নানিয়াচর॥ রাঙামাটির নানিয়াচরে আর্য শ্রাবক মহান সাধক শ্রদ্ধেয় বনভান্তের এক প্রধান শিষ্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রত্নাঙ্কুর বনবিহারে বিহারে ধর্মীয় পবিত্রতা নষ্ট করে সেনা তল্লাশীর ঘটনায় জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই তল্লাশী অভিযান চালানো হয়। নানিয়ার সেনা জোনের কমাণ্ডার লে. ক. বাহালুল আলম ও থানার ওসি কবীর হোসেন এতে নেতৃত্ব দেন। শতাধিক সেনা ও পুলিশ সদস্য এতে অংশ নেন।
এ সময় বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষু ও শ্রমনদের বের করে দেয়া হয়। অভিযান শুরুর আগে সকাল ১০টা থেকে সেনারা বিহার এলাকা ঘিরে রাখে এবং দুপুর দেড়টার দিকে বিহারের বাউন্ডারীতে প্রবেশ করে।
তল্লাশী অভিযানের জন্য সেনাবাহিনী বিহার অধ্যক্ষ শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবিরের অনুমতি চাইলে তিনি এতে সায় দেননি। ধর্মীয় ও বিহারের পবিত্রতা নষ্ট হবে বিধায় তিনি আর্মিদের তল্লাশী না করতে বারণ করেন।
কিন্তু তার নিষেধ অমান্য করেই সেনারা জোর করে অস্ত্রসহ ঢুকে বিহারের ভেতরে প্রত্যেকটি রুমে তল্লাশী চালায়। তারা ভান্তে ও শ্রমনদের বিছানাপত্র, চীবর, তোষক, আলমারী ইত্যাদি সবকিছু ওলটপালট করে দেয়।
তবে দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ ভান্তের থাকার রুমটি তালাবদ্ধ থাকায় সেটা সেনারা চেক করতে পারেনি। ভান্তে বিহারের বাইরে একটি কুটিরে ভাবনারত ছিলেন।
১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রত্নাঙ্কুর বনবিহারে ১১ জন ভিক্ষু ও ২১ জন শ্রমন থাকেন। তাদের প্রত্যেককে বিহার থেকে বের করে দিয়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বিহারের ৬ জন সম্মানিত ভিক্ষু শ্রীমৎ করুণানন্দ, আর্যনীতি, শুভস্মৃতি, রত্নদ্বীপ ও আর্যধম্মা বাইরে ফাঙে (আমন্ত্রণ) ছিলেন। বিকেল ৫-৬টার দিকে তারা ফিরে আসলে তাদেরকেও বিহারের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
সেনা ও পুলিশ সদস্যরা ভিক্ষু ও শ্রমণদের সাথে চরম অসৌজন্যতামূলক ও অসম্মানজনক আচরণ করে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আকবর তাদেরকে ‘এই শালা’ ‘এই ছেলে’ বলে গালি দিয়ে ‘তাড়াতাড়ি বের হতে’ হুকুম দেয়।
বিহারে আগামী ১ ও ২ নভেম্বর কঠিন চীবর দানোৎসব হওয়ার কথা রয়েছে। এ জন্য সেখানে প্রতিদিন স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করতে যায়। তল্লাশীর সময় বিহারে কাজ করতে যাওয়া লিখন চাকমা ও টুকুমনি চাকমাকে সেনারা গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
একজন সেনা তাদেরকে বলে ‘বাইরে থেকে এখানে মানুষ ঢুকেছে। তারা কোথায় দেখিয়ে দাও, না হলে গুলি করে মেরে ফেলবো।’
হেলেনা চাকমা নামে একজন অষ্টশীল পালনকারী মহিলার সাথেও সৈন্যরা অশোভন আচরণ করে। ‘চীবর নিয়ে এখানে সন্ত্রাসী আছে, তাদেরকে দেখিয়ে দাও, নাহলে অসুবিধা হবে’ বলে তারা তাকে হুমকি দেয়।
তল্লাশীর কারণে দায়কদায়িকাদের ধর্মীয় কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। তারা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে ভিক্ষুদের বিকেলে পানীয় দান করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া ভিক্ষুদের প্রতিদিনের কাজেও ব্যত্যয় ঘটে। তল্লাশীর কারণে তারা সান্ধ্য প্রার্থনা ও ভাবনা করতে পারেননি।
বিনা অনুমতিতে বিহারের পবিত্রতা নষ্ট করে তল্লাশীর ঘটনায় জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। বিহার পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, এটাকে আমি ধর্ম ও ধর্মাচারণের ওপর একটি আঘাত বলে মনে করি।
তিনি বলেন কোন কারণ ছাড়াই তল্লাশী চালানো হয়েছে। এতে বিহারের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন বিহারে অস্ত্রসহ প্রবেশ নিষিদ্ধ। জুতা ও টুপি বা মাথায় কাপড় দিয়ে ঢোকাও মানা আছে। আর্মিরা জুতা ও মাথার টুপি খুললেও অস্ত্র বহন করে তল্লাশী চালিয়েছে। এটা মোটেই ঠিক হয়নি।
আর্মিরা কোন সমস্যা থাকলে তল্লাশী না করে বিহার পরিচালনা কমিটির সাথে আলোচনা করতে পারতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
আবাসিক ভিক্ষু করুণানন্দ ভান্তে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘অপরাধী খোঁজার নামে বিহারে ঢুকে এর পবিত্রতা নষ্ট করা হয়েছে, যা মোটেই ঠিক হয়নি। এটা ধর্মীয় আঘাত বা পরিহানি ছাড়া আর কিছু নয়।’
নানিয়াচর সদর ইউপির মেম্বার ও বিহার পরিচালনা কমিটির সদস্য অনিতা চাকমা বলেন, যে ভান্তেদের আমরা শ্রদ্ধা করি, তাদেরকে এভাবে অপদস্থ করা, বিহার থেকে বের করে দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা – এটা আমি কোনভাবে মেনে নিতে পারি না।’
এত তল্লাশীর পরও বেআইনী কোন কিছু বা কোন সন্ত্রাসী বা অপরাধীর খোঁজ না পেয়ে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা রাত ৮টার পর ক্যাম্পে ফিরে যায়।
——————
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।