রাজনৈতিক ভাষ্য:
গতকাল জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করা হয়েছে। সরকার বিলটি উত্থাপনের পাঁচ দিনের মাথায় কাউকে আলোচনার সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি করে এই বিতর্কিত বিলটি পাস করলো। এক কলমের খোঁচায় মুহূর্তের মধ্যে আমাদের বাঙালি বানানো হলো। বিলের ৬ নং ধারায় সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” অপরদিকে সংবিধানে ২৩ক নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।এতে লেখা থাকবে: “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি,ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করিবেন।“
এই দুই অনুচ্ছেদের মধ্যে স্পষ্টতই অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়৷ যদি বাংলাদেশের জনগণ সবাই বাঙালি হন, তাহলে “উপজাতি”, “ক্ষুদ্র জাতিসত্তা” ও “নৃগোষ্ঠীর” সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে কেন? দ্বিতীয়ত, “জনগণ” আর “নাগরিক” কি ভিন্ন জিনিস? এদের মধ্যে পার্থক্য কি আকাশ-পাতাল? একটি দেশে যারা জনগণ তারাই কি সে দেশের নাগরিক নন? যদি কোন বিদেশী নাগরিক, ধরা যাক একজন চীনা নাগরিক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তখন কি তিনি এর ফলে বাংলাদেশের জনগণের অংশ হয়ে যাবেন না? তাহলে কি তাকেও বাঙালি হতে হবে? নাগরিকত্ব ত্যাগ করা যায়, কিন্তু জাতীয় পরিচিতি বা জাতিত্ব ত্যাগ করা যায় না — এই স্বতসিদ্ধ সত্য ধারণাকে কি এই সংশোধনীর মাধ্যমে অস্বীকার করা হয়নি? ৬ নং অনুচ্ছেদকে এভাবেও পড়া যায়: বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি, তবে বাংলাদেশী নয়; বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী, কিন্তু বাঙালি নয়। এই অনুচ্ছেদটি পড়লে আরো মনে হবে যে এদেশে বাঙালি ভিন্ন অন্য কোন জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। অপরদিকে সংযোজিত ২৩ক অনুচ্ছেদে “ক্ষুদ্র জাতিসত্তা” ও “নৃগোষ্ঠীর” উল্লেখ থেকে এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা পাওয়া যায়। অর্থাত্ ৬ ও ২৩ক অনুচ্ছেদ পরষ্পর বিরোধী৷ একটি অন্যটিকে অস্বীকার করে।
এই সংশোধনী বিলে আরো অনেক অসংগতি রয়েছে। বলা যায়, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সংবিধান একটি জগাখিচুড়ি দলিলে পরিণত হলো। প্রথমত, জামাতসহ ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী ও স্বৈরাচারী এরশাদকে খুশী করার জন্য বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়েছে; অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতি ফিরিয়ে এনে “৭২ এর সংবিধান” পুনঃপ্রবর্তনের দাবি উত্থাপনকারীদের প্রশমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তারা কি ভুলে গেছেন ধর্ম নিরপেক্ষতার আসল কথা হলো রাষ্ট্র ধর্মের প্রশ্নে নাক গলাবে না, কারণ ধর্ম ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার? অথচ বাংলাদেশে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, একদিকে জাতীয়তাবাদ ও অন্যদিকে সমাজতন্ত্র রাখা হয়েছে, যা একে অপরের সাথে বিরোধাত্বক। সমাজতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলো আন্তর্জাতিকতাবাদ, জাতীয়তাবাদ নয়। তারপরও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে সমাজতন্ত্রের পরম শত্রুরাই সংবিধানে সমাজতন্ত্র ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত হলো আওয়ামী লীগসহ এদেশের শাসকগোষ্ঠী এদেশের সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অস্তিত্বকে শুধু অস্বীকার নয়, তাদেরকে বাঙালি বানাতে চায়৷ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ কার্যতঃ সংখ্যালঘু জাতিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার যা বোঝাতে চেয়েছে তা হলো: “হয় বাঙালি হয়ে যাও, নয় দেশ ছাড়ো। বাঙালি ছাড়া এদেশে আর কারো স্থান হবে না।” আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে আওয়ামী লীগ হয়তো আরো একটি সংশোধনী বিল এনে বলবে বাংলাদেশে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম পালন করা যাবে না। শাসকগোষ্ঠী আসলে বহু জাতিক, বহু ভাষিক ও বহু ধর্মের বাংলাদেশকে এক জাতি, এক ভাষী ও এক ধর্মের দেশ বানাতে চায়। স্বাধীনতার পর থেকেই তারা এই প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে “বাঙালি” হিসেবে অভিহিত করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ এর বিরুদ্ধে সে সময় সংসদের ভেতরে ও বাইরে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু গতকাল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যে ভূমিকা পালন করেছেন