নারীর অংশগ্রহণ না থাকলে সংগ্রাম কোনদিন সফল হবে না : চাকমা রাণী ইয়েন ইয়েন
[গত ১৮ অক্টোবর ২০১৭ রাঙামাটির কুদুকছড়িতে অনুষ্ঠিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের রাঙামাটি জেলা শাখা ও ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির যৌথ কাউন্সিল ও আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়ে চাকমা রাণী ইয়েন ইয়েন যে বক্তব্য দেন তার ট্রান্সক্রিপ্ট বা লিখিত রূপ প্রকাশ করা হলো। ট্রান্সক্রিপ্টের হেডলাইন ও সাব হেডলাইনগুলো আমাদের দেয়া। – সম্পাদক]
আমি সবাইকে নমস্কার জানাচ্ছি। আমি ভালভাবে চাকমা ভাষা পারি না। আমি চেষ্টা করতে পারি কিন্তু আপনাদের ভাল লাগবে না। তাই, বাংলায় বলতে চাইছি। সবাইকে নমস্কার, সবাইকে শুভেচ্ছা আজকের এই কাউন্সিল অধিবেশনে।
আমি নিরুপা’দিকে অনেক ধন্যবাদ জানাই আমার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার জন্য। আমি তিন সংগঠনকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই, বিশেষ করে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই, যাদের মনে হয়েছে যে আমি আসলে ভাল হয়। এই যে আমার জন্য একটা সুযোগ করে দেওয়া, আপনাদের সাথে কথা বলা ও মত বিনিময় করার জন্য সুযোগ — এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আমি নিরুপা দি’র সাথে কথা বলছিলাম যে, এ ধরনের সুযোগ আমার আসলে অতীতে কখনও হয়ে উঠেনি। আমি রাঙ্গামাটিতে এসেছি সাড়ে তিন বৎসর হল মাত্র। রাজনীতি বলেন, রাজনৈতিক কর্মকান্ড বলেন, এই ধরনের অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতি বেশি দিনের নয়। আপনারা মাঠে কাজ করেন, মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন; আপনাদের কাছ থেকে বরং আমার শেখার অনেক কিছু আছে। সেজন্য আমি ধন্যবাদ জানাই এই তিন সংগঠনকে, আপনাদের কাছ থেকে আমাকে শেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
এই পার্বত্য চট্টগ্রাম আমার
আমি বিভিন্ন পর্যায় থেকে যা শুনি ও পর্যবেক্ষণ করি সেই ধরনের প্রোগ্রাম প্রত্যক্ষভাবে দেখার ও শোনার এইটা হচ্ছে আমার একটা বড় সুযোগ। আমি জানি যে, এই প্রোগ্রামের দুই বার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে এবং জেলা প্রশাসন অনুমতি দেয়নি। তো আমরা জানি প্রশাসন অনুমতি দেবে না। বিভিন্ন রকমের তালবাহানা করবে। বিভিন্ন রকমের কারণ দেখাবে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রোহিঙ্গা সংকট চলছে ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে বাধা প্রদান করার চেষ্টা করবে। তো আপনারা জানেন, লংগদুর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা সর্ম্পকে। আমার আগে যারা বক্তব্য দিয়েছেন তারাও লংগদুর ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন। লংগুদু ঘটনার পর আমি সেখানে গেলাম। আমাদের একটা এনজিওর কাজ ছিল। আমার মনে হয় ওখানকার মানুষের অবস্থা জানা দরকার এবং কি করা যায় সামনে, সেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কি করা যায়, দেশে কি করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য গিয়েছিলাম আমি। তখন প্রশাসন আমাকে যে কথাটি বলেছে যে, ওখানে ইউএনও ছিলেন, ওখানকার ওসি ছিলেন, ওখানকার আর্মির জোন কমান্ডার ছিলেন। ওনাদের কথাটা হচ্ছে যে, আমি