কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭ বছর উপলক্ষে বাঘাইছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ
বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ১২ জুন ২০২৩

কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭ বছর উপলক্ষে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখা।
আজ সোমবার (১২ জুন ২০২৩) সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৪৫০ জন নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।
“যে জাতিতে বোন উদ্ধারে ভাইরা আত্মাহুতি দেয়, সেই জাতিকে দমিয়ে রাখা যাবে না” শ্লোগানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের বাঘাইছড়ি উপজেলার সভাপতি অমিতা চাকমা।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি অবনিকা চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর রাঙামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক তনুময় চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ক্যামরন দেওয়ান ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য দয়াসোনা চাকমা।

সমাবেশে প্রারম্ভিক বক্তব্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য দয়াসোনা চাকমা বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৭ ঘন্টা আগে মধ্যরাতে বাঘাইছড়ির কজইছড়ি ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনা কমাণ্ডার লে. ফেরদৌস গংরা সংগঠনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে। আজ ২৭ বছর পূর্ণ হলেও সরকার তার কোনো হদিস এখনও দিতে পারেনি। বরঞ্চ কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারীদের শাস্তি না দিয়ে এ ঘটনাটিকে প্রপাগান্ডা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে অপহরণকারীদের রক্ষা করে চলেছে এবং কল্পনার ভাইদেরকেও নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা তুলে ধরে বলেন, দীর্ঘ ২৭ বছরেও এ দেশের আদালত কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার বিচার করতে পারেনি। কল্পনা অপহরণ মামলায় ২৭ বছরে ৩৯ জন কর্মকর্তা বদলী হলেও কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তিনি রাষ্ট্র ও প্রশাসনের গাফিলতি ও অনীহার কারণে বিচার হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, কল্পনা চাকমাকে অপহরণের প্রতিবাদে ও তাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের দাবিতে রাজপথ অবরোধ করতে গিয়ে সেটলার বাঙালিদের দ্বারা খুন ও গুমের শিকার হয়েছিলেন রূপন, সমর, সুকেশ ও মনোতোষ চাকমা। তারা নিজেদের বোনকে উদ্ধারের দাবি করতে গিয়ে আত্মবলিদান দিয়েছেন। তাদের এ আত্মবলিদান কখনো বৃথা যাবে না।
পিসিপি’র জেলা শাখার সভাপতি তনুময় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সরকার এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফৌজি শাসনের ফলে প্রতিনিয়ত নারী ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, খুন গুম, অপহরণ বিচার বহির্ভূত হত্যা চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন ঠ্যাঙারে বাহিনী দিয়ে বান্দরবানে বম জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু থেকে আরো করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী বিভিন্ন ভূইফোঁড় গ্রুপ সৃষ্টি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
তিনি আরো আন্দোলন জোরদার করার আহবান জানিয়ে বলেন, কল্পনা চাকমার সন্ধান করতে গিয়ে স্কুল ছাত্র রুপন চাকমা আত্মবলিদান দিয়েছেন, সমর-সুকেশ-মনোতোষ গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের এই অবদান আমরা কোনোদিন ভুলব না। যতই খুন, অপহরণ, দমন-পীড়ন চালানো হোক না কেন পাহাড়ি জনগণকে কিছুতেই দমিয়ে রাখাক যাবে না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং সমাবেশে উপস্থিত সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানান।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলার সভাপতি ক্যামরণ দেওয়ান বলেন, বাংলাদেশে ভিন্ন ভাষাভাষী জাগিতগত সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করার নানা চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিলীন করে দেওয়ার জন্য ভূমি আগ্রাসন এবং নারীদের ওপর নিপীড়ন জারি রাখা হয়েছে। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী ধর্ষণ ও ভূমি বেদখল এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গত ১ জুন খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়নের লাইফু কার্বারি পাড়ায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি জুমচাষীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা, এর আগে মাইসছড়ি ইউনিয়নে ৪টি পাহাড়ি ঘর ভাঙচুর ও গতবছরে একই ইউনিয়নে সেটলার কর্তৃক ৩৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা এবং বান্দরবানে লামায় ম্রো-ত্রিপুরাদের ৪০০ একর জুম ভূমি বেদখল চেষ্টার ঘটনা তাই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তিনি অবিলম্বে ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতনসহ সকল ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়নের অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে সংগ্রামী নারী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। ২৭ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের গ্রেফতার, বিচার ও সাজা দেওয়া হয়নি। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত পাহাড়ি নারীর ওপর ধর্ষণ, নিপীড়নের কোন ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। অপরদিকে ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় সংঘটিত তনু হত্যার বিচারও আজো হয়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্ষক, নিপীড়ক, অপহরণকারীরা ক্ষমতাবান হওয়ায় অপহরণের মতো নিকৃষ্ট ঘটনার কোনো বিচার হচ্ছে না।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে মতলববাজিদের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, ১২ জুন এলে অনেকে নামে বেনামে ভুইফোঁড় সংগঠনের নাম দিয়ে লোকদেখানো নানা কমর্সূচি পালন করে থাকেন। অথচ তারা কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাটিকে বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। মূলত কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাকে পুঁজি করে এরা সংগ্রামী সেজে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি এভাবে আন্দোলনে পানি না ঢেলে কল্পনা চাকমার সঠিক নীতি আদর্শের প্রতিবাদী ধারাকে তুলে ধরার আহ্বান জানান।
নীতি চাকমা পাহাড়ের সকল প্রকার অন্যায় দমন-পীড়ন বন্ধ করার ও কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে.ফেরদৌস গঙদের বিচার ও সাজা নিশ্চিত করতে ‘নতুন সংবিধান’ ও ‘জনগণের সরকার’ গঠনের দাবি জানান।

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি অমিতা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতন-ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, খুন, অপহরণ প্রতিনিয়ত চলছে। এসব অপকর্মকাণ্ডের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীই কোনো না কোনো জড়িত। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ।
তিনি আর কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের আইনের আওতায় এনে বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রদান এবং পাহাড়ে নারী নির্যাতন, খুন, গুম, অপহরণসহ সকল অন্যায় কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানান।
সমাবেশের পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন