ঢাকায় ৫ সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন: বিপুল চাকমাসহ চার নেতার খুনীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি

0
ঢাকা পাঁচ সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করছেন পিসিপির সভাপতি অঙ্কন চাকমা

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৪

বিপুল চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন বিকাশ ত্রিপুরার আত্মস্বীকৃত খুনীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও শাস্তি এবং সেনা মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে গ্রুপগুলো ভেঙে দেয়ার দাবিতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঁচ গণতান্ত্রিক সংগঠন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট।

আজ শনিবার (২০ জানুয়ারি ২০২৪) সকাল ১১টায় ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধূরী হল রুমে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। 

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অঙ্কন চাকমা। 

এছাড়াও এতে আরো উপস্থিত ছিলেন ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রমোদ জ্যোতি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভানেত্রী কণিকা দেওয়ান ও সহ-সভাপতি রিনিসা চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমা এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে বিপুল চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন বিকাশ ত্রিপুরার আত্মস্বীকৃত খুনী পিন্টু চাকমা ও রমেল চাকমাসহ জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার, ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ অঘোষিত সেনাশাসন তুলে নেওয়া এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত, ঠ্যাঙাড়ে গ্রুপগুলোকে মদদ দান বন্ধ এবং নব্য মুখোশ নামে পরিচিত ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া, মিঠুন চাকমা হত্যা ও স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ডসহ ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, ইউপিডিএফ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী সমর্থকদের হত্যা, গুম, গ্রেফতার তথা তাদের ওপর রাজনৈতিক দমনপীড়ন বন্ধ এবং খুনী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর মদদ দাতাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলন থেকে আগামী ২১-৩১ জানুয়ারি ২০২৪ বিপুল চাকমাসহ চার নেতা হত্যার প্রতিবাদে পানছড়িসহ খাগড়াছড়ির স্কুল ও কলেজসমূহে শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পানছড়ি উপজেলায় স্কুল কলেজে ছাত্র ধর্মঘট, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, খাগড়াছড়ি জেলাব্যাপী স্কুল কলেজে ছাত্র ধর্মঘট এবং আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অভিমুখে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে অঙ্কন চাকমা বলেন, গত ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলাধীন অনিলপাড়ায় সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভুক্ত চার ছাত্র-যুব নেতা গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি বিপুল চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ-সভাপতি লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ পানছড়ি ইউনিটের সদস্য রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। খুনীরা ঘটনাস্থল থেকে ইউপিডিএফের তিন সদস্য নীতিদত্ত চাকমা, হরি কমল ত্রিপুরা ও প্রকাশ ত্রিপুরাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় তারা সকলে অতুল চাকমা নামে এক গ্রামবাসীর বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলেন। পরদিন স্থানীয় পর্যায়ের এক যুব সম্মেলনে তাদের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল।

পানছড়ি হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত খুনীদের রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্য তিনি বলেন, উক্ত ঘটনার ৪০ দিন পরও খুনীদের এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। উপরন্তু তাদের রক্ষা করতে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা শুরু থেকে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অভিযোগ করে এ বিষয়ে বেশ কিছু কারণ তুলে ধরেন। 

এক। পানছড়ি উপজেলা সদর থেকে ঘটনাস্থলে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট, যদিও কিছু সংবাদ মাধ্যমে না জেনে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনাস্থলকে দুর্গম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু যাতায়াতের এত সুবিধা সত্ত্বেও পুলিশ ঘটনার ১৯ ঘন্টা পরই কেবল ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে।

আমরা জেনেছি, ঘটনার পরই পুলিশ ঘটনাস্থলে যেতে চাইলে পানছড়ি সেনা ক্যাম্পের জনৈক মেজর তাতে বাধা দেন। পরে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করলে লাশ উদ্ধারে উক্ত মেজরের বাধা তুলে নেয়া হয়। এটা পরিষ্কার যে, খুনের আলামত নষ্ট করতে এবং খুনীদের রক্ষা করতে ঘটনাস্থলে যেতে পুলিশকে বাধা দেয়া হয়েছে।

দুই। ১২ ডিসেম্বর রাতে নিহত বিপুল চাকমার কাকা নিরূপম চাকমাকে ভয় দেখিয়ে ও জরুরী কাজ আছে বলে পানছড়ি থানায় ডেকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হয়। পরদিন তিনি বিষ্ময়ের সাথে জানতে পারেন যে, তিনি বাদি হয়ে অজ্ঞাত ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছেন। আমাদের ধারণা খুনীদের পরিচয় আড়াল করতে পুলিশ খুনীদের অথবা তাদের পৃষ্ঠপোষকদের চাপে এভাবে প্রতারণামূলকভাবে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা নথিভুক্ত করেছে।

