পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা ভালো থাকি কেমন করে???
অমল ত্রিপুরা
পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চল বান্দরবান পাহাড়ে বম ও ম্রো জাতিসত্তাসমূহ ভালো নেই। তাদের ওপর চলছে হত্যা-নির্যাতন, নিপীড়ন ও ভূমি কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। এমন অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা ভালো থাকি কেমন করে???
গত বছর অক্টোবর থেকে বান্দরবান জেলায় কয়েকটি উপজেলায় রাষ্ট্রীয় যৌথ বাহিনীর (সেনা-র্যাব-বিজিবি-পুলিশ) তথাকথিত কম্বিং অপারেশনের নামে সেখানকার বম জাতিসত্তাদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, হয়ারানি চালিয়ে তাদেরকে নিজ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বম জাতিসত্তারা গ্রামে থাকতে না পেরে নিরাপত্তার স্বার্থে ১৩২টি পরিবারের ৫৪৮ জন (তথ্য বিবিসি) পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরামের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখনো পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করছেন। নিরাপত্তার খোঁজে রোয়াংছড়ি-রুমার বিভিন্ন এলাকা থেকে বম, খিয়াং ও মারমা জাতিসত্তার ৪৪৬ জন (তথ্য বিডিনিউজ২৪) নিজ গ্রাম ছেড়ে রোয়াংছড়ি-রুমা সদর ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। জানিনা এভাবে তাদের আর কতদিন কাটাতে হবে।
গত ৭ এপ্রিল ২০২৩ বম জাতিসত্তার ৮ জনকে কথিত ‘দু’পক্ষের গোলাগুলির’ নামে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয়দের তথ্য মতে ‘সেদিন যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না এবং তারা সকলে খেটে খাওয়া মানুষ। এর মধ্যে একজন কলেজ ছাত্র ও একজন স্কুলের কর্মচারি ছিলেন’। হত্যার আগের দিন সেনাবাহিনীর মদদে নব্য মুখোশ ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা তাদেরকে অপহরণ করেছিল।
অপরদিকে, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে বসবাসকারী ম্রো-ত্রিপুরাদের ৪০০ একর ভূমি কেড়ে নিয়ে নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কোম্পানী দীর্ঘ দিন ধরে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে আসছে। মিথ্যা মামলা-হামলা-আটক, খাবার পানির উৎস ঝিরিতে বিষ প্রয়োগ, বৌদ্ধ বিহার ভাঙচুর, জুম, বাড়ি-ঘর অগ্নিসংযোগসহ ইত্যাদি ঘটনা এখনো চলমান রয়েছে।
নিজ ভূমি রক্ষার্থে ও বাঁচার তাগিতে রেংয়েন ম্রো পাড়া, লাংকম ম্রো পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়াবাসী সভা-সমাবেশসহ এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুঁটে চলেছেন। কিন্তু কোথাও কোন সমাধান তারা পাননি, তবুও তারা লড়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার দেশের উন্নয়নের কথা বলেন, মুখে মুখে সংখ্যালঘু বান্ধব সরকার বলে বক্তব্য, বিবৃতি দেন। কিন্তু বান্দরবানে বম-ম্রো-খিয়াং জাতির ওপর এ নিপীড়ন বন্ধের কোন উদ্যোগ নিয়েছেন কি বা নিলে এখনো পর্যন্ত বম-ম্রো-খিয়াংরা অনিরাপদ জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন কেন???
পার্বত্য চট্টগ্রামে বম-ম্রো-খিয়াং জাতিসত্তারা সংখ্যায় দিক দিয়েও খুব কম, পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর জাতি। এদিক থেকে বিবেচনা করলে তাদেরকে জাতি হিসেবে উন্নত করে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করে পাশে দাঁড়ানো উচিত । কিন্তু রাষ্ট্র তা না করে তাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।
বান্দরবান পাহাড়ের মানুষ যেখানে ভালো নেই, বম-ম্রো-খিয়াং-মারমা-ত্রিপুরা জাতিরা যেখানে ভালো নেই, তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ভূমিদস্যুদের কর্তৃক নিষ্পেষিত, নিরাপত্তা ও বাঁচার তাগিতে এদিক সেদিক ছুঁটে বেড়াচ্ছে, দেশের ভিতরে ও বাইরে আশ্রয়স্থলে বন্দি জীবন যাপন করছে, ৮জন বমকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা নীরব ও নির্বিকার থাকি কেমন করে???
কেবল বান্দরবানে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত পাহাড়িদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলছে। এ নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত আমরা কাউকে দেখতে পাই না। যেসব ছাত্র-যুব-নারী-জনতা ও রাজনৈতিক দল-সংগঠন রুখে দাঁড়াচ্ছেন তাদেরকে সহযোগীতা দেওয়ার মত কোন শক্তি এখনো পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না। বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তাদেরকে সহায়তা না করে, তাদের সাথে ঐক্যমত পোষণ না করে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সামিল না হয়ে শাসকের ভূমিকায় পর্দার আড়াল থেকে ব্যাঙ্গ, বিদ্রুপ করতে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অন্যায় প্রতিবাদকারী ব্যক্তি-সংগঠন-দলের নেতা-কর্মীদের হুমকি দিতে দেখা যায়। যারা এসব করে বেড়ায়, জাতি-জাতিতে দ্বন্দ্ব, সংঘাত লেলিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায় এবং লিপ্ত থাকে তারা শাসকগোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এরাই শাসকের সাথে আঁতাত করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করছেন।
পাহাড়ি জাতিকে আজীবন সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে। এ জাতির মুঘল-ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরবর্তী দিনগুলোতেও লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসের ঘটনাবলী এখনো সাক্ষ্য বহন করে। সুতরাং পাহাড়ে সংঘটিত অন্যায়-অবিচারে পাহাড়িরা নীরব থাকতে পারি না। বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে সামিল হাওয়া উচিত এবং বান্দরবানে বম-ম্রোদের পাশে দাঁড়ানো জরুরী।
* লেখক পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন