে আজ সভা সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। সেখানে অঘোষিতভাবে সেনাশাসন জারি রয়েছে। আমরা সরকারের কাছে জানতে চাই পার্বত্য অঞ্চলে কার শাসন চলছে? এই সরকারের শাসন চলছে নাকি সেনা শাসন চলছে? তিনি বলেন, সরকার সেনাশাসনের অধীন কিনা সেটা জনগণ জানতে চাই।

তিনি ইউপিডিএফ-এর অন্যতম সংগঠক মিঠুন চাকমাকে দিনে দুপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা ও সম্প্রতি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রীকে অপহরণের পর আন্দোলনের পর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে উল্লেখ করে সরকারের নিকট প্রশ্ন রেখে বলেন, কারা এসব কাজ করেছে? সেখানে যে শান্তি ও নিরাপত্তার নামে নিরাপত্তাবাহিনী রয়েছে, প্রশাসন রয়েছে তাদের কর্তব্য কি? তাদের কর্তব্য কি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা নাকি অশান্তি সৃষ্টি করা দেশবাসী তা জানতে চাই।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নেতা কমরেড প্রসিত বিকাশ খীসা ও কমরেড রবি শংকর চাকমাসহ সকল নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা বাতিলের দাবি এবং সকল নিপীড়ন বন্ধ করার দাবি জানান।
ফয়জুল হাকিম আরো বলেন, সরকারকে এটা ভাবলে ভুল হবে যে তারা একা এবং তাদেরকে দমন করা সহজ হবে। সমগ্র বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ ও নিপীড়িত জাতি তাদের সাথে রয়েছে। তিনি পাহাড় ও সমতলের শোষিত, নিপীড়িত, অপমানিত, বঞ্চিত, নির্যাতিন জনগণ ও শ্রমিক কৃষক নিপীড়িত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লুটেরা শোষক সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

পাহাড়ি দিয়ে পাহাড়িদের খুন এই ঘটনাকে রূপ দেয়ার জন্য এক বিশেষ গোষ্ঠীকে তৈরী করা হয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের সভাপতি মাসুদ খান বলেন, গত ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর এদের আবির্ভাবের পর থেকে ইউপিডিএফ এবং ইউপিডিএফভুক্ত যত সংগঠন ও সমর্থক রয়েছে তাদেরকে ধরে ধরে খুন করা হচ্ছে। মিঠুন চাকমাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের খুন করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত।
সম্প্রতি হত্যাকাণ্ডের পর যেভাবে ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে গণমামলা দায়ের করা হচ্ছে তা থেকে পরিস্কার যে এটা একটা রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছিল। একদিকে যেমন তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত সৃষ্টি করে জনগণের সংগ্রামকে ধ্বংস করার চেষ্টা, অন্যদিকে ষড়যন্ত্র এবং গণমামলার মতো রাষ্ট্রীয় আয়োজনের মধ্যে দিয়ে ইউপিডিএফকে দমানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এ ধরণের ঘটনাগুলো আইয়ুবের আমলেও হয়েছে। আবার বিগত ফকরুদ্দিন ও মঈন উদ্দিন সরকারের আমলেও হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার জন্য হাজার হাজার ছাত্রের বিরুদ্ধে সেসময় মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামেও হাসিনা সরকার আজ সেটা ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, শুধু পাহাড়ে নয় সমগ্র দেশে যেখানে মানুষ ন্যায় সংগ্রাম নিয়ে হাজির হচ্ছে সেখানে এভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। ক’দিন আগে ছাত্ররা যখন কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন করছিলো সেসময়ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও ষড়যন্ত্র করে তাদের সংগ্রামকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তিনি আওয়ামী ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অন্যায় দমন নিপীড়ন চালিয়ে কোন ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে নিঃশেষ করে দেয়া যায় না। দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে যেয়ে অনেকে শহীদও হন। সেই শহীদদের রক্তে সংগ্রামের ভূমি উর্বর হয়। তখন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সংগ্রাম আরো দ্বিগুন হয়ে ওঠে। তিনি পাহাড়ি জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে দমন করার ষড়যন্ত্রমূলক ও সন্ত্রাসবাদী পথ পরিহার করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের ন্যায্য আন্দোলনকে দমন করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এর জবাব অবশ্যই পাহাড়ি জনগণ দেবে। তাদের সাথে সমতলের নিপীড়ত জনগণ আছে এবং থাকবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা বলেন, সম্প্রতি শক্তিমান চাকমা ও মুখোশ সর্দার তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার হত্যার পর ইউপিডিএফ-এর শীর্ষ নেতৃত্বসহ শতাধিক রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হযেছে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এটা ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বর্মাদের সৃষ্টি এবং তাদেরকে দিয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পর্যায়ক্রমিক হত্যা যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ছিল, ঠিক শক্তিমান ও বর্মাদের হত্যার পর ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে গণমামলা দায়ের করাটাও ছিল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পিত। ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে জনগণের যে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চলেছে তা নস্যাৎ করে দিতে শুধু শক্তি প্রয়োগ করে নয়, রাষ্ট্র এখন আইন আদালতের মাধ্যমেও তা শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি সরকারের প্রতি এ অশুভ অপতৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনো মাথা নত করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না। ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে যে কোন রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত জনগণ বরদাস্ত করবে না। তিনি সমাবেশ থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে নিরীহ জনগণের হয়রানি বন্ধ করা আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে দায়েরকৃত ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা গণমামলা বাতিলের দাবি জানান।
সমাবেশ শেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শুরু হয়ে তোপখানা রোড হয়ে পল্টন ঘুরে পুনরায় প্রেস ক্লাবের সম্মুখে এসে শেষ হয়।
________
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।