ঢাকা : গত ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে সেনা মদদপুষ্ট সংস্কারবাদী জেএসএস ও নব্য মুখোশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলায় নিহত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা তপন, এল্টন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের নেতা পলাশ চাকমার স্মরণে গতকাল শুক্রবার (৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় সংহতি সমাবেশ ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) ঢাকা শাখা।
পিসিপি’র ঢাকা শাখার সভাপতি রিয়েল ত্রিপুরার সভাপতিত্বে বিকাল সাড়ে ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনুষ্ঠিত সংহতি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় সংগঠক নতুন কুমার চাকমা, শ্রমজীবী ফ্রন্ট( ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা, পিসিপির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি বিপুল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক বরুণ চাকমা ও পিসিপির ঢাকা শাখার সহসভাপতি শুভাশীষ চাকমা। এছাড়া সংহতি জানিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পূর্ব-৩ এর সভাপতি এডভোকেট ভুলন ভৌমিক, বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল, বিপ্লবী নারী মুক্তি কেন্দ্রের আহ্বায়ক নাসিমা নাজনীন, বিপ্লবী নারী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেত্রী আমেনা আক্তার, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এমএম পারভেজ লেলিন, ছাত্র গণমঞ্চের সভাপতি সাঈদ বিলাস, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ইকবাল কবির, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের সহ-সভাপতি বিপ্লব ভট্টাচার্য় ও ছাত্র ঐক্য ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা আল ফোরকান।
সভা পরিচালনা করেন পিসিপি ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক রিপন চাকমা। সভা শুরুতে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
সমাবেশে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) নেতা নতুন কুমার চাকমা অভিযোগ করে বলেন, খাগড়াছড়ির বর্বর হত্যাকাণ্ডটি মুখোশ-জেএসএস সংস্কারদের দিয়ে সংঘটিত করা হলেও মূলত এর অন্যতম হোতা খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের কমাণ্ডার আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। তারই পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তপন, এল্টন, পলাশরা সেনা কর্মকর্তাদের অন্যায়-অত্যাচার ও তাদের কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নেতা ভূলন ভৌমিক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন চলছে। সিভিল প্রশাসনের সেখানে কোন এখতিয়ার নেই, এমনকি বিচার বিভাগেরও। সেনাবাহিনী যা বলবে সেখানে তাই হয়। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন সমতলের মত শাসন চলবে না, কেন সেখানে সেনা শাসন চলবে?
তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। সেখানে স্থানীয়রা আমাদের জানিয়েছেন ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার পর সন্ত্রাসীরা প্রায় ১ ঘন্টা তাণ্ডব চালালেও বিজিবি ও পুলিশ কোন পদক্ষেপ নেয় নি। অথচ ঘটনাস্থলের কয়েক গজ দূরত্বে অবস্থিত বিজিবি ক্যাম্প ও পুলিশ পোস্ট। জনগণ বলেছে সেনা সহায়তা না থাকলে এত বড় ঘটনা সংঘটিত করা সম্ভব নয়। সেখানকার জনগণ আমাদের আরো বলেছে, সেখানে নব্য রাজাকার সৃষ্টি করা হয়েছে ব্রিগেডিয়ার মোতালেবের নেতৃত্বে।
তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, ব্রিগেডিয়ার আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদকে প্রত্যাহার করা এবং তাকে নিয়ে জনগণের যে সন্দেহ রয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত করা হোক। তিনি তপন-এল্টন-পলাশসহ ৭ খুনের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
কাজী ইকবাল বলেন, এই সরকার চরম ফ্যাসিবাদী। সে কারণে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের কাছ থেকে জাতীয়তাও কেড়ে নিয়েছে।
মাইকেল চাকমা নিহত তিন নেতাকে স্মরণ করে বলেন, তপন-এল্টন-পলাশ আমার কাছের ও ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের নানা গুণ ছিল। তাদের গুণাবলির কারণে এলাকার জনগণের কাছে তারা সুপরিচিত ছিলেন। যুগ যুগ ধরে জনগণ তাদের স্মরণ করবে।
তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। যারা ইউপিডিএফ নেতা মিঠুনকে হত্যা করেছে তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রই পাহাড়ি রাজাকারদের দিয়ে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করছে। পাকিস্তান সময়ে রাজাকাররা যে ভূমিকা পালন করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে ও পাহাড়িদের মধ্যকার দালালরা একই ভূমিকা পালন করছে ।
তিনি বলেন, পাহাড়ে কি হচ্ছে সমতলের মানুষ তার পৃকৃত চিত্র জানে না। শাসকগোষ্ঠি তা জানতেও দিতে চায় না। তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, নব্য রাজাকার দিয়ে হত্যা, আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টার পরিণাম শুভ হবে না। এর বিরুদ্ধে যদি জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং এতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
নাসিমা নাজনীন বলেন, সারা দেশের জনগণ নিপীড়িত। পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণ সমতল থেকে অনেক বেশি নিপীড়িত। সেখানে আন্দোলন দমনের জন্য সেনাশাসনের জারি রাখা হয়েছে এবং সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে হত্যা-গুম-অপহরণ করা হচ্ছে। পাহাড়িদের মধ্যকার কিছু মানুষ সেখানে রাজাকারের ভূমিকা পালন করছে। অন্যায়-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবাইকে এক সাথে লড়াইয়ের আহবান জানান তিনি।
আমেনা আক্তার বলেন, মানুষের নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই । এ কারণে খাগড়াছড়িতে এমন বর্বর খুনের ঘটনা ঘটেছে।
এমএম পারভেজ লেলিন বলেন, রাষ্ট্রীয় মদদে তপনদের হত্যা করা হয়েছে। এটি কোন বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। দীর্ঘ দিন ধরে সেখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধ্বংস করার উদ্দেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তারই ধারাবাহিক ঘটনা হল তপনদের হত্যা।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে একমাত্র গণতান্ত্রিক শক্তি হল ইউপিডিএফ। এই দলের নেতৃত্ব শূন্য করা ও গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব লোপ করে দেয়ার লক্ষ্যে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সাঈদ বিলাস বলেন, শাসকগোষ্ঠি সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। তাদেরকে যতভাবে শোষণ-নিপীড়ন করা যায় তার প্রচেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, স্বৈরতন্ত্র ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ।এর বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
ইকবাল কবির বলেন, পাহাড়ের দিকে তাকালে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বুঝা যায়। পাহাড়ে হত্যা নতুন কোন বিষয় নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে। শাসকগোষ্ঠি নিপীড়িত-শোষিত মানুষের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ভয়াবহভাবে। শাসকগোষ্ঠির অন্যায়ের প্রতিরোধের আহবান জানান তিনি।
বিপ্লব ভট্টাচার্য বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি পাহাড়িদের। কিন্তু তাদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বহুজাতিক রাষ্ট্র। কিন্তু শাসকগোষ্ঠি এক জাতি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে।
আল ফোরকান বলেন, খাগড়াছড়িতে বর্ণনাতীত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন সেনা শাসন চলছে, কেন আধিপত্য শাসন চলছে তার জবাব সরকার দেয়নি।
সংহতি সমাবেশ থেকে বক্তারা তপন, এল্টন, পলাশসহ ৭ খুনের ঘটনায় জড়িত দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
সমাবেশ শেষ হওয়ার পর রাজু ভাস্কর্য়ের পাদদেশে নিহত তিন নেতার ছবি সামনে রেখে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ১৮ আগস্ট সকালে খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারে সেনা-প্রশাসনের মদদপুষ্ট সংস্কারবাদী জেএসএস ও নব্য মুখোশ বাহিনীর একদল সন্ত্রাসী সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা, সহ সাধারণ সম্পাদক এল্টন চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ সভাপতি পলাশ চাকমাসহ ৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং শহরের অদূরে পেরাছড়ায় জনতার মিছিলের ওপর হামলা চালালে সেখানে এক বৃদ্ধ মারা যান।
——————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।