উচ্ছেদের শিকার ২১ পরিবারের শিক্ষার্থীরা কেমন আছে?
॥ নিঝুম চাকমা ॥
দীঘিনালায় বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের নামে জমি অধিগ্রহণের কারণে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর সন্তান ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের ঘেরার মধ্যে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও পড়াশুনায় নানাভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
যত্ন কুমার ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ার যে ২১ পরিবারের ৮৬ জন উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে ২৭ জন হল প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালের ১০ জুন বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা তাদেরকে জোরপূর্বক নিজেদের ঘরবাড়ি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে। এ সময় নারীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
শিক্ষার্থীরা কেমন আছে তা জানার জন্য আমরা বিজিবি ক্যাম্পের কাঁটাতারের ঘেরার মধ্যে ২নং বাবুছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাই। সেখানে মোট ১১৩ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে বলে শিক্ষকরা জানালেন। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক এ প্রতিবেদককে বলেন, বিজিবি জোর করে অবৈধভাবে জায়গা দখল করেছে তিন বছর পার হচ্ছে। এই তিন বছরে তাদের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম নানাভাবে ব্যাহত হয়েছে। বেশ কিছু দিন তারা ক্লাশ করাতে পারেননি।
তিনি আরো জানালেন, এখন শিক্ষার্থীদের খেলাধূলার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। স্কুলের মাঠে বিজিবি ইট-বালু-সিমেন্ট ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রী রেখে দেয়। ছেলেপিলেদের খেলাধূলা করতে অসুবিধা হয়। তারা বেশ কয়েকবার বিজিবিকে এ বিষয়ে নালিশ করলেও তারা তাতে কোন তোয়াক্কা করেনি। এছাড়া আগে শিক্ষার্থীরা যে কোন দিক থেকে নির্বিঘ্নে ইচ্ছেমত স্কুলে আসতে পারত। এখন বিজিবি কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। তাই ঘোরা পথে তাদের স্কুলে আসতে হয়।
ছাত্রছাত্রীদের কয়েকজনের সাথে আলাপ হলে তারা জানালো, স্কুলে আসার পথে বিজিবি সদস্যরা তাদের নামধাম পরিচয়, বাড়ি কোথায়, কোন ক্লাশে পড় ইত্যাদি প্রশ্ন করে, যা হয়রানির সামিল। উক্ত শিক্ষক আরো জানালেন, বিজিবি থেকে কেউ কেউ মাঝে মধ্যে স্কুলে আসে। তারা স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ করে; ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, কোন ক্লাশে কত জন ইত্যাদি বিরক্তিকর প্রশ্ন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী রেশমী চাকমা যখন কেঁদে কেঁদে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার কথা বলছিলেন তখন সে যে বিজিবিকে ভয়ের চোখে দেখে থাকে তা তার চোখমুখ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়। ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিজিবি যেন ভীতিকর জাতীয় একটা কিছু। কাজেই এমন পরিবেশে তাদের ক্লাশের পাঠ শিক্ষা করা বা পাঠে মনোযোগ দেয়া যে কঠিন হবে তা সহজেই অনুমেয়।
উচ্ছেদের শিকার ২১ পরিবারের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১১ জন প্রাথমিক লেভেলে লেখাপড়া করছে। হাইস্কুল লেভেলে পড়াশুনা করছে ৯ জন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ৪ জন। এছাড়া কলেজ লেভেলে পড়াশুনা করছে মোট ৩ জন।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে চার জন ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তাদের মধ্যে তিন জন পাশ করতে পেরেছে। বাকি একজন পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করেছে। সুজন চাকমা এবার বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আর্টসে পরীক্ষা দিয়েছে। সে জানালো, সে জিপিএ ২.৪৪ পেয়েছে। মুখ ভার করে সে জানালো, শিবির থেকে খুব কষ্টে তাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। গ্যাঞ্জাম ঘিঞ্জির কারণে লেখাপড়া ঠিকমত করতে পারেনি। এতে সে তার প্রত্যাশা মত রেজাল্ট করতে পারেনি বলে জানালো। পরীক্ষায় পাশ করলেও ভাল কোন কলেজে ভর্তি হতে পারবে কিনা এ নিয়ে সে চিন্তায় রয়েছে। সে জানালো, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হবার পর থেকে তাদের পিতামাতার আয় রোজগারে টান পড়েছে।
