খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটিনিউজ.কম
খাগড়াছড়ির ৯টি থানার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে তামাকচুল্লি। বেশী লাভের আশায় খাগড়াছড়ি সদর, মাটিরাংগা, দীঘিনালা, পানছড়ি, মানিকছড়ি, মহালছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, রামগড় ও গুইমারা থানার সমতল ধান্যজমি ও চাষযোগ্য এলাকার বেশীর ভাগ টোব্যাকো কোম্পানীর প্রলোভন দ্বারা সৃষ্ট এ ভয়াবহ পরিবেশ নষ্টের তামাকচাষ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এক তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এসব তামাকচুল্লি তৈরী ও তামাক শুকানো কাজে প্রতিবছর অন্ততঃ এক লাখ মন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। তামাকচুল্লি নিয়ন্ত্রনে কোনো আইন না থাকায় এসব তামাকচুল্লি তৈরি ও কাঠ পোড়ানোর কাজে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে ।
জেলায় তামাক চাষ হয় এমন সব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তামাক শুকানোর জন্য অনেকের বসতভিটার পাশে তামাকচুল্লি নির্মান করা হয়েছে। এসব চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে প্রচুর পরিমান কাঠ। তামাকের ক্ষতিকর ধোঁয়া ও দুর্গন্ধের মধ্যে তামাক শুকানো কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্য বা এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা । খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় বিচিতলার বাঙালী পাড়া, গামারিঢালা, মাটিরাংগা উপজেলার গোমতির গড়গড়িয়া, বেলছড়ির অযোধ্যাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে শতাধিক তামাকচুল্লি। এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি জেলা সদরের বিচিতলা এলাকার বাঙালী পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, বসতভিটার কাছেই তৈরি হয়েছে তামাকচুল্লি। প্রতিটি তামাকচুল্লি তৈরিতে অন্ততঃ ২০ফুট দৈর্ঘের ২৭টি গাছ ব্যবহার করা হয়েছে। মুলিবাশ(বাজ্যা বাশ) ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ৩’শ উপরে। প্রতিটি চুল্লিতে তামাক শুকাতে প্রতিবার ৫ থেকে ৬০মন কাঠ জ্বালানী হিসেবে পোড়ানো হয় বলে জানিয়েছেন তামাক চুল্লি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মাটিরাংগার বেলছড়ির অযোধ্যা এলাকায় গিয়ে ও একই দৃশ্য দেখা গেছে।
গোমতি গড়গড়িয়ায় বসতবাড়ি ঘেষে বসানো হয়েছে পাশাপাশি ৪টি তামাকচুল্লি। এ গ্রামে রয়েছে অন্ততঃ ১০টি তামাকচুল্লি। বিস্তীর্ন এলাকায় তাকালেই চোখে পড়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী তামাকচুল্লি। বিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। মোঃ ফারুক হোসেন ও মোঃ জহির নামের দুই তামাক চাষী আলাদাভাবে ৪টি তামাকচুল্লি তৈরী করেছেন। প্রতিটি তামাকচুল্লিতে ১৩/১৫জন করে নিত্যদিন নিয়োজিত আছেন। মোঃ ফারুক হোসেনের তামাকচুল্লিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে ১২বছরের এক শিশু। তিনি পারিশ্রমিক বাবদ দৈনিক ১০০টাকার বেতনে কাজ করে শিশু শ্রমিক শাহীন আলম। সে মধ্য গড়গড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়া ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্র বলে জানায় পিতৃহীন শিশু শ্রমিক শাহীন আলম।
অযোধ্যার একটি চুল্লির মালিক কৃষক সাইদ আনোয়ার বলেন, প্রতিটি চুল্লিতে দুই থেকে আড়াই হেক্টর জমির উৎপাদিত তামাক শুকানো হয়। একটি চুল্লির মাত্র ৬/৭বছর পর্যন্ত টিকে থাকে । প্রায় সব চুল্লির মালিকরাই অজ পাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন বাগান থেকে গাছ কিনে সেখানে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেন।
একাধিক তামাক চাষীর সাথে কথা হলে তারা জানান, তামাক চাষ ক্ষতিকর জানা সত্বেও প্রচুর আর্থিক লাভের নিশ্চয়তা থাকায় তারা তামাক চাষকে বেছে নিয়ে নিরাপদ মনে করেন। তামাকের বীজ থেকে শুরু করে বীজতলা সংরক্ষনের প্রয়োজনীয় পলিথিন বিনা মূল্যে তামাক কোম্পানী থেকে পাওয়া যায়। এ ছাড়া টোবাকো কোম্পানীর কাছ থেকে বাকিতে সার-ঔষধ এবং প্রতি হেক্টর তামাক চাষের জন্য ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যায়, যা অন্য কোনো পন্যের ক্ষেত্রে পাওয়া যায না। জমি ছাড়া নিজের কোন পুজি প্রয়োজন হয় তামাক চাষে এমন কথাও বললেন চাষীরা।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের তথ্য মতে, এ বছর খাগড়াছড়ির ৮উপজেলায় ১হাজার ৩০হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। প্রতি আড়াই হেক্টর জমির বিপরীতে একটি হিসেবে জেলায় তামাকচুল্লি রয়েছে ৪১২টি। এসব চুল্লি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে কমপক্ষে ১১হাজার বিভিন্ন রকমের গাছ। আর সে হিসেবে প্রতিবছর এক লাখ মনেরও বেশি জা¦লানি কাঠ এসব চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে তামাক শুকানো কাজে।
খাগড়াছড়িতে পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা সুষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা জাবারাং কল্যান সমিতি। সমিতির প্রকল্প কর্মকর্তা অমল ত্রিপুরা জানান, তামাক চাষ ও তামাক পোড়ানো জনস্বাস্থ্য্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া জনবসতি এলাকায় চুল্লি স্থাপন এবং এতে কাঠ পোড়ানো কাজে নিষিদ্ধ করতে সুনির্দিষ্ট কঠোর আইন করা প্রয়োজন।
খাগড়াছড়ি’র অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট(এডিএম) আনারকলী জানান, তামাক নিয়ন্ত্রন আইনে তামাকচুল্লি নিয়ন্ত্রন বিষয়ক কোন বিধিবিধান নেই। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও পরিবেশ আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে খাগড়াছড়ি জেলায় পরিবেশবাদী সংগঠন থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের সরকারী কোন কার্যালয় নেই।
—————————
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।