বাঘাইছড়িতে সেনা নির্যাতনের জের
জড়িতদের শাস্তি দেয়ার আশ্বাস, আহতদের আর্থিক সহায়তার সিদ্ধান্ত
সিএইচটি নিউজ ডটকম
বাঘাইছড়ি ॥ বাঘাইছড়ির করেঙ্গাতলীতে ১১ পাহাড়িকে মারধরের সাথে জড়িত সেনা সদস্যদের সামরিক নিয়মে শাস্তি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বাঘাইহাট জোন কমান্ডার। অন্যদিকে এই ঘটনার প্রতিবাদে আহূত বাজার বয়কট কর্মসূচী বিষয়ে পাহাড়ি ও বাঙালিদের সমন্বয়ে গঠিত এক কমিটির আলোচনা সভায় শারীরিক নির্যাতনে গুরুতর আহত তিন জনকে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ও দাঙ্গা কায়দায় সেনা নির্যাতনের সূত্রপাত ঘটানোর জন্য ব্যবসায়ী কামাল, ননাচ’ চাকমা ও নূর হোসেনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়া উক্ত তিন জনকে আর্থিকভাবেও দণ্ডিত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর কোরবানীর ঈদ উপলক্ষে এলাকার গণ্যমান্য কয়েকজনকে বাঘাইহাট জোনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত ভোজ সভায় জোন কমান্ডার লে. কর্নেল আলী হায়দার সিদ্দিকী করেঙ্গাতলীতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পাহাড়িদের উপর বেপরোয়া সেনা নির্যাতনের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি এ ঘটনার সাথে জড়িত সেনা সদস্যদের সামরিক নিয়মে শাস্তি দেয়া হবে বলে আশ্বাস প্রদান করেন। উক্ত ভোজ সভায় উপস্থিত জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ ছাড়া জোন কমান্ডার ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় সেনাবাহিনী জড়াবে না বলে অঙ্গীকার করেন এবং কারোর দেয়া তথ্য যাচাই বাছাই ছাড়া গ্রহণ করা হবে না বলে জানান।
লে. কর্নেল আলী হায়দার সিদ্দিকীকে উদ্ধৃত করে ভোজ সভায় উপস্থিত একজন বলেন, জোন কমান্ডার বলেছেন করেঙ্গাতলী বাজার খোলার বিষয়টি সেনাবাহিনীর কাজ নয়। তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য পাহাড়ি বাঙালি সমন্বয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন।
অপরদিকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর বঙ্গলতলী ইউপি’র উদ্যোগে চলমান বাজার বয়কট কর্মসূচিসহ উদ্ভূত সমস্যা নিরসনের জন্য পাহাড়ি-বাঙালীর সমন্বয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য বঙ্গলতলী ইউপি চেয়ারম্যান তারুচি চাকমাকে আহ্বায়ক করে ১৫ (পনের) সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন, বিশ্ব জ্যোতি চাকমা, জ্ঞান জীব চাকমা, মুক্ত সোনা চাকমা, পুষ্প কান্তি কার্বারী ও বাঙালীদের মধ্যে বুলু, নূরু মেম্বার, কবীর ও নিকাশ দে প্রমূখ।
কমিটির সদস্যরা করঙাতুলি বাজারে সৃষ্ট ঘটনাটির নিরসনের ব্যাপারে আলোচনা-পর্যালোনার পর নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১। ঘটনার সূত্রপাতের জন্য কামালকে মূল দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এছাড়া ননাচ’ চাকমা এবং নূর হোসেনকে একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কমিটি এজন্য কামালকে ১৫,০০০/- (পনের হাজার), ননাচ’ চাকমাকে ১০,০০০/- (দশ হাজার) এবং নূর হোসেনকে ৫,০০০/- (পাঁচ হাজার) টাকা জারিমানা ধার্য করা হয়।
