।। এস এল ত্রিপুরা ।।
১৯৫৯ সালে স্বৈরাচারী ফুলগেনসিও বাতিস্তা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কিউবায় ফিদেল কাস্ট্রোর নেতৃত্বে বিপ্লব সফল হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, কাস্ট্রোর গঠিত ‘মুভমেন্ট জুলাই ২৬’ নামের গেরিলা বাহিনী ছাড়াও অন্তত: আরো তিনটি গেরিলা দলের অস্তিত্ব ছিল – যেমন রেভ্যুলুশনারী ন্যাশন্যাল এ্যকশন, রেভ্যুলুশনারী ডিরেক্টরেট ও সেকেন্ড ফ্রন্ট এবং তারাও সাধারণ শত্রু বাতিস্তার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশ্য পরে বেভ্যুলুশনারী ন্যাশন্যাল এ্যকশন ফিদেল কাস্ট্রোর ‘মুভমেন্ট জুলাই ২৬’-এর সাথে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। আলাদা হলেও এইসব গেরিলা দলগুলোর নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপাড়া ছিল।

[divider style=”normal” top=”20″ bottom=”20″]
১৯৫৬ সালের ১লা জানুয়ারী বাতিস্তা রাজধানী হাভানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফিদেল কাস্ট্রো তখন হাভানা থেকে ৫৫০ মাইল দূরে, দ্বীপ রাষ্ট্রটির একেবারে অন্য প্রান্তে। অপরদিকে ক্ষমতার লড়াইয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অর্থাৎ সেনাবাহিনীর নেতৃস্থানীয় কমান্ডারগণ ও অন্যান্য গেরিলা দলগুলো এর সুযোগে দ্রুত হাভানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কাস্ট্রো বুঝতে পারলেন যে রাজধানীতে পৌঁছানোর দৌঁড়ে তিনি অন্যদের কাছে হেরে যাবেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে তার এই অবস্থানগত দুর্বলতাকে একটি শক্তিতে পরিণত করেন এবং রাজধানীর উদ্দেশ্যে আট দিন ব্যাপী দীর্ঘ ভিক্টরী প্যারেড বা কারাভান (caravana) অনুষ্ঠিত করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল তার দলকেই ক্ষমতায় নিয়ে আসা।
জেনারেল বাতিস্তা প্রথমদিকে ১৯৪০-এর দশকে একজন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রগতিশীল প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে তিনি এক সামরিক ক্যুদেতার মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। এরপর তিনি নির্বাচন বাতিল করে দেন, ভিন্নমতাবলম্বীদের কঠোর হাতে দমন করেন এবং আমেরিকার মাফিয়া সাম্রাজ্যের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। বিরোধীরা নির্বাচনী রাজনীতির পথ বন্ধ হলে সহিংস যুদ্ধের পথ বেচে নিতে বাধ্য হন।

[divider style=”normal” top=”20″ bottom=”20″]
কাস্ট্রো ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই সান্টিয়াগোতে অবস্থিত মনকাডা ব্যারাক আক্রমনের মধ্য দিয়ে তার বিপ্লবী কার্যক্রমের সূচনা করেন। এই আক্রমন ব্যর্থ হয় এবং তিনি গ্রেফতার হন। পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি মেক্সিকো চলে যান এবং সেখানে নতুন করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে তার গড়া সাদামাটা গেরিলা দলটি কিউবার সিয়েরা মায়েস্ট্রায় ঘাঁটি গড়ে তোলে। ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মে বাতিস্তা কাস্ট্রো বাহিনীর বিরুদ্ধে এক ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু উৎকৃষ্ট সামরিক শক্তি সত্বেও সরকারী বাহিনী গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং গেরিলাদের প্রতি-আক্রমনে পর্যুদস্ত হয়। এম-২৬ (কাস্ট্রো বাহিনী) এর ফলে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়। গেরিলারা যখন মধ্য কিউবায় গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে তখন বাতিস্তা ডমিনিকান রিপাবলিকে পালিয়ে যান। এতে রাজধানীতে ক্ষমতার শুন্যতা সৃষ্টি হয়, আর এই শুন্যতা পূরণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী গেরিলা দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগীতা চলে এবং শেষ পর্যন্ত নিজের দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলী পরিচালনার জন্য কাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন বাহিনীই জয়ী হয়।
