চট্টগ্রাম থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ জন ছাত্র, টেকনিক্যাল কলেজের ২ জন ছাত্র এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কর্মী (শহরের চাকুরীজীবী) ৬ জন এক সঙ্গে সকাল ৯টার দিকে রওনা দিলাম খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার শণখোলা পাড়ায় সম্প্রতি ১৭ এপ্রিল ঘটে যাওয়া অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও মারধরের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশ্যে। টানা আড়াই ঘন্টা গাড়িতে চড়ে পৌঁছে গেলাম মানিকছড়ির মহামনি নামক স্থানে। আমাদের মাইক্রোবাসের সাথে ছিল একটি ত্রাণভর্তি পিকআপ।
মহামনিতে পৌঁছার সাথে সাথে যোগাযোগ করা হলে ত্রাণ বিতরণ কমিটির একজন মধ্য বয়স্ক লোক মোটর সাইকেলে করে আমাদেরকে নিতে আসেন। সেখান থেকে খাগড়াছড়ি সড়ক ধরে কিছুদূর এগোনোর পর ডান পাশের একটি কাঁচা রাস্তা ধরে ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছিলাম। উঁচু নিচু পাহাড় বেয়ে গাড়িগুলো চলতে লাগল। পাহাড় ওঠার সময় ত্রাণভর্তি পিকআপটিকে ঠেলে তুলতে হয়েছে। তখন সবার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার তীব্র এক কৌতুহল। রাস্তার দু‘পাশের পাহাড়গুলো তাদের নিজস্ব রূপ নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আর এই পাহাড়ে বসতি গড়েছে অনুপ্রবেশকারী সেটলার বাঙালিরা। খাগড়াছড়ি চট্টগ্রাম মহাসড়ক হতে প্রায় এক কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত তাদের বাড়িঘর চোখে পড়ে। তাদের লাগানো চারা গাছগুলো এখনও অনেক ছোট। আশে পাশের পাহাড়গুলোতে তারা কচু, হলুদ, আদা, আনারস ইত্যাদি চাষ করছে। এসব দেখে বোঝার বাকি থাকে না যে তারা বিশেষ দেরী হলো না সেখানে বসতি গড়েছে। আমাদের কেউ কেউ এসব দেখে নানা মন্তব্য করতে থাকে। আমরা যখন পাহাড়ি গ্রামে প্রবেশ করলাম তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাদের গাড়িগুলো দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে। তারাও আমাদেরকে গাড়ি ঠেলতে সাহায্য করেছে। কাঁচা রাস্তা ধরে প্রায় ১৫-২০ মিনিট এগোনোর পর পৌঁছে গেলাম ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে৷ সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজন আমাদের গাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে আসে এবং ত্রাণ সামগ্রীগুলো গাড়ি থেকে নামাতে সাহায্য করে। এরপর আমাদের ত্রাণ সামগ্রীর বিস্তারিত নথিভুক্ত করে আমরা তাঁদের সাথে মত বিনিময়ের জন্য বসে পড়লাম। আমরা ঘটনার দিন কী ঘটেছে তা জানতে চাইলে তাঁদের মধ্য থেকে ত্রাণ কমিটির একজন সদস্য ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
তাঁর বর্ণনায় জানা যায় যে, স্থানীয় উত্তর শণখোলা পাড়ার বাসিন্দা তুইহ্লাঅং মারমার রেকর্ডভুক্ত জমি এক বাঙালি সেটলার জবরদখল করার চেষ্টা করলে বিরোধ মীমাংসার জন্য প্রথমে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দেয়া হয়। তিনি তুইহ্লাঅং মারমার পক্ষে রায় দেন। একই ব্যাপারে এরপর আবার হেডম্যানের কাছে বিচার চাওয়া হয়। এতেও মি. মারমার পক্ষে রায় দেয়া হয়। এরপর তা থানায় চলে যায়। থানাতেও মি. মারমা জিতে যান। শেষ পর্যন্ত তা স্থানীয় জোনে যায়। জোন কমান্ডার কামরুল হাসান বলে দেন দেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বিরোধ মীমাংসা হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত দুই পক্ষের কেউ ঐ জমি ভোগ দখল করতে পারবে না। কিন্তু এ রায় হওয়া সত্বেও গত ১৭ এপ্রিল কথিত ঐ সেটলার উক্ত জমিতে লোকজন নিয়ে কাজ করতে যায়। এতে বাধা দেয়া হলে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। পরে আনুমানিক দেড়টার দিকে তা পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়। সংঘাতের এক পর্যায়ে ৪ জন বাঙালি মারা গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী উপস্থিত হয় এবং পাহাড়িরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর সেটলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাহাড়িদের গ্রামে ঢুকে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ও লুটপাট চালায়।এই হামলায় শণখোলা পাড়ার ৮৪টি বাড়ি, একটি বৌদ্ধ মন্দির এবং একটি দোকান পুড়ে যায়৷ এছাড়া লোকজনকে মারধর করা হয়।
