কল্পনা চাকমা অপহরণ: বিচারহীনতার ২০ বছর

নিজস্ব প্রতিনিধি।। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশ-বিদেশে আলোচিত ও প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল যে ঘটনা, সেটি হচ্ছে হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামে সেনা কর্মকর্তা লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের দ্বারা এ অপহরণ ঘটনা সংঘটিত হয়।
আজ ১২ জুন এ অপহরণ ঘটনার ২০ বছর পুর্ণ হলো। কিন্তু রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার সন্ধান আজও দিতে পারেনি। উপরন্তু বরাবরই এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০ বছরেও এ ঘটনার কোন বিচার হলো না। বিচারের বাণী যেন নিভৃতেই কাঁদে!
একজন অসহায় নারীকে অস্ত্রের মুখে নিজ বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে অপহরণ করা হলো, অথচ রাষ্ট্র ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার না করে নানা টালবাহানা করেই চলেছে। এদিকে কল্পনার ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা সুষ্ঠু বিচারের আশায় আজো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কল্পনাকে ফিরে পাবার আশায় অপেক্ষা করতে করতে তাঁর মা বাধুনি চাকমা সেই কবে মারা গেছেন। প্রতি বছর ১২ জুন এলে তার সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রতিবাদে সরব হয়। কিন্তু কল্পনার কোন হদিস মেলে না।
অন্যদিকে লে. ফেরদৌস? সে তো এখন মেজর পদে অধিষ্ঠিত! কল্পনা চাকমাকে অপহরণের অভিযোগ উঠার পর পরই তার প্রমোশন হয়। বীরদর্পে সে এখনো সেনাবাহিনীর চাকুরি করে যাচ্ছে। তার কোন বিচার হলো না। তাহলে কি প্রমাণ হয়? এর মাধ্যমে এটাই প্র্রমাণ হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী কোন অপরাধ করলেও তার কোন শাস্তি হয় না, বরং পুরষ্কৃত করা হয়। লে. ফেরদৌসের বেলায় ঠিক তাই-ই হয়েছে। নাহলে একজন অপহরণকারীর বিচার-শাস্তি না হয়ে পদোন্নতি হয় কি করে?
কল্পনা চাকমা অপহরণের সাক্ষী তার দুই ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমা। তাঁরা অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে চিনতে পেরেছিলেন। অপহরণ ঘটনার পর কালিন্দী কুমার চাকমা লে. ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে আসামি করে বাঘাইছড়ি থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে অভিযুক্তদের নাম বাদ দিয়ে মামলা রুজু করে।
মামলা করার প্রায় সাড়ে চৌদ্দ বছর পর ২১ মে ২০১০ তারিখে বাঘাইছড়ি থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই ফারুক প্রথম চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা এ প্রতিবেদনের ওপর নারাজী দিলে বিজ্ঞ আদালত ০২/০৯/২০১০ তারিখে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। এরপর সিআইডি’র তদন্ত কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ দুইবছর তদন্ত করে চিহ্নিত অপহরণকারীদের নাম বাদ দিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সিআইডি’র তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর বাদী নারাজী দিলে বিজ্ঞ আদালত ১৬ জানুয়ারি ২০১৩ আরও অধিকতর তদন্তের জন্য রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। গত ২০ জুলাই ২০১৪ পুলিশ সুপার আমেনা বেগম তদন্ত অগ্রগতির প্রতিবেদন দাখিল করে বলেন যে “বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশ মতে লেঃ ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও ছালেহ আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দির আলোকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। ঘটনার ১৮ বছর পরে ভিকটিমের চেহারায় অনেক পরিবর্তন হতে পারে। তাই অদূর ভবিষ্যতে তাকে উদ্ধার করা হলেও চেহারা দেখে শনাক্ত করা নাও যেতে পারে। কল্পনার ভাইয়েরা বৃদ্ধ বিধায় ভিকটিমকে উদ্ধার করা হলে তাকে চিহ্নিত করার জন্য তার ভাইদের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য আদালতের নির্দেশপ্রাপ্ত হলেও মামলার বাদী ও তার ভাই লাল বিহারী চাকমা ডিএনএ সংরক্ষণের জন্য আগ্রহী নয় বিধায় তা সংগ্রহ করা হয়নি। যেহেতু এই মামলার মূল সাক্ষী ভিকটিম কল্পনা চাকমা নিজেই, তাই উক্ত কল্পনা চাকমা উদ্ধার না হওয়া কিংবা তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
বাদীর পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদন নাখোশ করা হলে ২৭ মে ২০১৫ রাঙামাটি জেলা জজ আদালতের বিচারিক হাকিম মোহসিনুল হক আবারো অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু মামলাটির তদন্ত সম্পন্ন না হয়ে আমেনা বেগম অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে নতুন দায়িত্ব পান বর্তমান পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান। তিনিও এখনো পর্যন্ত কোন তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেননি।
মোট কথা, কল্পনা চাকমা’র চিহ্নিত অপহরণকারীদের রক্ষায় ২০ বছর ধরে রাষ্ট্র নিজেই নানা টালবাহানা করে যাচ্ছে। কখনো তদন্তের নামে, কখনো ডিএনএ টেস্টের নামে এ টালবাহানা চলছেই। এ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে রাষ্ট্রই সরাসরি এ অপহরণ ঘটনার সাথে যুক্ত । না হলে ২০ বছরেও কেন বিচার হবে না? তাই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই রাষ্ট্রে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার ন্যায়-বিচার হবে তো?
——————
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।