সিএইচটিনিউজ.কম
রাজনৈতিক ভাষ্য :
৩ আগস্ট মাটিরাঙ্গার তাইন্দং-এ পাহাড়ি গ্রামে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার পর পুলিশ গতকাল পর্যন্ত ৭ জনকে আটক করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে। আটককৃতদের মধ্যে অপহরণ নাটকের মধ্যমণি কামাল হোসেনসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুব লীগ, ছাত্র লীগ ও বিএনপি-ভুক্ত যুব দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী রয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার তাদেরকে খাগড়াছড়ির আদালতে হাজির করা হলে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট তাদেরকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন।
আমরা হামলার সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে আমরা দেখতে চাই এটা যাতে লোকদেখানো ব্যাপার না হয়, ড্যামেজ কন্ট্রোল এক্সারসাইজ না হয়। আমরা চাই যারা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে তাদের বিচারের পাশাপাশি আসল ষড়যন্ত্রকারীদেরও চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা না ঘটে।
মাটিরাঙ্গার ঐসব এলাকায় পাহাড়িদের উপর হামলা নতুন কোন বিষয় নয়। এর আগে বহুবার তাদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। তার উপর রয়েছে বিজিবির নিত্যনৈমিত্ত্যিক হয়রানি ও নির্যাতন। কেবল জানুয়ারী থেকে আজ পর্যন্ত তাইন্দং ও তার আশেপাশের পাহাড়ি জনবসতিতে ৫ বার সেটলার হামলা হয়েছে। পাহাড়িরা ভয়ে বেশ কয়েকবার ভারতে কিংবা পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনকি গত ৩ আগস্ট হামলার ৩ দিন আগে ৩১ জুলাই মধ্যরাতে তাইন্দং-এর পাহাড়িরা সেটলারদের সাম্প্রদায়িক উম্মাদনায় ভয় পেয়ে বাড়িঘর ছেড়ে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এখন একটি অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্ন হলো হামলার জন্য কারা দায়ি? যে অপহরণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত বড় একটা হামলা হলো সেটা ইতিমধ্যে সাজানো নাটক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে আর বাক্য ব্যয় করা ঠিক হবে না। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ওই অপহরণ নাটক কি কামাল হোসেন একাই সাজিয়েছিলেন, নাকি তিনি অন্য কারোর বানানো স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কেবল অভিনয় করেছিলেন? তবে যেটা স্বাভাবিক তা হলো, এত বড় একটা নাটক মঞ্চায়ন কেবল একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। স্ক্রিপ্ট লেখা, সেট নির্মাণ, অভিনয়, আলোকম্পাত ইত্যাদির জন্য অনেকের অংশগ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। যদি তাই হয়, তাহলে ‘তাইন্দং ষড়যন্ত্র’ নাটকের অন্যান্য পাত্রপাত্রী ও কুশীলবরা কারা? সরকার কি ব্যাপারটির গভীরে গিয়ে এসব উদ্ঘাটন করতে আগ্রহী?
ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাক বা না থাক, সরকারের স্থানীয় প্রশাসন হামলার দায় এড়াতে পারে না। কারণ এ হামলা হঠাৎকরে হয়নি। উপরে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, ৩১ জুলাই মধ্যরাতে তাইন্দং বাজারে পাহাড়ি-বিরোধী মিছিল করে ও শ্লোগান দিয়ে সেটলাররা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এ সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামের পাহাড়িরা জঙ্গলে ও ভারত সীমান্তে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এ খবর পরদিন এই ব্লগে প্রচার করা হয়। ইউপিডিএফও এ সম্পর্কে একটি বিবৃতি দেয়। কিন্তু তারপরও প্রশাসন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো ছিল নির্বিকার, তারা যেন নাকে তেল দিয়ে কুম্ভকর্ণের ঘুমে গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। অথচ তারা যদি এ ঘটনার পর তড়িৎ ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে ৩ তারিখের ভয়াবহ হামলা অবশ্যই এড়ানো যেতো।