কেন তাদেরকে জানিয়ে গেলাম না। আমার তো জানিয়ে যাওয়ার ছিল তাদেরকে, হ্যাঁ। আমি তখন তাদের একটা কথা বলেছিলাম এবং এ কথাটা আজকেও আমি বলতে চাই — যদি তারা উপস্থিত থাকতেন খুবিই ভাল হতো। আমি তাদেরকে একথাটি বলেছিলাম এবং নিরুপাদিকে মেসেসের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলাম কথাটা। সেটা হচ্ছে এই রাঙ্গামাটি হচ্ছে আমার রাঙ্গামাটি, এই পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে আমার পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এই রাঙ্গামাটির প্রত্যেকটা এলাকা, জমি, আমার জমি। এখানে যত আদিবাসী আছে যা আপনাদের ভাষায় জাতিগোষ্ঠী, জাতিসত্তা, যত জাতি সত্তা আছে আমার ভাষায় আদিগোষ্ঠী আছেন, আদিবাসী গোষ্ঠী আছেন, সে জাতিগোষ্ঠী চাকমা হোক, মার্মা হোক, ত্রিপুরা হোক, তারা সবাই আমার পরিবার, আমার ভাই, আমার বোন। তারা সবাই মানুষ। আমার আপন মানুষ। আমি যেখানে খুশি রাঙ্গামাটির যে কোন কর্ণারে হোক, পাহাড়ের উপরে হোক, লেকের ধারে হোক, যেখানেই আমি ইচ্ছে পোষণ করি, আমি তাদের সাথে কথা বলার অধিকার রাখি। সেটা দশ জন মানুষের সাথে হোক, হাজার মানুষের সাথে হোক, সেটা পঞ্চাশ জন মানুষের সাথে হোক, তারা ইউপিডিএফ করুক, তারা জেএসএস করুক, তারা জেএসএস সংস্কার করুক, তারা সবাই আমার মানুষ এর চেয়ে বড় কিছু নেই। তারা আমার ভাই, আমার বোন। তখন তারা কিছুই বলতে পারেননি। তাদের একটা কথা ছিল যে, আমি যেহেতু রাণী এবং তারা যেহেতু প্রশাসনের মানুষ, তারা আমাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারেন নি। এটা তাদের একটা অজুহাত ছিল যে, আমি কেন তাদেরকে জানিয়ে যাই নি। কেন জানিয়ে যাই নি সেজন্য তারা একটা অজুহাত বের করেছে। আমি তাদেরকে বললাম যে, কি ধরনের সম্মান আপনারা আমাকে দেখাতে চেয়েছেন? বলেছেন আপনি যে কাজে আসছেন আমরা আপনাকে মানুষ সাপ্লাই দিতাম, মানুষ জন আপনাকে সহায়তা করতো।
আমি বললাম,আমার সাথে পনের জনের মত মহিলা আছেন। লংগদুর লংগদুবাসী আছেন। পনের জন মহিলা আমার সাথে রয়েছে। আমার সাথে আরও দশ জন পুরুষ আছেন। আমার আর কি সহযোগিতা দরকার? আপনাদের কাছ থেকে আমার কি সহযোগিতা দরকার? তারা বললেন, আপনি অনেক দূর থেকে হেঁটে আসছেন। বাজার থেকে আপনার জন্য আমরা একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করতে পারতাম। আপনার সম্মান বাড়তো। আমি বললাম, মানে আমার মানুষদের সাথে আমি হাঁঁটছি এটে আমার সম্মান বাড়বে না। আমি গাড়ীতে করে ডুম করে চলে গেলাম হাত নাড়াতে নাড়াতে তাতে আমার সম্মান বাড়বে আপনারা কি তা মনে করেন? তখন উনি বললেন, সরি ম্যাডাম, আপনার সাথে মনে হয় আমি কথায় পারবো না। আমি তাকে বলেছি, দয়া করে আপনি একটু চুপ থাকেন। আমি লংগদুবাসীর সাথে একটু কথা বলতে চাই। হ্যাঁ, আমার মান-সম্মান নিয়ে আপনাদের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে না।
বৈষম্য ভাঙতে হবে
