দীঘিনালায় গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বিশাল গণসমাবেশ

0

সিএইচটিনিউজ.কম
Dighinala4, 30 June 2014দীঘিনালা: সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের ৩ বছরপূর্তিতে আজ ৩০ জুন সোমবার বেলা ২টায় দীঘিনালায় গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উদ্যোগে বিশাল গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, বাবুছড়ায় বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন বন্ধ করা, ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা-হুলিয়া প্রত্যাহার, নির্বিচারে ধরপাকড়-হয়রানি বন্ধ করা ও গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি জিকু ত্রিপুরার সভাপতিত্বে ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক কিশোর চাকমার পরিচালায় দিঘীনালা উপজেলা সদরের মাইনী রিসোর্ট এর মাঠে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)এর কেন্দ্রীয় সদস্য দেবদন্ত ত্রিপুরা, ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অংগ্য মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাদ্রী চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি থুইক্যচিং মারমা, দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা, দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য ও কবাখালী ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বকল্যাণ চাকমা, দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য ধর্ম জ্যোতি চাকমা, দিঘীনালা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সুসময় চাকমা ও সাজেক নারী সমাজের সভাপতি নিরূপা চাকমা প্রমুখ। এছাড়া সংহতি জানিয়ে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ৪ নং দীঘিনালা ইউপি চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা ও  ৫ নং বাবুছড়া ইউপি চেয়ারম্যান  সুগত প্রিয় চাকমা।

সমাবেশে প্রায় ৫ হাজারের মতো লোক অংশগ্রহণ করেন। যুব ফোরামের দীঘিনালা উপজেলা সদস্য জীবন চাকমা সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

সমাবেশে ইউপিডিএফ এর কেন্দ্রীয় সদস্য দেবদন্ত ত্রিপুরা বলেন, সরকার জোর করে চাপিয়ে দিয়ে পাহাড়ি সহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে বাঙালি বানাতে চাচ্ছে। তিন বছর আগে শেখ হাসিনার সরকার পাহাড়ি Dighinala 3, 30 June 2014জনগণের উপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিলেও পাহাড়ি জনগণ তা মেনে নেয়নি আজকের এই সমাবেশে তা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি অবিলম্বে পঞ্চদশ সংশোধানী বাতিল করে পাহাড়ি জাতিসমূহের স্ব স্ব জাতীয়তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানান।

মিঠুন চাকমা বলেন, সরকার ২০১১ সালে পাহাড়ি জনগণকে বাঙালি বানানো হয়েছে তা আমরা মানিনা।  তিনি বলেন, আমরা দেখেছি বাবুছড়ার যত্ন মোহন কাবারী পাড়া এলাকায় পাহাড়ি নারীকে হামলা করে বন্দুকের বাট ভেঙ্গে ফেলে তা পাহাড়িরা ভেঙে দিয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশের মাধ্যমে পাহাড়িদের ন্যায্য আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার যদি জনগণের ন্যায্য দাবিতে অগ্রাহ্য করে আন্দোলন দমাতে চায় তাহলে ধৈয্যের বাধ ভেঙে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক এক জন ব্যক্তি এক একটা বুলেট পরিণত হবে।

তিনি বলেন, যদি বাবুছড়ার যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ার পাহাড়িদের ভুমি ফেরত দেয়া না হয়, যাদেরকে আটক করা হয়েছে তদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া না হয় তাহলে আগামী ৩ জুলাই দিঘীনালা থেকে বাবুছড়া পর্যন্ত মানববন্ধন করা হবে। তারপরও যদি দখল ছাড়া না হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই বিজিবি সরকারী প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমরা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হবো।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অংগ্য মারমা বলেন, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে বাঙালি বানানোর প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক মানববন্ধন করে তার প্রতিবাদ জানানো হয়েছিলা। তিনি বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনকে লংঘন করে বিজিবি জোরপূর্বকভাবে ভুমি অধিগ্রহণ করেছে। বিজিবি পাহাড়ি নারীদের উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় যারা হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের জেলে দেয়া হয়েছে তাদের জামিনের আবেদন বার বার নাকচ করে দেয়া হচ্ছে। তিনি সরকারকে হশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, পাহাড়িদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করে, তাদের নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে বিজিবি ব্যাটালিয়ন স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হলে আগামীতে আরো কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তখন সকল পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়ী থাকতে হবে।

দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য ধর্ম জ্যোতি চাকমা বলেন, গত তিন বছর আগে শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণকে উপজাতী থেকে বাঙালি জাতিতে প্রমোশন দিয়েছে। পাহাড়ি জনগণ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও সেই সংগ্রামের প্রতিনিধি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রথম বাঙালি বানিয়েছিলো। সেই সময় মানবেন্দ্র নালায়ন লারমা সংসদে বলেছিলেন, একজন বাঙ্গালী যেমন পাহাড়ি হতে পারে না, তেমনি এক জন পাহাড়ি হতে পারে হনা। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনাও তার পিতার পথ অনুসরণ করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদেরকে বাঙালি বানিয়েছে। তিনি বলেন আমাদের জাতীয়তার স্বীকৃতি না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়বো না। তিনি বিজিবি ব্যাটালিয়ন স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ করে পাহাড়িদের স্ব স্ব জায়গা ফেরত দেয়ার দাবি জানান।

দীঘিনালা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সুসময় চাকমা বলেন, যে সরকারকে আমরা বিশ্বাস ও সম্মান করে থাকি সে সরকার আমাদেরকে বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়েছে। আমাদের সংখ্যালঘু করতেই বিজিবির ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে নিরীহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠিকে উচ্ছেদ না করার দাবি জানান।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি থুইক্যচিং মারমা বলেন, তিন বছর আগে সংবিধান সংশোধন করে সরকার দেশের সবাইকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তখন থেকেই সারাদেশের ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তার জনগণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। জনগণ বাঘাইছড়ির তদেকমারা কিজিঙে সরকারের ১৪৪ ধারার জবাবে ২৮৮ ধারার কর্মসূচি দিয়েছে। সরকার জনগণের নায্য আন্দোলন দমনের জন্য নিরীহ গ্রামবাসীদের উচেছদ করে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার নির্যাতন চালাচ্ছে।  তিনি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, যেখানে পাহাড়ি জনগণকে অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, সেখানে মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে উন্নয়ন পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে সে ধরনের কোন উন্নয়ন পাহাড়ি জনগণ চায় না। উন্নয়নের নামে পাহাড়ি জনগণকে উচ্ছেদ করা হলে তা এখানকার জনগণ কিছুতেই মেনে নেবে না।

হিল উইমেন্স ফেডারশেন এর সাধারণ সম্পাদক মাদ্রী চাকমা বলেন, সরকার পাহাড়ি জাতি সমূহকে ধ্বংস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। বাবুছড়ায় বিজিবি হেডকোয়াটার স্থাপনের জমি জবরদখল করতে গিয়ে বিজিবি সদস্যরা পাহাড়ি নারী পুরুষের উপর হামলা চালিয়েছে। আহত নারীদেরকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় খাগড়াছড়ি হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। তিনি আটককৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।

Dighinala, 30 June 2014বাবুছড়ায় ভূমি দখলের শিকার পরিবারের পক্ষে রাজীব চাকমা বলেন, আমাদের জমি কেড়ে নেয়া হলে আমরা কোথায় যাবো? আমরা গরিব এবং নিঃস্ব। যে সরকার নিঃস্ব পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে সেটলার বাঙালিদের পুনর্বাসন এবং বিজিবি  ক্যাম্প স্থাপন করে সেই সরকারকে আমরা চাই না।

দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা গণসমাবেশে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের দাবির প্রতি সমর্থন জানান।

সমাবেশ থেকে বক্তারা অবিলম্বে সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে স্ব স্ব জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি, বাবুছড়ায় বিজিবি ব্যাটেলিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন প্রক্রিয়া বাতিল করে পাহাড়িদের স্ব স্ব জায়গা ফিরিয়ে দেয়া, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাতে সেটলার লেলিয়ে দেয়া ও নির্বিচারে নারীদের ওপর হামলাকারী বিজিবি-পুলশ সদস্যদের শাস্তি, ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা-হুলিয়া প্রত্যাহার, নির্বিচারে ধরপাকড়, হয়রানি বন্ধ ও গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান। এছাড়া বান্দরবানে রুমায় সেংগুম মৌজায় সেনা ক্যাম্প সম্প্রসারণের জন্য ৯৯৭ একর ও পাইন্দু মৌজা বিজিবি হেডকোয়াটারের নামে ২৫ একর ভুমি বেদখল বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন বক্তারা।

সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশস্থল থেকে শুরু হয়ে দিঘীনালা বাস স্টেশন হয়ে থানা বাজার ঘুরে লারমা স্কোয়ারে এসে শেষ হয়।
————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More