তিন। অপহৃত তিন ইউপিডিএফ সদস্যদের ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ মুক্তি দেয়া হয়। তারা জানান খুনীরা তাদেরকে প্রথমে পানছড়ি বাজারের কাছে মানিক্যাপাড়ায় নিয়ে যায় এবং একদিন পর ভাইবোনছড়ার দেওয়ানপাড়ায় স্থানান্তর করে। পরে সেখান থেকে খুনীরা তাদেরকে ভাইবোনছড়া দেওয়ানপাড়া আর্মি ক্যাম্প কমান্ডারের কাছে তুলে দেয়। অপহৃত ইউপিডিএফ সদস্যদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তাদেরকে পানছড়ির তারাবনছড়া নামক স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে সেনাবাহিনীর দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইউপিডিএফও সে সময় সেনাবাহিনীর উক্ত দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়ে জানায় যে, ঐ এলাকায় সেনাবাহিনীর কোন ধরনের উদ্ধার তৎপরতা ছিল না। খুনীদের আড়াল ও রক্ষা করতেই সেনাবাহিনী উক্ত “উদ্ধার” নাটক মঞ্চস্থ করে।

সেনাবাহিনীর কাছে অপহৃতদের হস্তান্তর খুনীদের সাথে ভাইবোনছড়া ক্যাম্প কমান্ডারের সম্পর্ক থাকার বিষয়টিকেই স্পষ্ট করে। মুক্তি পাওয়ার পর ইউপিডিএফ সদস্যরা আরও জানায় যে, সেনাবাহিনী তাদেরকে সাংবাদিকদের সাথে খোলামেলাভাবে কথা বলতে নিষেধ করে এবং কেবলমাত্র তাদের শেখানো বক্তব্য বলতে বাধ্য করে। সেজন্য তাদেরকে খাগড়াছড়ি আদালতে নেয়া হলেও সেখানে সাংবাদিকদের সাথে তাদেরকে কথা বলতে দেয়া হয়নি, যদিও সাংবাদিকরা প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য ভিড় করেছিলেন।

চার। গত ১১ জানুয়ারি ২০২৪ খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের জনৈক মেজর অমর জ্যোতি চাকমাসহ খুনীদের ৬ জনের একটি দলের সাথে স্বাক্ষাৎ করেন, যা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার এই স্বাক্ষাৎ খুনীদের রক্ষার চেষ্টার অংশ বলে আমরা মনে করি।

লিখিত বক্তব্যে অঙ্কন চাকমা চার নেতার খুনীদের বর্তমান অবস্থান ও তৎপরতা তুলে ধরে বলেন, বিপুলদের খুনীরা বর্তমানে তাদের নিরাপদ আস্তানা মানিক্যাপাড়া, দেওয়ানপাড়া ও তেঁতুলতলায় অবস্থান করছে এবং খুনের দায় স্বীকার করে ফোনে ইউপিডিএফ নেতাসহ বিভিন্নজনকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। যেমন, গত ৮ জানুয়ারি ২০২৪ ঠ্যাঙাড়েরা ৩ নং পানছড়ি ইউনিয়নের মহিলা মেম্বার মন্দিরা চাকমা, লতিবান ইউনিয়নের সাবেক মহিলা মেম্বার সুজাতা চাকমা ও পানছড়ি গণঅধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য রোমেল মারমাকে ভাইবোনছড়ায় দেওয়ানপাড়াস্থ তাদের আস্তানায় ডেকে নিয়ে হুমকি দেয়, হেনস্থা করে এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা দাবি করে। এছাড়া আমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য চলমান কর্মসূচি বানচালের জন্য বিভিন্ন অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

তিনি, বিপুল চাকমাসহ চার নেতাকে খুনের উদ্দেশ্য বোঝার জন্য উক্ত খুনের ঘটনার প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেন, ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে একটি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করে দেয়া হয়। সেই পর থেকে এই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সদস্যরা সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের পাশে অথবা উপজেলা সদরে আস্তানা গেড়ে খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

সেনা মদদপুষ্ট এই ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলো ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। গত ৬ বছরে তারা এই সংগঠনের ৫৫ জনকে হত্যা করেছে। তাদের দ্বারা সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দুটি হলো ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরে মিঠুন চাকমা হত্যা এবং একই বছর ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি শহর স্বনির্ভরে পুলিশ ফাঁড়ি ও বিজিবির সদর দপ্তর সামনে ৭ জনকে গণহত্যা। এভাবে একের পর এক হত্যালীলা চালানোর পরও ঠ্যাঙাড়েদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এবং কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ বিপুল চাকমাসহ ইউপিডিএফ-ভুক্ত চার নেতাকে হত্যা করা হয়।

পাঁচ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আশঙ্কা করে বলেন, অবিলম্বে বিপুল চাকমাসহ খুনীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা না হলে ও খাগড়াছড়ির সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া থেকে বিরত না থাকে এবং যদি ঠ্যাঙাড়ে গ্রুপগুলো ভেঙে দেয়া না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক নিরীহ ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে প্রাণ হারাতে পারে। সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদাবাজি-খুন খারাবিতে দৌরাত্ম্য জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠবে, যা সুস্থ বিবেকবোধ সম্পন্ন কোন নাগরিকেরই কাম্য হতে পারে না।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘে সভাপতি কণিকা দেওয়ান।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More