এই সম্মানের বিষয়ে আমরা যখন লাল বই পড়েছি তখন বুঝতে পেরেছি। লেনিন, মাও সেতুং ওনাদের কথাই বলি এবং আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলি, বড় লোকেরা থাকবে এভাবে। উচ্চ বিত্তরা থাকবে এভাবে। যারা মাঠে কাজ করে জীবন নির্বাহ করে কৃষক তারা থাকবে অন্য এক জায়গায়। আমাদের সাথে যারা আছেন, তারা থাকবেন আরেক জায়গায় তা কি হয়? আপনারা আমাকে সম্মান দেবেন, উচ্চ বিত্ত শ্রেণীর মানুষদেরকে সম্মান দেখাতে হবে। এই শ্রেণী বৈষম্যকেই ভাঙ্গার কথা আপনারা বলেন। এই ধরনের বৈষম্য তো ভাঙ্গার কথা আমিও চিন্তা করি। এই শ্রেণী বৈষম্য ভাঙ্গতে হবে। আমরা মাঝেমধ্যে বুঝি না যে, প্রশাসন যে জিনিসগুলো আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটুকু কাজে লাগে? গুনী মানুষের সম্মান বিভিন্নভাবে দেওয়া যায়। তাকে গাড়ীতে করে এনে তাকে মাথায় তোলার দরকার নেই। আসলে দরকার নেই। যিনি সম্মান পেতে জানেন তাকে আপনারা অবশ্যই মন থেকে সম্মান করেন, সম্মান দেবেন।
সমাবেশ ছোট হল, নাকি বড় হল সেটা নিয়ে চিন্তা করার আর কোন কারণ নেই
গতকাল দিদি যখন আমাকে বলছিলেন যে, অনেক বড় একটা সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। এবং এই সমাবেশ হতে পারছে না বলে কি আপনারা দুঃখ করছেন? তখন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি একটি কথা ভাবছিলাম। নিরুপা দিদিকে বলছিলাম যে, সমাবেশ কি হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হলে সমাবেশ হয়? ব্যানার, প্লেকার্ড এগুলো কি থাকতে হবে? ব্যানারটা সুন্দর করে লেখা হলো কি হলো না সেটা নিয়ে সমাবেশের উদ্দেশ্য কি আসলে পূরণ হয়? এই যে আমরা এখানে হাজার মানুষ জমায়েত হতে পারিনি, পাচঁশ’ মানুষ হতে পারিনি, আমরা মাত্র এখানে একশ’ জন জমায়েত হয়েছি। কিন্তু আমি একশ’ জনের চিন্তা-ভাবনা শুনতে পারবো। এখানে যারা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আছেন ওনাদের কথা আমি শুনতে পারছি। আমরা এখানে মত বিনিময় করার একটা সুযোগ পেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়, বড় সমাবেশের চেয়ে এ ধরনের সমাবেশ বেশি জরুরি। এখানে আসলে আমরা কথা বলতে পারছি। এখানে আমাদের শ্রেণীর ব্যাপারটা রয়ে গেছে। আমি বড়, তুমি ছোট, তুমি এখানে থাকো, আমি এখানে বসি। এ ধরনের জিনিসগুলো যখনি ভেঙ্গে যাবে তখন আমি মনে করি, সেই ধরনের সমাবেশ আরও বেশি ফলপ্রসু হবে। আমরা যে উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাই সে ধরনের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মনে হয় এ ধরনের ছোট ছোট সমাবেশই ভাল। আর আমরা যদি একশ’ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারি, এখানে যদি আমরা হাজার মানুষ থাকি এবং তারা যদি আমার একটা কথাও না বুঝে এবং একশ’ মানুষও যদি আমার কথা বুঝতে পারে এবং একশ’ মানুষকে যদি অুনপ্রাণিত করতে পারি তাহলে আমার মনে হয় যে, সে সমবেশটা আসলে আসল সমাবেশ। তো আমার মনে হয় যে, সমাবেশ ছোট হল নাকি বড় হল সেটা নিয়ে চিন্তা করার আর কোন কারণ নেই।
রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে
আমি খুশি, আমি খুবই আনন্দিত। আমি আপনাদের কাছে আসতে পেরেছি। আপনাদের চিন্তাধারা ও স্বপ্নকে আমি জানতে পেরেছি। একটি কথা আমার মনে হয় বলা দরকার। আর সেটি হচ্ছে, ধরুন, আমরা রাশিয়ার কথা বলি, অনেক রকমের ইতিহাসের কথা বলি। হ্যাঁ, ইউরোপে এটা হয়েছে। ইউরোপে এ ধরনের আন্দোলন হয়েছে, এ ধরনের বিপ্লব হয়েছে। আমেরিকাতে এ ধরনের বিপ্লব হয়েছে। জার্মানিতে এ ধরনের কথা-বার্তা হয়েছে। এগুলোর ভালো ও মন্দের দিক রয়েছে। আমরা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলছি এবং আমাদের অনুপ্রেরণার দরকার আছে। আমাকে ভুুল বুঝবেন না। অনুপ্রেরণার