রাঙামাটি প্রতিনিধি ।। পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে দলটি জনগণের প্রতি এ আহ্বান জানায়।
“২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জনগণের উদ্দেশ্যে ইউপিডএফ-এর বার্তা ঐক্য গড়ে তুলুন, বিজয় অর্জনে সাহসী হোন” শিরোনামে প্রকাশিত প্রচারপত্রে বলা হয়, “নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে ছাত্র-গণ জাগরণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে এক অভূতপূর্ব ঐক্য সংহতি সূচিত হয়। শাসকগোষ্ঠী তাতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে শুরু করে নবতর চক্রান্ত। তারপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের দুই দশকে অনেক রক্ত-অশ্রুর বিনিময়ে ঐক্যের আভাস পেয়ে পাহাড়ে মুক্তিকামী জনগণ আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। আন্দোলনে একাত্মতাবোধ করছেন প্রবাসী জুম্মোরাও। এ ঐক্য শুধু নির্বাচনে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। আগামীতে অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য বর্তমান এই ঐক্যকে সংহত রূপ দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের পর যে জোটই সরকার গঠন’ করুক, পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে দাবি আদায়ের জন্য দেন-দরবারের পাশাপাশি রাজপথেও আন্দোলন করতে হবে, এটাই হচ্ছে সত্য। কাজেই বৃহত্তর আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখেই যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার”।
পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে পুরো প্রচারপত্রটি নীচে দেওয়া হলো :
২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে
জনগণের উদ্দেশ্যে ইউপিডিএফ-এর বার্তা
ঐক্য গড়ে তুলুন, বিজয় অর্জনে সাহসী হোন!
প্রিয় দেশবাসী,
মুক্তিকামী মানুষের এক অবিস্মরণীয় দিন ‘২৬ ডিসেম্বর’। ১৯৯৮ সালের এ দিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এ উপলক্ষে ইউপিডিএফ আন্দোলনের বীর শহীদদের গভীর সম্মানের সাথে স্মরণ করছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী জনতা, আন্দোলনের সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষী ও প্রবাসী ভাইদের জানায় প্রাণতেজোময় সংগ্রামী অভিবাদন।
লড়াইয়ের যাত্রাপথে অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন, অপপ্রচার, সকল ধরনের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত মোকাবেলা করে সর্বোপরি তিন শতাধিক নেতা-কর্মীর আত্মবলিদানের রক্তস্নাত পথ বেয়ে ইউপিডিএফ দৃপ্ত পদে ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাইল ফলকে এসে দাঁড়িয়েছে। চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে আগামীতে আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে পার্টি ব্যক্ত করছে দৃঢ় প্রত্যয়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক’দিন পরে সারাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৈরি হয়েছে ঐক্যের বাতাবরণ। তার অভিঘাত সুদূরপ্রবাসী জুম্মোদেরও আন্দোলিত করেছে। সকলে সাধ্যমত ভূমিকা রাখতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন, এতে আন্দোলনকামী জনগণ উজ্জীবিত। তার প্রতিক্রিয়ায় গণশত্রুরা হয়ে পড়েছে শঙ্কিত, তারা ক্ষতি সাধনের লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। মাত্র দুই দিন আগে ২৪ ডিসেম্বর এদের হামলায় পূজগাঙে ২ জন নিহত, মুনিগ্রামে ইউপিডিএফ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পরিহাসের বিষয় হলেও অস্বীকার করার জো নেই, প্রতিটি জাতির মধ্যে কিছু কুলাঙ্গার-বেঈমান থাকে। পৃথিবীতে এমন কোন আন্দোলন নেই, যে আন্দোলন বিশ্বাসঘাতক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। সমাজ বিকাশের পথে পার্বত্য চট্টগ্রামও তার ব্যতিক্রম নয়। জাতির কুলাঙ্গাররা কীভাবে অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে নস্যাৎ করতে শাসকগোষ্ঠীর ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা-ব চালাচ্ছে– সেটা আজ সবার জানা।
প্রিয় দেশবাসী,
নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে ছাত্র-গণ জাগরণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে এক অভূতপূর্ব ঐক্য সংহতি সূচিত হয়। শাসকগোষ্ঠী তাতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে শুরু করে নবতর চক্রান্ত। তারপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের দুই দশকে অনেক রক্ত-অশ্রুর বিনিময়ে ঐক্যের আভাস পেয়ে পাহাড়ে মুক্তিকামী জনগণ আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। আন্দোলনে একাত্মতাবোধ করছেন প্রবাসী জুম্মোরাও। এ ঐক্য শুধু নির্বাচনে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। আগামীতে অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য বর্তমান এই ঐক্যকে সংহত রূপ দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের পর যে জোটই সরকার গঠন করুক, পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে দাবি আদায়ের জন্য দেন-দরবারের পাশাপাশি রাজপথেও আন্দোলন করতে হবে, এটাই হচ্ছে সত্য। কাজেই বৃহত্তর আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখেই যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার।
