॥ মন্তব্য প্রতিবেদন॥
গতকাল সোমবার একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজ ক্যাম্পাসে ও শহরের দু’ একটি স্থানে আবারো বিষাক্ত ফনা তুলে নিরীহ মানুষের উপর ছোবল মারতে চেয়েছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও প্রশাসনের তড়িৎ হস্তক্ষেপের কারণে তারা খুব বেশী আঁচড় বসাতে পারেনি। তারপরও তাদের হামলায় ক্যাম্পাসে একাদশ শ্রেণীর দুই পাহাড়ি ছাত্র ও শহরের তিনটি স্থানে তিন পাহাড়ি আহত হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, বাঙালি ছাত্র পরিষদের কিছু কর্মি গতকাল সকালে সোনাক্কো চাকমা ও সুখময় চাকমা নামে কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে মারধর করে। এর বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দেয়া হলে অধ্যক্ষ বিষয়টি মীমাংসার জন্য উভয় পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। আলোচনা চলার সময় পৌর কাউন্সিলর মাসুদ রানার নেতৃত্বে বহিরাগত বাঙালি ছাত্র পরিষদের কর্মিরা অধ্যক্ষের রুমের কাছে ছাত্রদের উপর আবারো হামলা করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে বাছাপ কর্মিরা শহরের কয়েকটি স্থানে পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় ও পাহাড়ি অধ্যুষিত কলেজ পাড়ায় ঢুকে বাড়িঘরে আগুন দেয়ার চেষ্টা করে। তবে সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও জনগণের প্রতিরোধের মুখে তাদের সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এটা এখন স্পষ্ট যে, স্থানীয় সেনা ও সিভিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়া না হলে গতকাল আরও একটি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে পারতো। এর মাধ্যমে আবারো প্রমাণ হয়েছে যে, প্রশাসনের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে সেটলাররা নিজেরা বড় ধরনের সহিংস ঘটনার জন্ম দিতে পারে না। সেনাবাহিনী ও প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ হবেই। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

বাছাপ যেভাবে কলেজ কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে ও আলোচনা ভন্ডুল করে দিয়েছে, তা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। কলেজ প্রশাসন যদি অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির বিধান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তিগুলে আরো বেশী বেপরোয়া হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে তারা যতটুকু উদ্ধত হয়েছে তাও কিন্তু এতদিন ধরে তাদেরকে দুধ কলা দিয়ে পোষার ফল। আমরা আশা করি কলেজ কর্তৃপক্ষ বাছাপ-এর ঔদ্ধত্য হজম না করে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে। নিরপেক্ষতাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একবার যদি তা ক্ষুন্ন হয়, তাহলে কলেজ কর্তৃপক্ষের উপর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আস্থা থাকবে না এবং তখন কলেজ প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এতো গেলো কলেজ প্রশাসনের করণীয় সম্পর্কে কথা। সার্বিকভাবে বাছাপ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্রিয়াশীল অন্যান্য উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের সংগঠন করার অধিকার আছে। তবে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই অধিকারকে শর্তাধীন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘…কোন ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি – (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।…’ [ ৩৮ অনুচ্ছেদ ]

বাছাপ, পার্বত্য গণ পরিষদ ও সমঅধিকার আন্দোলন হলো বিএনপি আমলের সৃষ্টি। গত শতকের ৯০ দশকে পাহাড়ি জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মাধ্যমে দমনের জন্য এইসব উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর জন্ম দেয়া হয়েছিল। গত ২৫ – ২৬ বছরে এই সংগঠনগুলো কেবল সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, পাহাড়িদের উপর অসংখ্য হামলা চালিয়েছে, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে লোকজনকে সর্বস্বান্ত করেছে এবং বহু নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও তাদের অশুভ তৎপরতায় ভাটা পড়েনি। সম্প্রতি ভূমি কমিশন আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে তারা জনজীবন বিষিয়ে তুলেছে। শুধু তাই নয়, তারা বহু নিরীহ ও নিরপরাধ পাহাড়ির উপর সাম্প্রদায়িক হামলাও চালিয়েছে। তারা নির্বিঘ্নে এসব করতে পারছে কারণ তাদের পেছেনে ক্ষমতাশালীদের একটি অংশের মদদ ও জামাতে ইসলামীর সমর্থন রয়েছে।
কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সহিসংসতা বন্ধ করতে হলে এই সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান মোতাবেক এই পদক্ষেপ নেয়া যাবে। কারণ এই সংবিধান ঘোষণা করে যে, ‘ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে’ কোন সংগঠন করা যাবে না। বাছাপ ও উপরোল্লেখিত সংগঠনগুলো ঠিক এই উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছিল এবং তারা এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিনিয়ত ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে চলেছে। [সমাপ্ত]
——————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।