পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানি আগ্রাসন দিবসে বাঘাইছড়ির বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা
বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানি আগ্রাসন দিবস (২০ আগস্ট ১৯৪৭) উপলক্ষে বাঘাইছড়ির বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী ও যুবক-যুবতিদের নিয়ে “১৯৪৭ ও আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ বুধবার (২০ আগস্ট ২০২৫) ‘জাতীয় চেতনা উন্মেষ সংঘ’ ব্যানারে বাঘাইহাট, জারুলছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উলুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়, লক্ষীছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় করল্যাছড়ি, করল্যাছড়ি বিদ্যালয়ে পৃথক পৃথকভাবে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জারুলছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভা
জারুলছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমিকা চাকমার সঞ্চালনায় ও প্রধান শিক্ষক রিংকি চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র রুপল প্রিয় চাকমা, শিক্ষক প্রতিনিধি অমর সাধন চাকমা, পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য পলেন চাকমা ও ইউপিডিএফ সংগঠক বিধু ভূষণ চাকম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলো জ্যোতি চাকমা।

ছাত্রনেতা পলেন চাকমা বলেন, জাতীয় চেতনা সুসংগঠিত করতে ছাত্র-যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস থেকে সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। তিনি ১৯৪৭ থেকে আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিশদ আলোচনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, অধিকার আদায়ে মুক্তির সংগ্রামে জাতীয় চেতনা ধারণ করে তরুণ প্রজন্মের সচেতন ভুমিকা পালন করতে হবে। জাতীয় বেইমান, দালাল সুবিধাবাদীদের চিন্তিত করে প্রতিহত করতে হবে।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে ৪৭-এর ইতিহাস ফিরে দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশ ভাগের সময় যদি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল থাকতো তাহলে হয়তো আজকে ২০ আগস্ট অভিশপ্ত হতো না। ঠিক বর্তমান সময়েও ছাত্র জনতা যদি সঠিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন করে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী আরো সংকটে পড়বে। জাতীয় দুর্দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর আন্দোলনে অংশগ্রহণ আবশ্যক বলে বক্তারা মত প্রকাশ করেন।
উলুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আলোচনা সভা
উলুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত আলোচনা সভায় উলুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক চঞ্চল চাকমা সঞ্চালনায় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি উপজেলা দপ্তর সম্পাদক সমরিতা চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি জ্যোতি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি শুক্র চাকমা। সভায় সভাপতিত্ব করেন উলুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিটন চাকমা ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন রিপল চাকমা।

