অনন্যা বনোয়ারী

“ঘোর তিমির ঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে,
জাগ্রত ছিলো তব অবিচল মঙ্গল নত নয়নে অনিমেষে “
সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে আমি প্রতিদিনের দিনযাপনে রবীন্দ্রনাথের ধার ধারি। উপরের উক্তিটি স্বদেশ পর্যায় থেকে নেওয়া। রবীন্দ্রনাথ যদি জানতেন, আজকের বাংলা স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও পীড়িত মূর্ছিত হয়ে আছে, তিনি দুঃখবোধ করতেন নাকি আশ্চর্য হতেন তা ভাবনার বিষয়।
২. গত কয়েক মাস বর্তমান পৃথিবী বায়োলজিক্যালি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত। এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বিগত অনেক বছর বাঙালি জাতি যে ধর্ষণ চর্চা, নৈতিকতার অবক্ষয় ভাইরাসে আক্রান্ত এ কথা আমরা ক’জনই বা জানি। এই বিষাক্ত ভাইরাস থেকে সমাজ, রাষ্ট্র কবে মুক্তি পাবে, তা কেবলই জানে ভবিষ্যৎ। চারদিকে নৈতিকতার এত অবক্ষয়, চারদিকে এত অন্ধকার, এই কঠিন অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ কবে মিলবে পাঞ্জেরী?
একজন চোর কিন্তু জন্ম থেকেই চোর হয়ে জন্মায় না। সে চোর হয় পরিস্থিতির জন্য অথবা পরিবারের সুশিক্ষার অভাবে। আমি আবার বলবোনা, একজন ধর্ষক, ধর্ষকে পরিণত হয় পরিস্থিতির জন্য। একজন ধর্ষক বরং নরপিশাচে পরিণত হয় পরিবারের সুশিক্ষার অভাবে। আমরা পরিবারে নৈতিকতার শিক্ষা, যৌন শিক্ষা সন্তানদের দেই না । নারীরাও যে মানুষ, তাদেরও যে একজন পুরুষের সমান বেঁচে থাকার অধিকার আছে, এ কথা কয়টি পরিবার তাদের সন্তানদের শেখায়?
আমরা বর্তমানে একটা মেন্টাল ট্রমার ভেতর যাচ্ছি। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র সবখানেই এক নিরব প্যারাসাইটের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। আমরা কি এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাইমারী লেভেল থেকে নৈতিকতার শিক্ষা চ্যাপ্টার/সাবজেক্ট থাকা খুবই জরুরি। কাউন্সেলিং এর খুবই প্রয়োজন। ঘরে-বাইরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এর শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন। একজন নারী বলেই কি এই বিচারহীনতার দেশে এইসব দৃশ্য নারীদের দেখতে হবে?
আমি লজ্জিত, যে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নারী, সে দেশেই দেশের ৯০% নারী শারীরিক বা মানসিক নিপীড়নের শিকার। ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় কেউই এই নিপীড়ন থেকে বাদ যায় না। যে নারীরা দেবী দূর্গার মতো ঘর সামলান, অফিস-আদালত সামলান উনারাও বাদ যান না। যারা এই ঘটনা ঘটায় তাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী পরিবার। পরিবার থেকেই দায়িত্ব নিয়ে এদের সাইকোলজিস্ট এর কাউন্সেলিং দেওয়া এই কঠিন সময়ে খুব বেশি প্রয়োজন। যারা মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ তাদের এখনই ঠিক না করলে ভবিষ্যতে এর ফলাফল আরোও খারাপের দিকে যাবে। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে, ‘প্রিভেনশন ইজ ব্যাটার দেন কিউর’ অর্থাৎ রোগের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। এ প্রবাদ বাক্যটি কয়টি পরিবার হৃদয়ঙ্গম করতে পারে?
৩. আমার জানা মতে, আমাদের গারো ভাষায় ‘ধর্ষণ’ শব্দের কোনো আভিধানিক রূপ নেই। আমাদের গারো সমাজে এর সাথে কেউই পরিচিত ছিলো না। পাহাড়ে-সমতলে, সমানতালে আমার আদিবাসী মা-বোনেরা বাঙালিদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে। এর বিচার চেয়েও ন্যায় বিচার মেলে না। আদিবাসীরা কি মানুষ না? এদেশের নাগরিক না? বাঙালিদের কাছে আদিবাসী এলাকা কিংবা পাহাড় কেবলই ভোগের ব্যাপার, সৌন্দর্যের টানে সবাই ছুটে আসে। এই পাহাড় কেবলই সরকারের আয়ের উৎস। পর্যটনকেন্দ্রের নামে ধ্বংসযজ্ঞ। কিন্তু কেউ কি পাহাড়ের কান্না কান পেতে শুনেছেন? ধর্ষণের শিকার মা-বোনের কান্না? আমরা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, চোখের জল শুকিয়ে ফেলেছি। আমরা কি এই বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম? এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বোধয় বলেছিলেন-
“সাত কোটি মানুষের হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছো বাঙালী করে, মানুষ করো নি।”
রাষ্ট্র কি ভুলে গেছে, ১৯৭১ সালে আদিবাসীরাও বাঙালীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। আর আজ স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও আদিবাসীরা বড় অসহায়। নিজ ভূমিতে পরবাসী। বিচারহীনতার দেশে বড় অসহায়। অসহায় অবস্থায় আবেগে বলে ফেলি, এদেশে আইন থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ নেই এবং আমরা জনগণও আইনকে সন্মান দিতে শিখিনি।
৪. আমাদের নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, নিজে যদি না পাল্টাই, দেশ পাল্টাবেনা। সবার আগে আমাদের সবারই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। আমি অনেক বেশি আশাবাদী। আমাদের পরিবর্তনের দিন আসবেই। হাতে হাত মিলিয়ে ‘ধর্ষণ চর্চা’ নামের অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই হবেই। এই বলয় থেকে আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে সমাজকে রক্ষা করতে হবে। সবশেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে চাই, ‘সংকোচের বিহ্বলতায় হইয়ো না ম্রীয়মান, মুক্ত করো ভয়’।
লেখক: বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী
* জনজাতির কণ্ঠের স্যেজন্যে