কাস্ট্রোর কারাভান বা কাফেলা শুরু হয় ১লা জানুয়ারি সান্টিয়াগোতে দুই লক্ষ লোকের সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু অন্য দুটি গেরিলা দল সেকেন্ড ফ্রন্ট ও রেভ্যুলুশনারী ডিরেক্টরেট যোদ্ধারাই প্রথম হাভানা পৌঁছান। এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াও কাস্ট্রোর মাথা ব্যথার কারণ ছিলেন আরও একজন। তার নাম র্যামন বারকুইন (Ramon Barquin)। তিনি ছিলেন একজন কর্ণেল এবং ১৯৫৬ সালে বাতিস্তার বিরুদ্ধে ক্যু প্রচেষ্টার দায়ে কারাবন্দী হন। বাতিস্তার পতনের পর মুক্ত হলে তিনি বাতিস্তার নিযুক্ত উত্তরাধীকারীকে উৎখাত করেন এবং হাভানায় দেশের সবচেয়ে বড় গ্যারিসন ক্যাম্প কলাম্বিয়ার দখল নেন। কাস্ট্রো বাহিনীর জন্য তিনিও ছিলেন এক বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।

[divider style=”normal” top=”20″ bottom=”20″]
চে গুয়েভারা ও চিয়েনফুয়েগোর বাহিনীগুলোকে কাস্ট্রো হাভানায় পাঠিয়ে দেন এবং নিজেও রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কাঁধে একটি M-2 রাইফেল ঝুলিয়ে খোলা জিপে চড়ে তিনি সান্টিয়াগো থেকে যাত্রা শুরু করেন। দীর্ঘ পথে তিনি গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে যাত্রাবিরতি করেন এবং সমবেত উৎফুল্ল জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। এভাবে তিনি কিউবার জনগণের হৃদয় মন জয় করে নেন।
কাস্ট্রো তার পরিকল্পনাকে সাফল্যমণ্ডিত করতে মূল মহাসড়ক থেকে ঘোরা পথে দক্ষিণাঞ্চলের শহর চিয়েনফুগোস যান সেখানে নৌ সেনাদের প্রতি সম্মান জানাতে। কারণ ১৯৫৭ সালে এখানে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ নৌ ঘাঁটিতে নৌ বাহিনীর সদস্যরা বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। বিপ্লবের সময় সেকেন্ড ফ্রন্ট গেরিলারা এই শহরটি দখল করে নিয়েছিল। অপরদিকে কাস্ট্রোর এম-২৬ গেরিলারা কিউবার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্যারিসন, কারাগার, বন্দর ও বিমান বন্দর দখল করলেও চিয়েনফুগোস শহরে ছিল তারা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তাই তার কাফেলাকে সেদিকে নিয়ে যাওয়া ছিল একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত।
এরপর তিনি আরও একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেন। তার কারাভানের শেষ সকালে তিনি রেভ্যুলুশনারী ডিরেক্টরেটের প্রয়াত নেতা জোসে এন্তোনিও ইচিভেরিয়ার পরিবারের সাথে দেখা করতে কার্ডেনাসে যাত্রাবিরতি করেন। এক সময় কাস্ট্রো তাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে গালাগাল করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার ক্রন্দনরত মাকে জড়িয়ে ধরেন এবং তার বোনকে অনুরোধ করেন তিনি যেন ইচিভেরিয়ার উত্তরাধিকারীদের সাথে তার দলের মধ্যস্থতা করে দেন।

[divider style=”normal” top=”20″ bottom=”20″]
বিপ্লবী দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে প্রথমে ম্যানুয়েল উরুতিয়া নামের এক উদারপন্থী বিচারপতিকে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইতিপূর্বে বিপ্লব-পূর্ব সময়কার এক চুক্তিতে ফিদেল কাস্ট্রোকে সামরিক বাহিনীগুলোর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।