স্বাগত বক্তব্য রিপল চাকমা বলেন, আজকের এই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটলাররা পাহাড়িদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ অত্যাচার করেই চলেছে। এই নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে মুক্তি এবং একটি নিপীড়িত জাতি হিসেবে কিভাবে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পাহাড়িদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, থাকা সত্ত্বেও আমাদের এই দেশে বাঙালিদের সংস্কৃতি নিয়ে চলতে হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা একমাত্র পারে জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র- ছাত্রীদের আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকার পতন হয়েছে।
সমরিতা চাকমা তার বক্তব্য বলেন, আজকের ২০ আগস্ট দিনটি সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের এই দিনটি একটি অভিশপ্ত দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৪৭ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বেলুচ রেজিমেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভারতীয় পতাকা এবং বার্মার পতাকা নামিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করে। তারা প্রথমে রাঙামাটি দখলে নেয়। এরপরে বান্দরবানসহ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের আগ্রাসনের শিকার হয়।
ছাত্রনেতা জ্যোতি চাকমা বলেন, আজকের এই দিনটি আমাদের খুবই দুঃখময় দিন এবং অভিশপ্ত দিন। আজ থেকে ৭৮ বছর আগে ১৯৪৭ সালে ২০ আগস্ট আমাদের এই পার্বত্য চট্টগ্রাম ৯৭% অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও পাকিস্তানের সাথে এই অঞ্চলটি অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সেজন্য সেই দিন থেকে শুরু হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়িদের উপর আরেক এক কালো অধ্যায়।
যুবনেতা শুক্র চাকমা বলেন, ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা আগ্রাসনের শিকার থেকে মুক্তি পায়নি। পাকিস্তানি আগ্রাসনের সেই দুঃখ-দুর্দশা আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নের নামে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পাহাড়িদের ৫৪% শতাংশ জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। েএর ফলে পাহাড়িরা ভূমি হারা হয়ে ভারত ও বার্মায় শরনার্থী হিসেবে যেতে বাধ্য হয়।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন কল্পনা চাকমাকে নিজ বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীরা অপহরণ করে। আজো কল্পনা চাকমার কোন হদিস আমরা পাইনি। বাবুছড়ায় বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে ২১ পরিবার পাহাড়িকে উচ্ছেদ করা হয়।
সভাপতির বক্তব্যে মিটন চাকমা বলেন, চাকমারা মোঘল আমল থেকেই আন্দোলন করে আসছে এবং যুদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, চাকমারা শুরু থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনমুখী ছিল।
তিনি আরও বলেন, দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে পাঠানো হয় ভারত উপমহাদেশের সীমারেখা নির্ধারণ করার জন্য। তিনি বেঙ্গল বাউন্ডারি সীমানা কমিশন এবং পাঞ্জাব বাউন্ডারি সীমানা কমিশন দুটি কমিশন গঠন করেন এবং স্যার শেরিল র্যাডক্লিফকে পাঠানো হয় সেই দুটি কমিশন নিয়ে দেশবিভাগের সীমারেখা নির্ধারণ করার জন্য।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করার কারণে আজও পর্যন্ত নানা দুঃখ-গ্লানি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সেজন্য ২০ আগষ্ট পাকিস্তানি আগ্রাসন দিবস অর্থাৎ কালো দিবস পালন করতে হচ্ছে।
লক্ষীছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভা
লক্ষীছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভায় জিতা চাকমার সঞ্চালনায় ও সজিব চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শান্তি চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরানী চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাজেক শাখার সাবেক সহসভাপতি ইংগেজ চাকমা। আলোচনা সভায় সংহতি বক্তব্য তুলে ধরেন লক্ষীছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক লেলিন চাকমা।

সভায় স্হানীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল, কলেজের ছাত্র ছাত্রী ও যুব-যুবতিরা অংশগ্রহন করেন।
সকাল ৯টায় সকল শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করে আলোচনা সভা শুরু করা হয়। দুপুর ১২টায় সভা শেষ হয়।
বক্তারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি আগ্রাসনের কারণসমূহ আলোচনা করেন। তারা বলেন, এর মূল কারণ হচ্ছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দূরভিসন্ধি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক দলের অভাব। ব্রিটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষ যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, পাকিস্তানি আগ্রাসনের সময় তার কোন কিছুই করতে পারেননি তৎকালীন নেতৃবৃন্দ। ফলে বিনা বাধায় বেলুচ রেজিমেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন চালাতে সক্ষম হয়। তাই আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামকে রক্ষার জন্য আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম জোরদার করতে হবে। আর এজন্য ছাত্র-যুব সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
তারা বলেন, শুধু পাঠ্য-পুস্তকের মধ্য সীমাবদ্ধ না থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে। অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আগামীর সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যেতে হবে।
বাঘাইহাটে আলোচনা সভা ও ছবি প্রদর্শনী
আজ দুপুর ১২টার সময় বাঘাইহাট এলাকায় জাতীয় চেতনা উন্মেষ সংঘের ব্যানারে ছবি প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
আলোচনা সভার শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল লড়াই সংগ্রামে আত্মত্যাগী মানুষদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

পরে অনুষ্ঠিত সভায় প্রদীপ চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সুনীল বিকাশ চাকমা ও ইউপিডিএফ সংগঠক রুপেশ চাকমা।
বক্তারা ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক আগ্রাসন ও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি বিষয়ে তুলে ধরেন।
করল্যাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় আলোচনা সভা
সাজেকের গঙ্গারাম করল্যাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ১০ম শ্রেণির ছাত্র তুষার কান্তি সঞ্চালনায় ও তুফান চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সহসভাপতি ইয়ানা চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙামাটি জেলা কমিটির সদস্য বিশাখা চাকমা, বিদ্যালয়ের শিক্ষক অর্জিতা লংকার চাকমা, তাক্কুম বাড়ি গ্রামের কার্বারী ধারাস চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা সাধারণ টুকু চাকমা ও ইউপিডিএফ সংগঠক কালো বরণ চাকমা।

সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।