দরকার আছে। কিন্তু আমরা যাদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলি, তারা কি আসলে এ কথাগুলোর সাথে নিজেদের বাস্তবতা মিলাতে পারে? আমি এটি নিয়ে খুবই শংকা প্রকাশ করি, আমি আসলে খুবই শংকিত। আমি যখন বিভিন্ন রকমের মিটিং-এ যাই, এরকম বড় সমাবেশে যাই, অনেককে অনেক কথা বলতে শুনি এবং সব কথাই আমি জানি, আমি বুঝি। আমার পক্ষে বুঝা সম্ভব কারণ আমি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ। হ্যাঁ, আমি অনেক বই পড়েছি। আমি বিদেশে পড়াশুনা করেছি। আমি এগুলো জানি। উনারা যে কথাগুলো বলতে চান আমি সে কথাগুলো বুঝতে পারি। আমি সে কথাগুলো ধারণ করতে পারি। উনারা যখন এ কথাগুলো বলেন এবং কথাগুলো জুমিয়া পরিবারের জন্য বলেন এবং কথাগুলো আমজনতা, যারা জুমে, ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন তাদের জন্য বলেন। তাদেরকে উজ্জীবিত করার জন্য বলেন। হ্যাঁ, তারা আসলে কি বুঝতে পারে? তারা কি লাল বইয়ের মর্ম বুঝতে পারে? ঐ সময়ে কবে কি হয়েছিল সেটা কি তারা তাদের বাস্তবতার সাথে মেলাতে পারে? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তারা পারে না। আমার আসলে মনে হয় পারে না। এই জায়গাতে আমার মনে হয় একটা চিন্তার ঐক্যের দরকার আছে। আমরা যদি আমাদের জুমিয়া পরিবারের মানুষদেরকে উজ্জীবিত করতে চাই, তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে চাই। তাহলে, আমাদেরকে তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে। যদি মার্মা হয় মার্মা ভাষায় কথা বলেন, যদি চাকমা হয় চাকমা ভাষায় কথা বলেন, যদি ত্রিপুরা হয় ত্রিপুরা ভাষায় কথা বলেন। আর যদি তারা নারী হয়, তারা যদি মহিলা হয়, মহিলাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সে কথাটি বলতে হবে। কারণ মহিলাদেরকে যে ধরনের বৈষম্য, বঞ্চনার শিকার হতে হয়, নিজেদের সমাজে যে রকম হয় সমাজের বাইরেও তারা বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার হয়। সে ব্যাপারে কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারে। কারণ তারা ভুক্তভোগী। তাদের সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কথাটা বলা দরকার। কারণ আমি দেখেছি বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, যে আঞ্চলিক দলেই হোক না কেন এবং বিভিন্ন জাতীয় দলেও খুব সহজে পুরুষরা যোগদান করতে পারে। কিন্তু মহিলারা পারেনা। আমরা এত চেষ্টা করি মহিলাদেরকে রাজনীতিতে আনতে কিন্তু পারিনা। খুব সমস্যা। তাদেরকে মাঠে নামানো যায় না। এই কথাটা আমি অনেক অনেক শুনি এবং আমাকে বলা হয় মহিলাদের রাজনৈতিক চেতনা, বৈশিষ্ট্য নেই। বলা খুব সহজ। একটু আগে কনিকাদিকে দেখলেন, তিনি তার বাবুকে নিয়ে এসেছেন। উনি কি তার বাবুকে তার বাসায় রেখে আসতে পেরেছেন? পারেন নি। উনার জায়গায় যদি কোন পুরুষ হলে তার এই নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। কেবল মাত্র তার পরিবারের অসুস্থ কেউ যদি থাকতো কেবল তার জন্য চিন্তা করতে হতো। তার মহিলাদের মত চিন্তা করার দরকার হয় না। তার পরিবারে কে অসুস্থ আছে, পরিবার কিভাবে চলবে এ বিষয়ে চিন্তা করবে পরিবারের যিনি প্রধান অর্থাৎ পুরুষ তিনি। নারীদেরকে আপনি হাজারটা কাজ দিয়ে দেখবেন তারা চেষ্টা করে দেখবে। তারপর আপনারা বলবেন যে, নারীরা অস্ত্র ধরতে জানে