তার ফলে তারা ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কিত হয়ে থাকবেন৷ তারা জনগণের পক্ষে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। যে দলিলে তাদেরকে ও তাদের নিজ নিজ জাতির জনগণকে বাঙালি বলে হেয় ও অবজ্ঞা করা হয়েছে সে দলিলে তারা বিনা প্রতিবাদে স্বাক্ষর করলেন। তারা দাসের চেয়েও অধম। তারা আওয়ামী লীগের দাসানুদাস৷ তাদের প্রতি আমাদের মনে প্রবল ঘৃণা, ধিক্কার ও আক্রোশই জন্ম নেয়। এই নুপংসক, অথর্ব সাংসদরা হয়তো অক্ষম যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন, “আমাদের কী করার ছিল? আমরা স্বাক্ষর না করলেও তো বিলটি পাস হতো। স্বাক্ষর না করলে আমাদের সংসদ সদস্যপদ ও মন্ত্রীত্ব চলে যেতো।” মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ৭২ এর সংবিধানে স্বাক্ষর না করেও তো সেই সংবিধান পাস হয়েছে। (দুঃখজনক হলেও সত্য, যে ৭২‘র সংবিধান জুম্ম জনগণের অধিকার সংরক্ষণ না করার জন্য জেএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই সংবিধানকেই তার ভাই সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানাচ্ছে।) পাস রোধ করা তার পক্ষে ছিল অসাধ্য। কিন্তু যা তার সাধ্যের মধ্যে ছিল, যা তার ইতিহাস নির্ধারিত কর্তব্য, তিনি তা পালন করেছিলেন৷ তিনিও তো অম যুক্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি, বর্তমান এমপিদের মতো সুবিধাবাদীর ভূমিকা নেননি। কারণ তিনি ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার জন্য এমপি হননি। কিন্তু বর্তমান তিন জুম্ম এমপির কাছে জাতীয় স্বার্থের চাইতে ব্যক্তিগত সুবিধা, মন্ত্রীত্ব ও সংসদ সদস্যপদই বড়।
ইউপিডিএফ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অতীতে জেএসএস নেতৃত্বকে বার বার সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সে কথায় জেএসএস মোটেই কর্ণপাত করেনি। গত সংসদ নির্বাচনেও ইউপিডিএফ নেতারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছিলেন। নিজের লাগানো গাছের চারায় পানি না ঢেলে অন্যের অর্থাত্ আওয়ামী লীগের গাছের গোড়ায় পানি দেয়া হলে পাহাড়িদের কোন লাভ হবে না বলে তখন মন্তব্য করেছিলেন। সংসদ সদস্য পদকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করে এই হাতিয়াকে যার তার হাতে অর্থাত্ শত্রুর হাতে তুলে না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের টিকেটে পাহাড়িরা নির্বাচিত হলেও তারা স্বজাতির জন্য কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদের আলোকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সংসদে উত্থাপিত কোন বিল পাহাড়িদের বিপক্ষে গেলেও তাদেরকে সদস্যপদ রার সুবিধাবাদী স্বার্থে সেই বিলের বিপক্ষে ভোট দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তারপরও পাহাড়িদের একটি বিরাট অংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। ফলে আজ যখন সংসদের ভেতরে ও বাইরে চাপিয়ে দেয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করার প্রয়োজন দেখা দিলো, তখন জুম্ম জনগণ তাদের নির্বাচিত এমপিদের সাথে পেলেন না৷ সংসদে জুম্ম এমপিরা মীর জাফরী ভূমিকাই গ্রহণ করলেন।
ন্যাড়া একবারই বেল তলায় যায়, কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগের কাছে বার বার প্রতারিত হওয়ার পরও তার কাছেই যাই ও তাকেই ভোট দিই। আমরা ইউপিডিএফ নেতৃবৃন্দের কথা বিশ্বাস করিনা, বিশ্বাস করি প্রতারক আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কথা৷ সেজন্য আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আমরা এই প্রতিদান পেলাম৷ এই বিল পাসের পরও আমাদের শিক্ষা না হলে, আর কোন দিন হবে বলে মনে হয় না।
আমাদের তিন জুম্ম এমপি বাঙালি জাতীয়তাবাদ মেনে নিয়ে বাঙালি হয়ে গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এই অন্যায় কখনোই মেনে নেবেন না। তারা কোনদিন বাঙালি হবেন না। ইতিমধ্যে বিল পাসের দিন সর্বত্র প্রতিবাদ হয়েছে৷ রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ লাল পতাকা মিছিল করেছে। আগামীতে এই প্রতিবাদ আরও ব্যাপক ও বিসতৃত হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষরা কেউ নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেননি, এখনো দেন না; বাঙালিদের পূর্ব পুরুষরাও কেউ আমাদের বাঙালি বলেননি, এখনো বলেন না৷ জোর করে কারো জাতিত্ব কেড়ে নেয়া যায় না, জোর করে জুম্ম জনগণকে বাঙালি বানানো যাবে না। যে জুম্ম জাতি পরাক্রান্ত মোগল শাসক ও সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, সে জাতিকে কোন দিন দমন করা যাবে না, সে জাতির অস্তিত্বকে কখনোই মুছে ফেলা যাবে না।
——-