মতামত

নারী সমাজের সংগ্রামের প্রতীক পাহাড়ি কন্যা কল্পনা চাকমা

0

কল্পনা চাকমা। ফাইল ছবি


সোহেল চাকমা



ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে যেভাবে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সমগ্র বিশ্বকে চমকে দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন, যেভাবে প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন, যেভাবে চাকমা রানী কালিন্দী পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ অধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, যেভাবে বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ে টঙ আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহে কুমুদিনী হাজং নেতৃত্ব দিয়েছেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার যুগে কল্পনা চাকমা এমনই একজন সংগ্রামী যোদ্ধা যার প্রতিটি কথায় পাহাড়ের রক্ত গোলাপ ফুটে। শাসকের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠস্বর পাহাড়ের প্রতিটি মানুষকে প্রেরণা যোগায়। যেখানে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ভীত হয়ে পড়ে সেখানে কল্পনা চাকমা’র চেতনা নক্ষত্রের মতন উজ্জ্বল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যেখানে ভোগ বিলাসী জীবনের সন্ধানে তরুণ প্রজন্ম মুখ লুকোয়, নারীরা স্বজাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ঘৃণার চোখে প্রত্যাখান করে নিজেকে সঁপে দেয় দাসত্বের কাছে, সেখানে কল্পনা চাকমা আজও সেনা-শাসকগোষ্ঠীর আতঙ্কের নাম।

১৯৯৬ সালের ১২ই জুন, ঘনঘটা রাত নেমেছিল পুরো পাহাড় জুড়ে। সেদিন সমতলের মানুষ মগ্ন ছিল নির্বাচনের নেশায়। কজইছড়ি ক্যাম্পের একদল সেনা যার নেতৃত্বে ছিলেন লে. ফেরদৌস, সঙ্গে ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার সালেহ আহম্মেদ ও ভিডিপি নরুল হক। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৭ ঘন্টার পূর্বে কল্পনা চাকমাকে বাঘাইছড়ি নিউ লাল্ল্যেঘোনা নিজ বাড়ি থেকে লে. ফেরদৌস গঙ অপহরণ করে। মধ্যরাতে অপহরণকারীরা ঘরের দরজা ভেঙে আতঙ্কগ্রস্থ মা ও দুই বড়ভাইয়ের কাছ থেকে কল্পনা চাকমা’কে ছিনিয়ে নেয়। দুই ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা এবং ক্ষুদিরাম চাকমাকেও চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে অজানা গন্তব্যে নেয়ার পথিমধ্যে এলাকাবাসীকে ভীত সন্ত্রস্ত করতে ও হত্যার উদ্দেশ্যে যখন লে. ফেরদৌস ব্রাশ ফায়ারের নির্দেশ দেয় তখন কল্পনার দুইভাই কোনমতে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু তারা বোনকে রক্ষা করতে পারেননি। বোন হারানোর বেদনা নিয়ে এখনো অধিকারহীন নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণের একজন হয়ে সমাজে বসবাস করছেন। আর মাত্র দুইদিন পর কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৯ বছর পূর্ণ হবে, অথচ এই রাষ্ট্র চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌসকে গ্রেফতার করতে পারেনি। সরকারের নাকের ডগায় বসে ফেরদৌস সাহেব দিব্যি ভোগ বিলাসী জীবনযাপন করছেন।

’৯৬ সালে চাঞ্চল্যকর কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা যখন ঘটে, তখন দেশে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও হাবিবুর সরকার কল্পনা অপহরণের ঘটনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ন্যূনতম কোন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বিচার করা তো দূরুহ ব্যাপার! যা নিপীড়িত নির্যাতিত জনগণের ইতিহাসে এক আলোচিত ঘটনার জন্ম দেয়। সেবারের নির্বাচনে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কল্পনা চাকমার অপহরণের ঘটনাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে তারাও পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে। লে. ফেরদৌসকে প্রমোশনের মসনদে বসিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুব কর্তৃক কল্পনা অপহরণের ঘটনাকে প্রথমে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার বললেও পরে তারা ঘটনার সাথে সেনাবাহিনী জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে আসছে।

চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী রাঙামাটিসহ বেশ কিছু এলাকায় কল্পনার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদানের ফলশ্রুতি সম্বলিত প্রচারপত্র হেলিকপ্তার থেকে ছিটিয়ে দেশের জনগণকে রম্যনাটক দেখায়। দুর্বল স্ক্রিপ্ট নিয়ে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী সামান্য একজন লেফটেন্যান্টের জন্য অপহরণের ঘটনাকে প্রশ্রয় দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে দৃষ্টতা প্রদর্শন করে। যা দেশের আপামর জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার যোগ্যতা হারানোর পাশাপাশি সেনাবাহিনী কার্যত অপরাধে সামিল হয়। দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা না নিয়ে রাষ্ট্রও নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব মিডিয়া সেল আইএসপিআরের মাধ্যমে কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনাটি নিয়ে চরম মিথ্যাচার করে অপহরণের দায় থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছে।

