খাগড়াছড়ি : সেনা-পুলিশের হামলার জবাবে ব্যাপক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্য দিয়ে আজ ৭ মার্চ ২০১৮ মুখোশ বাহিনী প্রতিরোধ দিবস পালন করেছে তিন লড়াকু সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি), গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন(এইচডব্লিউএফ) খাগড়াছড়ি জেলা শাখা।
তিন সংগঠনের এই কর্মসূচি বানচাল করে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী নানা টালবাহানা শুরু করে। সকাল থেকেই খাগড়াছড়ি শহর ও শহরের বাইরে বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী চেকপোষ্ট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি করে এবং খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয় সেনারা। এ পরিস্থিতির মধ্যেও বিভিন্নভাবে নেতা-কর্মী-সমর্থরা স্বনির্ভরে এসে জড়ো হন।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৭টায় উত্তর খবংপুয্যায় শহীদ অমর বিকাশ চাকমার স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক এলটন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামে খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পলাশ চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রেশমি মারমাসহ তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। তারা এক মিনিট নিরবতা পালনের মাধ্যমে শহীদ অমর বিকাশসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আত্মবলিদানকারী সকল শহীদদের প্রতি সম্মান জানান। এ সময় নেতৃবৃন্দ সমবেতদের উদ্দেশ্যে ’৯৬ সালের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শহীদ অমর বিকাশ থেকে প্রেরণা নিয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আত্মবলিদানের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
এরপর তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আয়োজিত সমাবেশের জন্য স্বনির্ভরে ইউপিডিএফ-এর কার্যালয়ে এসে অবস্থান নেন।
সকাল ১০টার দিকে বদলে যায় দৃশ্যপট। এ সময় খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে নেমপ্লেটহীন জনৈক এক মেজরের নেতৃত্বে তিন পিক-আপ সেনা সদস্য দক্ষিণ খবংপুজ্জে দিক থেকে ইউপিডিএফ কার্যালয়ে তেড়ে আসে এবং তিন সংগঠনের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সেখান থেকে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। উপস্থিত নেতা-কর্মীরা এর প্রতিবাদ জানালে এক পর্যায়ে সেনারা গাড়ি থেকে নেমে অতর্কিতে হামলা শুরু করে। এতে সেখানে অবস্থানরত নারীরা বাধা দিলে সেনারা তাদেরকে ধাক্কা দেয় ও টানা হেঁচড়া করার চেষ্টা করে। পরে তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং তাদেরকে সেখান থেকে ধাওয়া করে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের চৌরাস্তার মোড় পর্যন্ত নিয়ে যায়। এরপর স্বনির্ভর বাজার পুলিশ পোষ্ট থেকে খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি হান্নানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সদস্য এসে সেনাবাহিনীর সাথে হামলায় যোগ দেয়। সেনারা আর সামনে অগ্রসর হয়নি। পুলিশ নেতা-কর্মীদের উপর টিয়ার সেল-রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে নেতা-কর্মীরা আরো বেশি উত্তোজিত হয়ে উঠে এবং শ্লোগান শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে। কোন কিছুতেই তারা দমে যায়নি। এ সময় পুলিশের সাথে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের থেমে থেমে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার সেল ও রাবার বুলেট-নিক্ষেপ করে। এতে তিন সংগঠনের ৮-১০ জন নেতা-কর্মী আহত হন।
এদিকে, উক্ত খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে উত্তর খবংপুয্যা, নারাঙহিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-যুবক-নারীসহ শত শত জনতা তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগ দিয়ে প্রতিরোধব্যুহ রচনা করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা র্যারিকেড সৃষ্টি করে পুলিশের সাথে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে শান্ত করতে খাগড়াছড়ি জেলা এএসপি সালাহ উদ্দীন, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ওসি তারেক মাহাম্মুদ হান্নানসহ পুলিশের কর্মাকর্তারা সেখানে এসে কথা বলতে চাইলে উপস্থিত ছাত্র- জনতা বিনাপ্ররোচনায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধাপ্রদান ও হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। এতে টান টান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পরে প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তাগণ শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সেখানে উপস্থিত জনতাকে নিয়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর অন্যতম সংগঠক দেবদন্ত ত্রিপুরা, পিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পলাশ চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রেশমি মারমা প্রমুখ।।
ইউপিডিএফ নেতা দেবদন্ত ত্রিপুরা বলেন, শহীদ অমর বিকাশ চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনে সাহসীকতার একটি ঠিকানা। প্রতিবাদী অন্যায় অত্যাচারে বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের একটি প্রেরণা ও একটি চেতনার প্রতীক। ১৯৯৬ সালে ৭ মার্চ তৎকালীন সেনাবাহিনী সৃষ্ট মুখোশ বাহিনী প্রতিরোধ করতে গেলে সেনাবাহিনী গুলিতে তিনি শহীদ হন। তুমুল আন্দলনের ফলে এবং শহীদ অমর বিকাশ চাকমার আত্মবলিদানের কারণে মুখোশ বাহিনী উৎখাত হয়েছিল। খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র-যুব-নারী ও সর্বত্র জনগণ তীব্র আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল।
তিনি, সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সকল ধরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সকল সহযোগী সংগঠন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে বেগবান করতে আহ্বান জানান তিনি।
রেশমি মারমা বলেন, সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনী স্বৈরাচারী কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের উপর শাসন-শোষণ-নির্যাতন করে আসছে। আজকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে স্বৈরাচারী কায়দায় সেনাবাহিনী সদস্যরা তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে। তিনি পাহাড়ি জনগণের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
তপন চাকমা বলেন, ’৯৬ সালে মুখোশ বাহিনী প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ অমর বিকাশ চাকমা রক্ত দিয়েছেন। এবারেও নব্য মুখোশ বাহিনী প্রতিরোধের জন্য শত শত ছাত্র-যুব-জনতা রক্ত দিতে প্রস্তুত আছি। আমরা রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ অমর বিকাশ চাকমার উত্তরসূরী হতে চাই। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠান জন্য আমরা রাজপথে আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত।
তিনি, সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেয়ার উদ্দেশ্য সেনা-পুলিশের বর্বর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে হামলকারী সেনা-পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রদানে জন্য আহ্বান জানান।
এছাড়া সন্ধ্যায় শহীদ অমর বিকাশ চাকমার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।
আরও পড়ুন:
>> খাগড়াছড়িতে সেনা-পুলিশী হামলার জবাবে প্রতিবাদ প্রতিরোধের খন্ড চিত্র
>>খাগড়াছড়িতে হামলাকারী সেনা-পুলিশের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ
>>খাগড়াছড়িতে তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর সেনা-পুলিশের হামলা
>>সংগ্রামের দৃপ্ত শপথে শহীদ অমর বিকাশ চাকমার স্মৃতিস্তম্ভে তিন সংগঠনের পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ
—————-
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্রউল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।