উচ্ছেদের শিকার আরেক শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার্থী রিটেন চাকমার খোঁজখবর নিলে সুজন জানালো যে, রিটেন জিপিএ ২.৬১ পয়েন্ট পেয়ে পাশ করেছে। সে জীবিকার তাগিদে গহীন অরণ্যে কাট্টনে গেছে। গহীন অরণ্য থেকে বাঁশ-গাছ ইত্যাদি কেটে বাজারে বিক্রি করাকে কাট্টন্যা বলা হয়। কাট্টন্যা যারা করতে যায় তারা সপ্তাহ বা মাস ভিত্তিক অরণ্যে ব্যক্তিগতভাবে বা কারো তত্ত্বাবধানে বাঁশ-গাছ থেকে থাকে। আরেক এসএসসি পরীক্ষার্থী ন্যান্সি চাকমা জীবিকার তাগিদে এখন চট্টগ্রামে গার্মেন্টেসে চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছে।
কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী অপ্সরী চাকমার সাথে প্রতিবেদক কথা বললে প্রথমেই তিনি জানালেন, তিনি মানসিক ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বিজিবি কর্তৃক অবৈধ উচ্ছেদের প্রতিবাদ করায় তাকে আটক করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১৩ জুন খাগড়াছড়ি হাসপাতাল থেকে আহত অবস্থায় তাকে ও আরো ৬ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের জেলে পাঠানো হয়। জুলাই মাসের ৭ তারিখ তিনি মুক্তি পান। তিনি এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন বলে জানালেন। তবে মানসিক ধকল কাটিয়ে উঠতে না পারায় পরীক্ষা ভালো হচ্ছে না বলে তিনি জানালেন।
উচ্ছেদের শিকার বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুদীপ্তা ও বৈশাখী চাকমার সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। ২০১৪ সালের ১০ জুন বিজিবি বাহিনী কর্তৃক নারীদের উপর হামলার ঘটনা স্মরণ করে তারা বলে, আমরা সেদিন মাঠে ফুটবল খেলা দেখছিলাম। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেঁচি শুনলাম। এরপর বিজিবি সবাইকে ধাওয়া দিলে আমরা পালিয়ে দিগি¦দিকশুন্য হয়ে সেখান থেকে চলে যাই। বৈশাখী চাকমা জানালো, ২০১৪ সালে সে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তো। এখন সে বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়ে। তার রোল নাম¦ার ৩৩। অস্থায়ী বাসস্থান, যাকে তারা শরণার্থী শিবির বলে অভিহিত করে, সেখানে থেকে লেখাপড়া তেমন হয় না বলে সে জানালো।
সুদীপ্তা চাকমাও সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। তার রোল নাম্বার ১১। বয়সে ছোট হলেও তারা জানালো, জায়গা ফিরে পাবার জন্য ২১ পরিবারের যে কোন আন্দোলনে তারা সক্রিয় হয়ে কাজ করে যাবে। তারা জানালো, জায়গা হারানোর অপমান ও বেদনা তারা কোনদিন ভুলতে পারবে না।
উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের শিক্ষার্থীরা সবাই তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কিত। তাদের অভিভাবকরাও চিন্তিত। উচ্ছেদের পর থেকে বাবুছড়ায় একটি পরিত্যক্ত সরকারী কার্যালয়ে তারা গাদাগাদি করে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। দুটি রুমে জায়গা সংকুলান হয় না বিধায় তারা ওই অফিসের পাশে নিজেরা একটি দোচালা ঘর নির্মাণ করেন। কিন্তু তাতেও এতগুলো লোকের জায়গা হয় না। ছেলেমেয়েদেরও ঠিকমত পড়াশোনা হয় না। টাকার অভাবে শিক্ষার উপকরণ যেমন কাগজ কলম বই পেন্সিল ইত্যাদি ঠিকমত কিনে দিতে পারেন না। প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ করার কথাতো ভাবতেই পারেন না। তারা জনেন না এভাবে আর কতদিন তাদেরকে নিজ ভূমিতে বিদেশী শরণার্থীর মতো দিন কাটাতে হবে। #
—————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।