অন্যদিকে, ঘটনার খবর আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে মানিকছড়িতেও সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ১১টি বাড়ি ও ৪টি দোকানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। এছাড়া গুইমারা এলাকায় পাহাড়ি বাস যাত্রীদের নামিয়ে মারধর করা হয় বলে জানা যায়। সেখানে কয়েকজনকে হত্যা করে তাঁদের লাশগুলো গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসীরা জানান, আহত অনেকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও কিনিকে চিকিত্সা নিতে হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ৪ জন বাঙালির মৃত্যু খবর ছড়িয়ে পড়লেও তারা আসলে মারা গেছেন কিনা তা এখনও স্থানীয়দের কাছে স্পষ্ট নয়। এমনকি মৃত ব্যক্তিদের ছবিও কোন পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনে প্রকাশ করা হয়নি।
বর্তমানে ঘটনার বিশ দিন পরও এলাকার পরিস্থিতি থমথমে রয়েছে। ওখানকার লোকজন এখন চরম আতঙ্কিত ও হতাশাগ্রস্ত। মত বিনিময়ের সময় দেখা যায় কয়েকজন নারী পুরুষ আড়ালে চোখের পানি মুছছেন। কেউ কেউ শুধু ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকেন। এলাকাটি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকায় লোকজন ঠিকমতো বাংলাও বলতে পারেন না। ফলে তাঁরা তাঁদের কথাগুলো ঠিকমত প্রকাশ করতে পারেন না।ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সবাই নিরীহ ও সহজ সরল। পানীয় জল হিসেবে তাঁরা কুয়ার পানি ব্যবহার করেন। কোথাও কোন নলকূপ চোখে পড়েনি। বর্তমানে তারা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ভারী পলিথিন কিংবা পুড়ে যাওয়া টিন দিয়ে কোন রকমে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে কাল যাপন করছেন। কাল বৈশাখীর এই দিনে সামান্য ঝড় বৃষ্টিতেও তাদের ঐ ছোট্ট ঝুপড়িতে পানি পড়ে। কিছুদিন আগেও যে পাহাড়িরা বৈ-সা-বির আনন্দে উত্ফুল্ল ছিল, তাঁরা আজ চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি দেখে দেখে নীরব কান্নায় আজ তাদের জীবন কাটে। বেঁচে থাকার সমস্ত গৃহস্থালী জিনিসপত্র হারিয়ে তারা আজ শুধু এক কাপড়ে দিনাতিপাত করছে। পুড়ে যাওয়া বসতভিটাও হাহাকার করছে। চারদিকে শুধু পোড়া মাটি ও ছাইয়ের গন্ধ। পুড়ে গেছে আশপাশের গাছপালাও। সেগুলো এখন সেদিনের নৃশংস ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘটনার পর ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রেও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক সংগঠনকে ত্রাণ বিতরণে বাধা দেয়া হয়েছে। যারা ত্রাণ বিতরণ করতে যাবেন তাদেরকে পাঁচটি শর্ত মেনে ত্রাণ বিতরণ করতে হয়। শর্তগুলো হলো প্রশাসনের সহযোগীতা ও উপস্থিতিতে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে হবে, তিগ্রস্ত পাহাড়ি –বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনদের মাঝে সমভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে হবে, ত্রাণ বিতরণের সময় অতিরিক্ত লোক সমাগম থেকে বিরত থাকতে হবে, ত্রাণ বিতরণের পূর্বে বা বিতরণকালে কোন ধরনের মিছিল-মিটিংসহ ব্যানার/ফেস্টুন প্রদর্শন করা যাবে না, ত্রাণ বিতরণকালে স্থানীয় থানা