ঐক্যের পথ কেন মসৃণ নয়?

0

সোহেল চাকমা


আজ থেকে ৬০ বছর পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কেনেডি একটি চমকপ্রদ ও অতুলনীয় ভাষণ দেন। বক্তৃতাটি তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত আংশিক পারমানবিক পরিক্ষা নিষেধাজ্ঞার চুক্তিতে সরাসরি অবদান রেখেছিল। বক্তৃতাটি হাতে পেয়ে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ রাশিয়ায় কেনেডির রাষ্ট্রদূত এ্যাভেরেল হ্যারিম্যানকে জানান, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের পর একজন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের এই ভাষণটি ছিল সেরা এবং তিনি কেনেডির সাথে মিলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান। বক্তৃতায় কেনেডি শান্তিকে ‘যুক্তিবাদী মানুষের প্রয়োজনীয় যুক্তিবাদী লক্ষ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেন। কেনেডির দৃষ্টিতে শান্তির গভীরতম চাবিকাঠি হচ্ছে উভয় পক্ষের শান্তি কামনা। একটি সংঘাতের জন্য অপর পক্ষকে দোষারোপ করার ফাঁদে পড়া খুবই সহজ। কেনেডি আরো বলেন, আমাদের অবশ্যই নিজের মনোভাব পুনঃপরীক্ষা করতে হবে- ব্যক্তি হিসেবে এবং একটি জাতি হিসেবে- কারণ আমাদের মনোভাব তাদের মতোই অপরিহার্য। আমাদের সমস্যা মনুষ্য সৃষ্ট, সুতরাং মানুষই সেসব সমস্যার সমাধান করতে পারে। এই বক্তৃতা প্রদানের কিছুদিন পর ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর মার্কিন মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করে।

উপরিউক্ত ঘটনাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাহাড়িদের রাজনৈতিক ঐক্য কেন মসৃণ ও সহজ নয় তা বুঝার দাবী রাখে। দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম রাজনৈতিক কূটকৌশলের বলির শিকার। শাসকগোষ্ঠীই এই কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করে আসছে। যখনই পলিসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠী বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে কিংবা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনকে চ্যালেঞ্জ মনে করেছে তখনই শাসকগোষ্ঠী স্বার্থগত প্রয়োজনে সেই ব্যক্তি বা সংগঠনের ওপর বলপ্রয়োগ করেছে, তীব্র দমন-পীড়ন চালিয়েছে। কমরেড মিঠুন চাকমা, বিপুল-সুনীল-লিটন-তপন-এল্টন-পলাশ’রাও শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন নীতি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে চ্যালেঞ্জ মনে করেছিল বলেই তারা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। যারা সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ঐক্যের পক্ষে থাকেন, নিপীড়িত জনগণের আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা বরাবরই অপ্রত্যাশিতভাবে শাসকগোষ্ঠীর বিষফোঁড়া হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর অবস্থান দিবালোকের মতই পরিস্কার। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের  আন্দোলনকে জোরদার করার জন্যে বিগত কয়েকদিন পূর্বে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। যার মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় করা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুসংহত করা। এতে নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণের লড়াকু সংগঠন হিসেবে একমাত্র ইউপিডিএফই ঐক্যের পক্ষে ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন যুগিয়েছে। ফলে তা শাসকগোষ্ঠীর বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র আন্দোলন ও ইউপিডিএফের দীর্ঘ ২৬ বছরের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যদি একীভূত হয়ে যায় তা শাসকগোষ্ঠীর মসনদে আঘাত করার জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে! এই ভয়ে শিক্ষার্থীদের ঐক্যের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠী নানা ছল-চাতুরীর পথ বেছে নিয়েছে। ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য যাতে স্থাপিত না হয় সেজন্য নিজেদের অনুগত বাহিনী দিয়ে, পোষ্য মুখোশবাহিনীদের দিয়ে কিংবা তাদের তাঁবেদার ও দোসরদের দিয়ে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে যৌথ অভিযানের বদৌলতে ইউপিডিএফ নেতাকর্মীদের হত্যা করে, গ্রেফতারের নাটক সাজিয়ে কিংবা নানাধরনের মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে ইউপিডিএফকে সংঘাতের দিকে ধাবিত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী ও তার দোসররা মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি ইউপিডিএফ এর ওপর নিত্যদিনকার দমন-পীড়নের চিত্র আরো জোরদার হচ্ছে। যা পার্বত্য জনগণের জন্যে শুভমঙ্গলজনক কোনকালেই ছিল না। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বলে দেয় কারা সেনা-শাসকগোষ্ঠীর দোসর, কারা পাহাড়ি জনগণের সামগ্রিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর সেবাদাস হয়ে থাকতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সেনা-শাসকগোষ্ঠীর চেয়েও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী রাজনৈতিক দলগুলো পাহাড়িদের ঐক্য ও বৃহত্তর আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে সব থেকে কার্যকর ও শক্তিশালী সামাজিক খুঁটি হিসেবে কাজ করছে। এদের ভূমিকার দিকে তাকালে এ নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশই আর থাকে না।

সুতরাং ঐক্য একটি মনস্তাত্ত্বিক এবং সামগ্রিক স্বার্থগত নির্ভরতার প্রতীক। কেনেডির কথার সূত্র ধরে বললে, ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে  ‘যুক্তিবাদী মানুষের প্রয়োজনীয় যুক্তিবাদী লক্ষ্য’ ঠিক করতে হবে। প্রকৃত অধিকার আদায়ের স্বার্থে রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলগুলোকে এককেন্দ্রিক সংকীর্ণ মনোভাব ও চরিত্রের পরিবর্তন করতে হবে। কারণ আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সেনা-শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা সৃষ্ট। যারা দলীয় স্বার্থ রক্ষায় সামগ্রিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়, শাসকের কূটকৌশল বাস্তবায়ন করে কিংবা জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের দ্বারা কখনো ঐক্য সম্ভব নয়। এদেরকে প্রতিহত করা ছাত্র- জনতার অবশ্যম্ভাবী কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কেননা চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীল দালালদের প্রতিহত করা মানেই শাসকগোষ্ঠীকে প্রতিহত করা। অন্যথায়, কোন গত্যন্তর নেই।

সোহেল চাকমা, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক  পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More