বাতিস্তার পতনের পর গেরিলা দলগুলোর মধ্যে সেকেন্ড ফ্রন্ট প্রথম রাজধানী হাভানায় ঢুকতে সক্ষম হলেও তারা সেনাবাহিনীর স্থাপনা ও সরকারী বিল্ডিংগুলো দখলে নেয়নি। এটা না করার কারণ তাদের আনাড়ীপনা কিংবা আদর্শবাদীতা (idealism) হতে পারে। তাদের নেতা ইলয় গুটিয়েরেজ মেনোয়ো মনে করেছিলেন বিপ্লবের বিরুদ্ধে আবার সামরিক ক্যু হতে পারে। তাই তিনি রাজধানীর রাস্তাঘাট পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
অপরদিকে রেভ্যুলুশনারী ডিরেক্টরেট-এর ভাবনা ছিল অন্যরকম। এর গেরিলারা সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র অধিকার করে ইউনিভার্সিটিতে জমা করে রাখে এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখলে নেয়। কিন্তু কাস্ট্রো বাহিনীর সুবিধা হলো, বিপ্লব সকল হওয়ার আগে গেরিলা দলগুলোর মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তিতে তাকে যুদ্ধের পর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পণ।
হাভানা পৌঁছার পরপরই কাস্ট্রো তার বাহিনী M-26 কে গ্যারিসনগুলো দখলে নেয়ার নির্দেশ দেন। চে গুয়েভারা উপনিবেশিক আমলে নির্মিত দুর্গটির দখল নেন। অন্য দিকে ক্যামিলো চিয়েনফুয়েগোস ক্যাম্প কলাম্বিয়ায় যান বারকুইন-এর সাথে আলোচনা করে তার দখল নেয়ার জন্য। বারকুইন বুঝতে পারেন যে বিপ্লবী গেরিলাদের জনপ্রিয়তা তার তুলনায় বহুগুন বেশী এবং একের পর এক পরাজয়ের পর সেনাবাহিনীর মনোবলও কমে গেছে। তাই তিনি বিনা যুদ্ধে কাস্ট্রো বাহিনীর হাতে কিউবার সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ সেনানিবাসটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দেন।
কাস্ট্রোর কাফেলার খবর নিয়মিত টেলিভিশনে প্রচার করা হচ্ছিল। এভাবে হাভানাবাসী কাস্ট্রোর আগমন সম্পর্কে জানতে পারে এবং তার বাহিনীর অপেক্ষায় থাকে। যখন তারা সত্যিই হাভানা পৌঁছায় তখন রাস্তায় উৎফুল্ল জনতার ঢল নামে। গেরিলা-জনতা মিলে একাকার হয়ে যায়। ভিখারী, মুচি এবং ছেড়া-নোংরা জামা-পরা শিশু থেকে শুরু করে সবাই শহরের রাস্তায় নেমে এসে গেরিলাদের হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। সাইরেন, হর্ন, হুইশেল, গীর্জার ধ্বনি এবং কামানের গোলার আওয়াজ ছাপিয়ে তখন শোনা যায় Viva La revolucion.
প্রেসিডেন্ট উরুতিয়া রাস্ট্রপ্রধান ছিলেন। তবে কারাভানই (কাকেলা) দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃত অর্থে কারা কিউবাকে পরিচালনা করছিল। অন্যদের চাইতে কাস্ট্রোই দেশটাকে ভালো করে জানতেন। অবস্থানগতভাবে অসুবিধাজনক অবস্থায় থেকেও তিনি সুযোগ সৃষ্টি করে নেন এবং দক্ষতার সাথে তার দলকে বিজয়ের শীর্ষে নিয়ে যান।
কাস্ট্রো সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তার বাহিনীর সদস্যদের বাদে অন্যদের অস্ত্র সমর্পনের নির্দেশ দেন। কৌশলে ধরাশায়ী হয়ে রেভ্যুলুশনারী ডিরেক্টরেট-এর গেরিলারা অস্ত্র ত্যাগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলো ছেড়ে দেন এবং সরকারে যোগ দেন। অন্যদিকে সেকেন্ড ফ্রন্টের গেরিলা সদস্যরা সেনাধ্যক্ষের অধীনে সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন পদে চাকুরী নেন। এভাবে ফিদেল কাস্ট্রোর নেতৃত্বে তার বাহিনী সুদক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে বিপ্লব সফল করে নিজেদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে।
(The Daily Star এর ১৪ জানুয়ারী ২০১৯ সংখ্যায় Fidel Castro’s March to Victory শিরোনামে প্রকাশিত Daniel Rey-এর নিবন্ধ অবলম্বনে।)
——————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।