ও ত্রাণ বিতরণ কমিটির লোকজনের উপস্থিতি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা হারে প্রত্যেক পরিবারকে দেওয়ার প্রতিশ্রুত থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি পরিবারগুলো মাত্র ৫ হাজার টাকা করে পেয়েছে। অপরদিকে, প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। যে চাল দেয়া হয়েছে সেগুলোও পঁচে গেছে বলে ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন। প্রতি পরিবারকে ৩ বান্ডিল করে ঢেউটিন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও মাত্র ২৭ পরিবারের জন্য দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী সন্ধ্যা হলেই ঘটনাস্থলে যায়। ফলে লোকজন এখনও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। প্রশাসন থেকে ত্রাণ বিতরণ কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা তা বর্জন করে নিজেদের উদ্যোগে পাল্টা কমিটি গঠন করেছেন। এতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ সহযোগীতা করছে বলে জানা গেছে। খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ব্রিগেড কমান্ডার ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করলে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা তা বয়কট করেন এবং তাদের বাড়িঘর আগে তুলে দিয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার দাবি জানান। তা না হলে তাঁরা কোন প্রকার আলোচনায় বসতে রাজী নয়। প্রশাসনের ঐ সকল কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য ছিল আলোচনার কথা বলে পাহাড়িদের নিয়ে এসে তথাকথিত শান্তি মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য করা। কিন্তু পাহাড়িরা তা বয়কট করায় তারা লজ্জাজনকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যায়। এ কারণে সেনাবাহিনীর লোকজন এখনও পাহাড়িদেরকে বাঁকা চোখে দেখছে। তারা কোন প্রকার ত্রাণ সামগ্রী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। বরং নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিচ্ছে। এলাকার অন্যান্য লোকজনের সাথে কথা বলেও একই মন্তব্য পাওয়া যায়।
সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্দেশ্য হচ্ছে তিনটি। ১৷ ভয়ভীতি সঞ্চার করে পাহাড়িদেরকে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা। ২৷ তাতে কাজ না হলে যে কোন প্রকারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে পাহাড়ি জনগণের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে তাদের নিঃস্ব করে দিয়ে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। ৩৷ এরপর ছলে বলে কৌশলে তাদের জমিগুলো কেড়ে নেয়া অথবা নামমাত্র দামে কিনে নেয়া।
এখন বাস্তবতা হলো অদূর ভবিষ্যতে রামগড় হামলার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী। অধিকাংশ ব্যক্তির মতামত হচ্ছে, একতাবদ্ধ হওয়া ছাড়া জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যেকটি শিশু জন্ম নেয় এক সংকটময় বৈরী পরিস্থিতিতে। শৈশবে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তারা দেখতে পায় শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতন৷ শুনতে পায় অধিকারহারা নির্যাতিত মানুষের করুণ আর্তনাদ। এই বাস্তবতা তাদেরকে বিক্ষুব্ধ ও সংগ্রামী করে তোলে। যেখানেই নির্যাতন সেখানেই প্রতিরোধ। তাই শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনিবার্যভাবে চলবে প্রতিরোধ সংগ্রাম। আজকের বিক্ষব্ধ শিশুরা ভবিষ্যতে এক একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবেই গড়ে উঠবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের দুঃখী মানুষের মলিন মুখে হাসি ফোটাবে এটাই আজ সবার প্রত্যাশা।
———- শেষ ———-