অপরদিকে, সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে জেএসএস সন্তু লারমা খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আওয়ামী সরকারের কাছে অস্ত্রসমর্পনের সময় কল্পনা চাকমা অপহরণকে বিতর্কিত ঘটনা বলে মন্তব্য করেন। সন্তু লারমা জেএসএস’র এমন নাটকীয় অবস্থান পুরো পাহাড়কে সেনা আঁখড়ায় রুপান্তরিত করেছে। শত বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারণা সত্ত্বেও অপহরণের ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। দেশ ও আর্ন্তজাতিকভাবে প্রবল প্রতিবাদের মুখে আওয়ামী সরকার তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। চবি সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. অনুপন সেন ও তৎকালীন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারও এ কমিটির সদস্য ছিলেন। সরকারের কাছে এ কমিটি তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়। অপহরণের দীর্ঘ ২৯ বছরে কত সরকার রদবদল হলো কোন সরকারের আমলেই কল্পনা চাকমার রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।

চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গঙদের রক্ষা করতে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৩ এপ্রিল কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি রাঙামাটির কোর্টে খারিজ করে দেয়া হয়েছে। অপরাধীদের দায়মুক্তির রায় দিয়ে দেশের আইন-আদালত পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে মসকরা করার পাশাপাশি একপাক্ষিকভাবে অপহরণকারীদের পক্ষ নিয়েছে। পাহাড়ি জাতিসত্তার জনগণ অপরাধীদের এ দায়মুক্তির রায় মানে না, মানবে না। যেখানে দেশের আইন-বিচার অপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করে, জাতিসত্তার জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের স্টীম রোলার জারী রাখে সেখানে সংগ্রামই একমাত্র ন্যায়সঙ্গত কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।

বলাবাহুল্য, ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় বটে। ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশের কৃষক-শ্রমিক-জনতার গণআকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জীবনের নিরাপত্তা, আইন-বিচার ও ভাত কাপড়ের নিশ্চয়তা। কিন্তু ক্ষমতা পালাবদলের মতো ইউনুস সরকারও ফ্যাসিস্ট মনোবাঞ্ছায় রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার না করে পূর্বেকার শাসন-শোষণের সব ব্যবস্থা জিইয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। ক্ষমতার স্বাদ পেতে দেশের বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কেন্দ্রীক রাজনীতিতে মশগুল রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ ৫ দশকের অধিক সেনা বলয়ে থাকা পাহাড়ি জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি।

অভ্যুত্থান পরবর্তী খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সেনা-সেটলার কর্তৃক জাতিগত হামলা, বম-জাতিসত্তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন ও কারাগারে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যা, চিংমা খেয়াংকে ধর্ষণের পর হত্যা, অব্যাহত ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ন, অন্যায় আটক, ধরপাকড়, ভূমি বেদখল কিংবা সেনাশাসন কোনটাই বন্ধ হয়নি। উল্টো রাষ্ট্রীয় ম্যান্ডেটে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিসত্তার জনগণের ওপর নিপীড়নের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১০ ভাষাভাষী ১৫টি জাতিসত্তার সাথে একপ্রকার তামাশা ছাড়া কিছুই নয়।

সুতরাং, বিচার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান সরকারকে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী অপরাধী লে. ফেরদৌসকে গ্রেফতার করতে হবে এবং কল্পনা চাকমার সন্ধান দিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক নেতিজেনদের কাছে জবাবদিহির মাধ্যমে অর্ন্তবর্তী সরকারকে অপরাধীদের পক্ষ নেওয়া ভুল প্রমাণ করতে হবে।

জুলাই আন্দোলনের পরে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে যে হারে নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ বেড়েছে, যেভাবে মব জাস্টিসের নামে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে তাতে কল্পনা চাকমা পুরো নারী সমাজের আন্দোলনে সংগ্রামের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নব্বই দশকের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী জাগরণের এক সাহসী ভূমিকার নাম কল্পনা চাকমা। স্বজাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামিল না হয়ে শাসকগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেয়া প্রতারকদের কাছে, বিলাসবহুল ও আরামদায়ক জীবন প্রত্যাশী নারীদের কাছে কল্পনা চাকমা আগ্নেয়গিরি লাভা থেকে বিস্ফোরিত এক অগ্নিখন্ড, যা বৈষয়িক সুখকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জাতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্নিমশাল জ্বালায়। শাসকের শৃঙ্খল ও দাসত্বের কাছে নত না হওয়া এক আশা-আকাঙ্ক্ষার নাম কল্পনা চাকমা। তিনি নারীদের সমগ্র অধিকার ও পাহাড়ি জাতিসত্তামূহের প্রাণের দাবী পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্ধত সেনা রাইফেল ও হুমকি তোয়াক্কা না করে বজ্রকন্ঠে জেগে ওঠা বর্তমান নারী সমাজের আইকন।

রণাঙ্গনের সারিতে সৈনিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তৎকালীন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘‘নারী কোন পণ্য সামগ্রী নয়, কারোর ভোগের জিনিস নয়, কারোর ব্যবহারের জিনিস নয়, কারোর খেলার পুতুলও নয়। কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রও নয়, নারীও একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা থাকতে হবে। আমরা এইসব নিপীড়ন নির্যাতন আর নীরবে সহ্য করবো না। এইসব ধর্ষণ, হত্যা, শ্লীলতাহানী এই নির্মম অবমাননা আর নীরবে হজম করতে দেয়া হবে না। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াবোই দাঁড়াবো। তাই বোনেরা- জেগে ওঠুন, শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলুন, আমাদের অধিকার একদিন প্রতিষ্ঠা হবেই হবে।”

সোহেল চাকমা, এজিএস, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More