কল্পনা চাকমা’র অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের সাজার দাবিতে মানিকছড়িতে নারী সমাবেশ

মানিকছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০২৫
কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৯ বছর উপলক্ষে ‘চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের সাজার দাবিতে’ খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে নারী সমাবেশ করেছে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও নারী আত্মরক্ষা কমিটি।
আজ মঙ্গলবার (১০ জুন ২০২৫) সকাল ১০টায় মানিকছড়ি সদরের ধর্মঘর এলাকা থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পূনরায় ধর্মঘরে এসে শেষ হয় এবং সেখানে নারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

“সারাদেশে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত কর, পাহাড়-সমতলে নারীর অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোল” এই ব্যানার শ্লোগানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিনিধি মণিকা চাকমার সভাপতিত্বে ও পিসিপির মানিকছড়ি উপজেলা শাখার সদস্য আনু মারমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিনিধি এলিনা চাকমা ও পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সদস্য অংহ্লাচিং মারমা প্রমুখ।

সমাবেশে এলিনা চাকমা বলেন, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন দিবাগত মধ্যরাতে কল্পনা চাকমাকে নিজ বাড়ি থেকে সন্ত্রাসী কায়দায় লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, সালেহ আহমেদ ও নুরুল হক’র নেতৃত্বে অপহরণ করা হয়েছিল। সেই পর থেকে আজ পর্যন্ত তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ২৯ বছরেও কল্পনা চাকমা’র কোন হুদিস দিতে না পারা এবং চিহ্নিত অপহরণকারীদের বিচার ও শাস্তি না দিয়ে আদালতের মাধ্যমে দায়মুক্তি দেওয়া রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার। কল্পনা চাকমা’র অপহরণের ঘটনার দায় রাষ্ট্র কখনো এড়াতে পারে না।

তিনি পাহাড়ে নারীদের কোন নিরাপত্তা নেই উল্লেখ করে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানে চিংমা খেয়াং-কে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এখনো এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার হয়নি।
তিনি অবলিম্বে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, সালেহ আহমেদ নুরুল হককে গ্রেফতারপূর্বক বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানান।
অংহ্লাচিং মারমা বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরবর্তী থেকে পাহাড়ে সেনাশাসন জারি রেখে অনেক গণহত্যা সংঘটিত করা হয়েছে। এসব গণহত্যার ঘটনায় সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। এই সেনাবাহিনী ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমাকে অপহরণসহ পাহাড়িদের ওপর প্রতিনিয়ত খুন, গুম, নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে নেতৃত্ব শূন্য করতে নব্যমুখোশসহ পোষ্য সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে ইউপিডিএফের নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে।
তিনি পাহাড়ে নারী ধর্ষণের মতো ঘটনা বার বার ঘটছে উল্লেখ করে বলেন, রাষ্ট্র অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত না করার কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। কল্পনা চাকমা’র অপহরণকারীদের সাজা না দিয়ে আদালতের মাধ্যমে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের আদালত ও বিচার বিভাগের প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ৫ আগষ্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর পাহাড়ের মানুষ কিছুটা হলেও পরিবর্তনের আশা করছিল। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকারও ফ্যাসিস্টদের কায়দায় পাহাড়ে শাসনব্যবস্থা জারি রেখেছে।

অংহ্লাচিং মারমা বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও গণঅভুত্থানে পাহাড় থেকে একমাত্র ইউপিডিএফ সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সরকার ইউপিডিএফের ওপর অন্যায়ভাবে দমন-পীড়ন জারি রেখেছে। অন্যদিকে জেএসএস নেতা উষাতন তালুকদার ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাথে সুর মিলিয়ে জুলাই-আগস্টে হাসিনা পতন আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকার বলেছিলেন। এই হাসিনা দোসরদের বিরুদ্ধে সরকার এখনো কোন পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো তাদেরকে আঞ্চলিক পরিষদে বহাল রেখে ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় বৈঠকে ইউপিডিএফকে বাদ দেয়া হয়েছে, যা পাহাড়ি জনগণের সাথে বৈষম্য ছাড়া কিছুই নয়। এতেই প্রমাণ হয় অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকারগুলোর মতো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও পাহাড়িদের অধিকার বঞ্চিত রেখে নিপীড়ন-নির্যাতন জারি রাখতে চাচ্ছে। তাই ছাত্র সমাজকে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি ইউপিডিএফের সাথে আলোচনা মাধ্যমে পাহাড়ের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্য মণিকা চাকমা বলেন, কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে পাহাড়ে নারীদের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল রাষ্ট্র। কিন্তু পাহাড়ের নারীরা কল্পনার উত্তরসূরী হিসেবে তাঁর নীতি-আদর্শ ধারণ করে আন্দোলন জারি রেখেছে। অধিকার প্রতিষ্ঠা জন্য রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে করছে।
তিনি বলেন, কল্পনা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পাহাড়ের অধিকারহারা, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে একজন অকুতোভয় নেত্রী ছিলেন। তাই কল্পনা চাকমার নীতি-আদর্শ কখনো মুছে যাবে না। রাষ্ট্র তাঁর হদিস দিতে না পারা পর্যন্ত পাহাড়ের নারী সমাজ তাঁর সন্ধানের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাবে। তিনি নারী সমাজকে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সমাবেশ থেকে মণিকা চাকমা অবিলম্বে কল্পনা চাকমা’র অপহরণকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, পাহাড় ও সমতলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।