২। করেঙ্গাতলী বাজার কমিটি আহতদের চিকিৎসা বাবদ ৫,০০০/- (পাঁচ হাজার) টাকা সহায়তা প্রদানে সম্মতি প্রদান করে।
৩। জরিমানার ৩০,০০০/- টাকা এবং বাজার কমিটি প্রদেয় ৫,০০০/- টাকা মোট ৩৫,০০০/-টাকা আহতদের সহায়তা ও চিকিৎসা বাবদ প্রদান করা হবে। আহতদের মধ্যে রিপেল চাকমাকে ২৫,০০০/-, কালাইয়ে চাকমাকে ৫,০০০/- ও মরত্তো চাকমাকে ৫,০০০/- প্রদান করা হবে।
৪। দোষীদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে অঙ্গিাকারনামা গ্রহণ এবং কিছু শর্তারোপ করা হয়। শর্তাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কামাল ও নূর হোসেন ভবিষ্যতে পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না, ভবিষ্যতে কারোর সাথে ঝগড়া-বিবাদে জড়াবে না।
ঘটনার সূত্রপাত: উল্লেখ্য, গত ১৯ সেপ্টেম্বর করেঙ্গাতলী বাজারের হাটের দিন মারিশ্যা বাজারের মুসলিম ব্লকের বাসিন্দা মো. নূর হোসেন ও মো. কামালের সাথে করেঙ্গাতলী এলাকার বাসিন্দা চিত্তিয়ে চাকমার যৌথ গরু ব্যবসা সংক্রান্ত লেনদেন বিষয়ে বাক-বিতণ্ডা ও ঝগড়া শেষে মারামারিতে গড়ায়।
এরপর নূর হোসেন ও কামাল উক্ত মারামারি ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রং দিয়ে ও চাঁদাবাজির ঘটনা আখ্যা দিয়ে করেঙ্গাতলী আর্মি ক্যাম্পে মিথ্যা অভিযোগ করে। তাদের বক্তব্য শোনার করেঙ্গাতলী ক্যাম্পের লে. তানভীর, সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার রহমান ও নাসের (৪ বীর) এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উক্ত অভিযোগের কোন প্রকার সত্য-মিথ্যা যাছাই না করে বাজারে আগত শুধুমাত্র নিরীহ পাহাড়িদের গণহারে মারধর করে। এতে কমপক্ষে ১১ জন আহত হন। তারা হলেন, ১। চিত্তিয়ে চাকমা পিং-তিবুজ্যা চাকমা; ২। জুনুমণি চাকমা পিং- পূর্ণিময় চাকমা; ৩। তপন চাকমা পিং-দীপংকর চাকমা; ৪। রিপেল চাকমা পিং- সঞ্চয় চাকমা; ৫। উত্তম বিকাশ চাকমা (বর্তমান ইউপি মেম্বার, মারিশ্যা ইউপি); ৬। সোনাক্যা চাকমা পিং- তুকচান চাকমা; ৭। মরত্তো চাকমা পিং- পূর্ণ কুমার চাকমা ; ৮। কালাইয়ে চাকমা পিং-অজ্ঞাত; ৯। ননাচ’ চাকমা পিং-মঙ্গল কুমার চাকমা; ১০। ধনেশ্বর চাকমা পিং-অজ্ঞাত; ১১। জরাসন্ধ চাকমা পিং-ঐ; সর্ব সাং- করঙাতুলি এলাকা, বঙলতুলি ইউপি, বাঘাইছড়ি উপজেলা, রাঙামাটি।
এদের মধ্যে গুরুতর আহত মরত্তো চাকমা ও রিপেল চাকমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খাগড়াছড়ি নিয়ে যেতে চাইলে করেঙ্গাতলী ক্যাম্প কমান্ডার মেজর সেলিম বাধা দেন। এ কারণে সেদিন নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অবশ্য তার পরের দিন গোপনে আহতদেরকে চিকিৎসার জন্য খাগড়াছড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
নিরীহ ব্যক্তির উপর সেনা নির্যাতনের প্রতিবাদে বঙলতলী এলাকার জনগণ করেঙ্গতলী বাজার বয়কটের ডাক দেয়, যা এখনো স্বতস্ফূর্তভাবে চলছে। অবশ্য জোন কমান্ডারের দোষী সেনা সদস্যদের শাস্তি দেয়ার আশ্বাস ও আহতদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্তের পর বাজার বয়কট কর্মসূচী তুলে নেয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে তারা জানান।
——————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।