তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন

0

সোহেল চাকমা


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ব্যাপক ছাত্র-জনতার উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের অধিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। জুলাই মাসে শুরু হওয়া এ আন্দোলনে অজস্র প্রাণহানি ঘটলেও ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব হাল ছাড়েনি। পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়ে দেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে এবং ছাত্ররা এতে প্রতিনিধিত্ব করছে। এ প্রসঙ্গে ভালো-মন্দ বিচার বিশ্লেষণের দিকে আমি বিস্তারিত যাচ্ছি না। এটুকু বলতে হয় যে, দেশের গণ-অভ্যুত্থানের হাওয়া সব জায়গায় বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজের উপরও তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর উপরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, ঐক্যের প্রশ্ন তুলছেন। যা খুবই প্রশংসনীয় এবং ইতিবাচক দিক বলা যেতে পারে। পাহাড়ি ছাত্র সমাজে এ ধরনের রাজনৈতিক কালচারটাই এখন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা পাহাড়ে ছাত্রসমাজের সর্বস্তরে হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র, কার্যক্রম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে ছাত্রসমাজের সুস্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। না হলে ৫৩ বছর ধরে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাহাড়ি জনমনে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তা গণ-আন্দোলনের দিকে ধাবিত হওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

পাহাড়ি জনগণের অধিকার আদায়ে আন্দোলনরত আমাদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফও আশা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম ভাবুক, প্রশ্ন করুক এবং সম্ভাবনাময় একটা পথ তৈরি হোক। যদিও দেখা যায়, অনেকে নানাভাবে কথা বললেও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বস্তুনিষ্ঠ ধারণা না থাকায় তারা সেভাবে গঠনমূলক আলোচনা সৃষ্টি করতে পারে না। ফলে সম্ভাবনাময় জায়গাগুলোতে জনসাধারণের জনমত তৈরির ক্ষেত্রেও তা ফলপ্রসূ হয় না।

ছাত্রসমাজের কাছে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণের ওপর রাজনৈতিক দল না রাজনৈতিক দলের ওপর জনগণ নির্ভরশীল? জনগণের ওপর যদি রাজনৈতিক দলকে নির্ভর করতে হয় তাহলে সেই রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, কর্মপদ্ধতি ও চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাত্রসমাজের এত ভয়-ভীতি কিসের? কিছুদিন পূর্বের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে বুঝতে পারব কী পরিমাণ দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে জনগণের ওপর। পুলিশ- র‌্যাব-বিজিবি-সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল বাহিনীকে জনগণের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে, মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতা কব্জায় রেখেছিল। এর পাশাপাশি খুন-গুম-অপহরণ করে জনমতকে কঠোরভাবে দমনের নীতি ছিল আওয়ামী লীগের। তারপরও ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, দমননীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদিও ভিন্ন কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো এই ক্ষমতা নেই যে, ছাত্রসমাজ কথা বলতে পারবে না, যুক্তিসঙ্গতভাবে তাদের রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনা করতে পারবে না। সাহস ও দৃঢ়তা থাকলে সর্বময় ক্ষমতাশীল ব্যক্তি কিংবা দলের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করা যায় এবং তা ন্যায়সঙ্গতও এদেশের ছাত্রসমাজ সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। ভয়-ভীতি নিয়ে চুপ করে থাকলে ২০২৪ সালে এসে গণ-আন্দোলন হত না, ছাত্রসমাজের ডাকে ছাত্র-জনতা বিদ্রোহ করতে পারত না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসেও এর নজীর রয়েছে। নব্বই দশকের ছাত্র গণ-আন্দোলন আমাদের পাহাড়ি ছাত্রসসাজের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক। অনেকে হয়তো এটা বলার চেষ্টা করবেন, নব্বই দশকে পাহাড়ি ছাত্রসমাজ এক ও অভিন্ন ছিল। ফলে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, না হলে সম্ভব হত না। কিন্তু জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান সেই ধারণাকেও মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। কেননা বাংলাদেশের সমগ্র ছাত্রসমাজেও অনেক রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। তারাও আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে গণ-অভ্যুত্থানে সমর্থন যুগিয়েছে। রাজপথে নেমে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজেও ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের ভিত্তিতে ছাত্রসমাজের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। তাই বলে সামগ্রিক স্বার্থকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ছাত্রসমাজের মধ্যে থেকেও এমন দাবির ভিত্তিতে ছাত্রসমাজকে রাজপথে নেমে আসা উচিত।

ব্যাপক জনসাধারণকে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করতে চাইলে ছাত্রসমাজকেই আন্দোলনের দায়িত্ব নিতে হবে, অধিকার আদায়ের জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কথিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কজনের মধ্যে রয়েছে এমন উদ্দীপনা ও দুঃসাহস? বিদ্যমান রাজনৈতিক বিবেচনায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল থাকলে ছাত্রসমাজ কিংবা পাহাড়ি জনসমাজে পরিবর্তন আসবে কি? এটা ঠিক যে, প্রান্তিক জনসমাজে সঠিক রাজনৈতিক দলের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করেই বিপ্লব বা বিদ্রোহের সূচনা ঘটে। কিন্তু জাতির অগ্রভাগে থাকা ছাত্রসমাজের ওপরই এর গুরুদায়িত্ব রয়েছে মানুষকে জাগানোর, আন্দোলমুখী করার। অধঃপতিত সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে, সামষ্টিক অধিকার অর্জন করতে হলে ছাত্রসমাজের ব্যক্তিস্বার্থকে বিসর্জন দেওয়ার সাহস ও মানসিকতাও থাকতে হবে। না হলে পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতদুষ্ট বাহিনী তথা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম জারী রাখা কিংবা গণ-আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার কায়েম করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এখন ছাত্রসমাজ সব বাধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে প্রস্তুত আছে কি?

*লেখক: সোহেল চাকমা
শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদকপাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More