না। ডাকলে আসে না। মিটিংএ আসে না। মিছিলে আসে না। নারীদের কোন রাজনৈতিক চেতনা নেই। এটা কি ধরনের ন্যায় বিচার আমি জানি না। আমরা যারা ন্যায়ের কথা বলি। হ্যাঁ, আমরা যে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলবো, আমরা পূর্ণস্বায়ত্তশাসন চাই অথবা কেউ হয়তো অর্ধস্বায়ত্তশাসন চাই। কিন্তু আমরা জানি আমাদের নারীদেরকে বাসায় হাজার কাজ করতে হয়। তারপরও আবার তাদেরকে আমরা দোষারোপ করি যে তাদের কোন রাজনৈতিক চেতনা নেই। এটি কি ধরনের ন্যায়ের কথা? বলা হয় এটা বুঝে না, ওটা বুঝে না। আমরা যদি চাই নারীরা আসুক, নারীরা প্লেকার্ড ধরুক। এটাই বলছি যে, দোষ দেওয়া খুব সোজা কিন্তু কিসের জন্য নারীরা আসতে পারছে না। কোন কোন দিক থেকে নারীদেরকে সহায়তা দিলে বা অনুপ্রেরণা দিলে নারীরা আসতে পারে। কেন এই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণ কম সে জিনিসটা আমরা চিন্তা করি না। এটি অনেক বড় একটি দুঃখজনক ব্যাপার।
কেবল বাপদাদার জমি নয়, মা-দাদীরও
নারীদের অধিকারের কথা যেহেতু বলছি, কিন্তু আমি অবশ্যই এখনও জানিনা যে এখানে নারী সমাজের জন্য কি ধরনের অধিকারের কথা বলা হয়। নারীদের অনেক ধরনের অধিকার আছে। একটু আগে আমি যে কথাটা বললাম, রাঙ্গামাটি হচ্ছে আমার রাঙ্গামাটি, এই জমি আমার। মানুষ বা জনগণ আমার। আপনারা আমাকে ভুল ভাববেন না যে, আমি রাণী হিসেবে এই কথাগুলো বলছি। রাণী হিসেবে হয়তো আমি বলছি, এটা আমার জায়গা। সবাই আমার প্রজা। আমি তাদের সাথে কথা বলার অধিকার রাখি। কথাটা কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমার কথা বলার অধিকার যেমনি রয়েছে ঠিক তেমনি আপনাদেরও কথা বলার অধিকার রয়েছে। এই রাঙ্গামাটি যেমন আমার রাঙ্গামাটি একইভাবে আপনাদেরও। আপনারা যদি একইভাবে দশ জনের সাথে কথা বলতে চান তাহলে প্রশাসনের কোন অধিকার নেই সে অধিকার কেড়ে নেওয়ার। তবে, যেহেতু প্রশাসন একটু ক্ষমতা রাখে সেহেতু তারা বাধা দেবেই। প্রশাসন সবসময় আপনাদের কাজে বাধা প্রদান করবে। আপনাদেরকেও সবসময় অন্য আরও একটি উপায় খুজে বের করতে হবে। অন্য আরেকটা উপায়ে আপনারা সমাবেত হতে পারবেন সংখ্যায় কম হলেও। কিন্তু আপনারা চেষ্টা করলে অবশ্যই সফল হতে পারবেন এবং আপনারা কথা বলতে পারবেন। আপনাদের অংশিদারীত্ব থাকতে হবে সম্মিলিত কাজে। আপনারদেরকে বুঝতে হবে যে, এই জায়গাটা আমার, ভূমিটা আমার। এই জমি আমার। কথা বলার অধিকার হচ্ছে আমার, এটা প্রশাসনের নয়। এটা অন্য কারোর নয়। এটা আমার। এটা আমরা মাঝে মধ্যে বলি না। বলতে চাই না। মেয়েদের ক্ষেত্রে কেন বেশি হয়? আমরা সব সময় বলি, আমাদের জায়গা-জমিগুলি হচ্ছে আমাদের বাপদাদার। বাপদাদার জমি আমরা বলি। এটাই প্রচলিত কথা। এটা হচ্ছে আমাদের বাপদাদার জমি। এই কথাটা আমরা ভুলে যাই যে, এই জমি আমার বাবার, আমার দাদার, একইভাবে আমার নানীর, আমার দাদীর, আমার বোনের, একইভাবে এই ভূমির ওপর আমাদের সবার অধিকার আছে । এই অধিকার সম্পর্কে যখন আপনাদের মধ্যে একটা বোধ এসেছে, সচেতনতা এসেছে, তখন আপনাদের মনে হবে যে, না, এ নিয়ে আসলে আমার কাজ করা দরকার।
নিজেদেরকে রাজনৈতিক চেতনা অর্জন করতে হবে