আওয়ামীলীগ বা বিএনপি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না, চরিত্রগতভাবে তারা সে ধরনের দল নয়। এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তা আবারও জনগণের নিকট স্পষ্ট হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি মুখাপেক্ষিতা ও অতিনির্ভরশীলতার পরিণাম গুরুতর হতে বাধ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে তা বাস্তব ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত। আওয়ামীলীগের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া চরিত্রের কারণে তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তাদের কাছে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে তৎকালীন ছাত্র নেতৃত্ব (পরে ইউপিডিএফ) ভিন্নমত পোষণ করেছিল। আওয়ামীলীগকে ‘সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ আখ্যায়িত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘তিন সংসদীয় আসন’ তাদের নিকট ছেড়ে দেয়া মোটেও সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল না। তার খেসারত জেএসএস তথা গোটা পার্বত্যবাসীকে দিতে হয়েছে। এ কথা স্বীকার না করার অর্থ হবে চোখ বুঁজে দিনের আলো অস্বীকার করার মতো। সশস্ত্র পথ পরিত্যাগের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের “তিন সংসদীয় আসন”-কে গণতান্ত্রিক পন্থায় দাবি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেত, সেটাই হতো যথাযথ পদক্ষেপ। কিন্তু পরিহাসের বিষয় এই, পার্বত্য চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র টিকিটে নির্বাচিত সাংসদরা কখনও জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান নি, উল্টো জনস্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়েছেন। উদ্বেগের বিষয় আরও এই, পার্বত্য চট্টগ্রামে নীতিহীন সুবিধাবাদিতা, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে চরম ধান্দাবাজি মহামারি রূপ নিয়েছে। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র সাথে যুক্ত পাহাড়িরা সুবিধাবাদিতার সাফাই গাইতে নিজেদের “পেটলীগ” ও “পেটদল” হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধা করে না। আসলে পেটের দায়ে নয়, হীন ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে তারা জাতীয় স্বার্থ পদদলিত করে থাকে।
বর্তমানে আন্দোলনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, জেএসএস (সন্তু) আওয়ামীলীগের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে (বিগত দশম সংসদে নিজ প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতেও সক্ষম হয়েছে)। অন্যদিকে জেএসএস (সংস্কার) খোলাখুলি নির্লজ্জভাবে আওয়ামীলীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমেছে। তারা ‘মোত্তালেব বাহিনী’কে (মুখোশ) সঙ্গে নিয়ে পাহাড়িদের ওপর সশস্ত্র হামলা করছে ও হুমকি দিয়ে জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ঘৃণ্য এ কাজের কারণে তারা জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
সংগ্রামী ভাই ও বন্ধুগণ,
শাসকগোষ্ঠীর মন যুগিয়ে, আপোষ-দালালির মাধ্যমে কোন কিছু আদায় করা যায় না, তা প্রমাণিত। ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদিত হলেও বিগত একুশ বছরেও আওয়ামীলীগ তা বাস্তবায়ন না করে ঝুলিয়ে রেখেছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে “পূর্ণ বাস্তবায়নের” প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামীলীগ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ভোট চাইত, এবার তাও নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান আওয়ামীলীগের লক্ষ্য নয়, তা কারো বুঝতে বাকী নেই। অন্যদিকে বিএনপি’রও এ সংক্রান্ত কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই, তাদের কাছ থেকে তা আশাও করা যায় না। শাসকগোষ্ঠীভুক্ত দলসমূহ ভিন্ন ভাষা-ভাষী, জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না, তাদের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করে গ্রাস করতে চায়। বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ওপর “বাঙালি জাতীয়তা” আরোপ হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের কাছে আন্দোলন ভিন্ন অন্য কোন পথ খোলা নেই।
২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জনগণের উদ্দেশ্যে আহ্বান :
* আপোষ নয়, সংগ্রাম! অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন!
* ‘বাঙালি জাতীয়তা’ নয়, স্ব স্ব জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিতে অটল থাকুন!
* ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করুন!
* অন্যায় ধরপাকড় বন্ধ, মিথ্যা মামলা-হুলিয়া প্রত্যাহার, বন্দী মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হোন!
* পূর্ণস্বায়ত্তশাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান!
* লং লিভ ইউপিডিএফ!
২৬ ডিসেম্বর ২০১৮
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)
[divider style=”normal” top=”20″ bottom=”20″]
ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮
—————————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।