ঘটনার জন্য একইভাবে বিজিবিও কম দায়ি নয়। যে এলাকায় হামলা হয়েছে তার আশেপাশে কমপক্ষে ৬টি বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে আটলং, তানাক্কা পাড়া ও ফেনীছড়ায় ৩টি ক্যাম্প। দুই কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে বান্দরসিং পাড়া ক্যাম্প এবং তিন কিলোমিটার দূরত্বে দ্বিটিলা ও তাইন্দং ক্যাম্প। যে সব এলাকা থেকে সেটলাররা হামলা করতে যায় তার পাশেই রয়েছে আটলং ও তাইন্দং ক্যাম্প। এইসব ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন টহল দেয়া হয়। বলা উচিত টহলের নামে প্রায় সময় পাহাড়িদের হয়রানি করা হয়। কিন্তু যখন হাজার হাজার সেটলার এসব ক্যাম্পের পাশ দিয়ে পাহাড়ি-অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে ৪-৫ ঘন্টা ধরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, লুটপাট চালায়, নিরীহ লোকজনকে কোপায়, তখন বিজিবির টহল কোথায় ছিল? এটা ১০০ ভাগ সত্য যে তারা চাইলে বাঙালিদেরকে হামলা থেকে নিবৃত্ত করতে পারতেন, বাধা দিয়ে হামলা রোধ করতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটা করেননি। বরং অভিযোগ রয়েছে বিজিবির সদস্যরা হামলাকারীদের সহায়তা দেয়ার জন্য পাহাড়িদের গ্রামের পাশে জঙ্গলে লুকিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাই ‘তাইন্দং ষড়যন্ত্র’ নাটকে বিজিবির ভূমিকা কী ছিল সেটাও পরিস্কার হওয়া দরকার।
রাখঢাক না করে বলা ভালো, বিজিবি পাহাড়িদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। তারা পাহাড়িদেরকে এ দেশের নাগরিক মনে করে কীনা সেটাও এক বড় প্রশ্ন। এখানে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিজিবির কথা বলা হচ্ছে। ব্যক্তি বিশেষ হিসেবে সকল বিজিবি কমান্ডারের পাহাড়িদের প্রতি মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি একই নাও হতে পারে। কোন সাম্প্রদায়িক হামলা হঠাৎ করে হয় না, এটা দু’একজনের কাজ কারবারও নয়, এর জন্য উপযোগী একটি পরিবেশ বা আবহ থাকতে হয়। বিজিবি ষড়যন্ত্রের সাথে যদি যুক্ত নাও হয়, তাহলেও এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তারা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ি — মাটিরাঙ্গার অন্ততঃ গত কয়েক মাসের ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে সেটাই প্রতীয়ান হয়।
হামলার পর ভারতের মাটিতে ও দেশের ভেতরে অন্যত্র আশ্রয় নেয়া পাহাড়িরা নিজ গ্রামে ফিরে এসেছেন। তাদেরকে নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তবে ইতিপূর্বেও তাদেরকে এভাবে বহুবার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হামলা নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। তাদের জীবন থেকে সুখশান্তি ও নিরাপত্তাবোধ কেড়ে নেয়া হয়েছে। বছরের পর বছর তারা নিজ ভূমিতে পরবাসীর মতো, নিরপরাধ হয়েও কয়েদীর মতো দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থা দীর্ঘ দিন চলতে পারে না। এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতেই হবে। তাই প্রয়োজন সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ করা। অন্যায়কারীকে আপাতভাবে যতই শক্তিমান মনে হোক, সে আসলে দুর্বল। অন্যায়কারী কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। অন্যদিকে জনগণকে যতই শক্তিহীন, দুর্বল মনে হোক, প্রকৃতপক্ষে তারাই হলেন ইতিহাসের আসল নায়ক, তারাই হলেন শক্তিমান। আর তাই তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কাছে অন্যায়কারীদের অবশ্যম্ভাবীরূপে পরাজয় বরণ করতে হয়। দুনিয়ার ইতিহাসে যুগে যুগে এই সত্য বার বার প্রমাণিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও সকল অন্যায়, জুলুম, ও নির্যাতনের অবসান হবেই হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম দুনিয়া ও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের জন্য দরকার একটি আদর্শভিত্তিক পার্টি। এই ধরনের পার্টির নেতৃত্বে সংগ্রাম করলে তবেই জনগণের মুক্তি অর্জন সম্ভব হতে পারে। পার্টি ও জনগণ এক মন এক প্রাণ হয়ে কাজ করলে, সংগ্রাম করলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় ও এমনকি পরাক্রমশালী শত্র“কে পর্যন্ত কাবু করা যায়। তাই মাটিরাঙ্গার তাইন্দং-এ ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে অবশ্যই পার্টির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সরকারের দালালী করে কোন জাতি মুক্তি অর্জন করতে পারেনি, একমাত্র পার্টির নেতৃত্বে সঠিক লাইনে কঠোর সংগ্রাম করেই পৃথিবীর স্বাধীন জাতিগুলো নিজেদের অধিকার ও মুক্তি ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। [সমাপ্ত]
—-