আমি দেখেছি নারীদেরকে আসলে আমরা জাগিয়ে তুলতে চাই না। যখন দীঘিনালায় বিজিবি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল সবার আগেই কিন্তু নারীরা এগিয়ে এসেছে। কারণ তারা বুঝেছেন যে, এই জায়গা বিজিবিদের নয়। এই জায়গা বিজিবি বেদখল করছে। নারীরা তাদের পরিবারের জন্য যে কাজগুলো করেন তারা রাজনৈতিক দাবী আদায়ের কাজ করতে পারবেন না তা নয়। নারীদের এই রাজনৈতিক চেতনাটা বই পড়ে অর্জন করতে হবে। রাজনৈতিক চেতনা অন্য কেউ ধার দেবে না। নিজেদেরকে তা অর্জন করতে হবে। অতীতেও এ ব্যাপারে কাউকে বুঝানোর দরকার হয় নি। আমিও মনে করি, আমাদের মধ্যেও এই চেতনাটা আছে, অলরেডি আছে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে এই চেতনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করার সুযোগ আমরা দিতে পারি নি। কারণ আমাদের মনে হয়ছে আমরা খুবই একমুখি আন্দোলনের কথা চিন্তা করি। আমাদের মনে হয় যে, আমরা মিছিল-মিটিংএ অংশগ্রহণ করি, প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করি, আমি বক্তৃতা দিচ্ছি এটাই হচ্ছে রাজনীতি । আমার মনে হয়, আমি মিটিং করবো, মিছিল করবো, সেটাই হচ্ছে রাজনীতি। অন্য কাজগুলোকে আমরা রাজনৈতিক কাজ বলে মনে করি না। আমি যদি বলি শান্তিবাহিনী ছিল। আমি যদি বলি, শান্তিবাহিনী যখন গেরিলা সশস্ত্র সংগ্রামে ছিলেন তখন আমাদের নারীরা যদি তাদেরকে তাদের ঘরে আশ্রয় না দিতেন, অসুস্থদের চিকিৎসা সহায়তা না দিতেন তাহলে আপনাদের কি মনে হয়, বিশ বছর ধরে শান্তিবাহিনী ঠিকতে পারতো? সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারতো? কখনোই পারতো না। অনেক নারী অস্ত্র ধরেন নি কিন্তু অনেক নারী পেছন থেকে বিভিন্নভাবে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগীতা করেছে। আমরা যখন এই পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের কথা বলি, যারা গেরিলা বাহিনীতে প্রত্যক্ষভাবে নারী ছিলেন অবশ্যই আমরা তাদেরকে মহিমান্বিত করি, শ্রদ্ধা করি। যারা আন্দোলনের পিছনে থেকে কাজ করেছেন তাদেরকে আমরা সম্মান দিতে জানি না, তাদেরকে আমরা ভুলে যাই। আমরা যত বেশি করে তাদরেকে ভুলে যাবো ততদিন পর্যন্ত নারী অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হবে না। নারীর অংশগ্রহণ না থাকলে সেই সংগ্রাম কোনদিন সফল হবে না। আমি বলবো, শান্তিবাহিনীর সংগ্রামের সফলতা যদ্দুর এসেছে নারীর অংশগ্রহণ না থাকলে এতটুকুও হতো না।
সংগ্রামই আসল কথা
ডাকাতির কাজ সংগ্রাম নয়। আপনি যদি কবিতা লিখেন, আপনার যদি মনে হয় যে গান লিখবেন, গান লিখে মানুষকে উজ্জীবিত করবেন সেটাও একটা সংগ্রাম। আমি কোন সংগঠনের সাথে কোন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত না। আমি যে আজকে আপানাদের কাউন্সিলে এসে কথা বলছি আমি মনে করি যে, এটা আমার রাজনীতির, একটা রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মি না হয়েও অন্যভাবে আমি আপনাদেরকে সহযোগিতা করতে পারি। আপনারা যারা এসেছেন আমার মনে হয় আপনাদের মনেও এই চেতনাটা আছে। কিন্তু চিন্তাকে কিভাবে বাস্তবে রূপায়িত করবো সেটাই হচ্ছে কথা। শুধু মিটিংএ গেলে হবে না, মিছিলে গেলে হবে না। মিটিং, মিছিল ছাড়াও আরো অনেক কাজ আছে। মিটিংএ গেলে যদি আপনার সে লক্ষ্য তা পূরণ হবে বলে মনে করেন তাহলে আপনি মিটিংএ যান। এটাই হচ্ছে চিন্তা মানুষকে কিভাবে চালিত করে তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সবাইকে আবারও নমস্কার, শুভেচ্ছা, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।