মুক্তমত

পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রের ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্ন ও ইসলামিক আধিপত্যবাদ

0

রোনাল চাকমা

রাষ্ট্রের  গোড়াপত্তনের ইতিহাসে কিছু কিছু অঞ্চলে জনসংখ্যা পরিবর্তনের সাথে রাষ্ট্রের আধিপত্যর একটা গভীর সম্পর্ক আছে। যখন রাষ্ট্রের আধিপত্যর প্রশ্ন আসে তখন ধর্মের আধিপত্যও মাথা চাড়া দিয়ে ‌উঠে। যেমন হয়েছিল কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর,কিংবা অফ্রিকা-এশিয়ায় ইউরোপীয়দের কলোনী আবিষ্কারের পর। রাষ্ট্র সরাসরি এই আগ্রাসন ও আধিপত্যর সঙ্গে জড়িত। প্রায় সময় রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোতে ডেমোগ্রাফিক চেঞ্জ বা জনসংখ্যামিতির পরিবর্তন আনতে হয় এবং নির্দিষ্ট একটা প্যাটার্ন বা নমুনা তৈরি করতে হয়। এই প্যাটার্নকে রাষ্ট্র প্রয়োগ করে বহিরাগত অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এবং এই প্রয়োগের অঞ্চলে থাকা স্থানীয় জনগোষ্ঠী ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্যতম উদাহারণ। অতীতের দিকে একটু ফিরে তাকাই-

১৯৪১ সালের ব্রিটিশ ভারতের আদমশুমারী অনুযায়ী,পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট জনসংখ্যা ছিল ২,৪৭,০৫৩ জন।তাঁর মধ্যে পাহাড়িদের সংখ্যা ছিল ২,৩৩,৩১২ জন এবং মুসলিম বাঙালি জনসংখ্যা ছিল ৭,২৭০ জন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৪,৮৮১ জন।ব্রিটিশ ভারতের এই আদমশুমারীর ভিত্তিতে দেশবিভাগ করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি অতি অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল যার ৯৭.৫% ছিল অমুসলিম এবং তাদের মধ্যে ৮০% ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।তা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে এটিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ অন্য়ায় এবং অযৌক্তিকভাবে জুড়ে দেওয়া হয়।

পাকিস্তান সরকার সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে শুরুর দিকে আসাম থেকে পালিয়ে আসা মুসলিম রিফিউজীদের পার্বত্য চ্টগ্রামে পূর্ণবাসন করে।যদিও ব্রিটিশদের প্রণীত ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০’’ অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনারের অনুমতি ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত অনুপ্রবেশ,অবস্থান করা এবং বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ ছিল।সরকার ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ শাসনবিধি বলবৎ রাখে।এবং পরে শাসনবিধি সংশোধন করে বিশেষ মর্যাদা বাতিল ও বহিরাগত অনুপ্রবেশে আইনগত বৈধতা দেয়। যদিও ১৯৬৩ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নোয়াখালী,কুমিল্লা,চট্টগ্রাম থেকে ব্যাপক মুসলমান বাঙালি ফেনী উপত্যকতায় বসতি স্থাপন শুরু করে।তখন থেকে সরকারের সহযোগিতায় জোরেসরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘‘ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্ন চেঞ্জ’’ এর পরিকল্পনা নেওয়া হয়।বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরে এটা আরো নতুন রূপ পায়। এবং এরই ধারাবাহিকতাই ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে মুসলিম বাঙালি পূর্ণবাসনের জন্য সমতলের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকদের গোপন সার্কুলার পাঠানো হয়।দেখুন-http://www.angelfire.com/ab/jumma/settlers/memo.html

বান্দরবানে স্থানীয় পাহাড়ি শিশুদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। ছবি সংগৃহিত

রাষ্ট্র প্যাটার্নের অংশ হিসেবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ৪,০০,০০০ ভূমিহীন ও হতদরিদ্র মুসলিম বাঙালী পূর্ণবাসন করে। এবং প্রত্যেক পরিবারকে ৫ একর টিলা, ৪ একর উচুনিচু ভূমি অথবা ২.৫ একর চাষযোগ্য ভূমি এবং কিছু নগদ টাকা ও ৬ মাসের রেশন সরবরাহ করা হয়। তাঁদের অধিকাংশ নদী উর্বর উপত্যকায় পূর্ণবাসন করা হয়। যদিও রাষ্ট্রের পূর্ণবাসন পরিকল্পনা আনুিষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৫ সালে শেষ হয় তবুও পূর্ণবাসন প্রক্রিয়া গোপনে চলতে থাকেে। এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক ভূমি মুসলিম পূর্ণবাসিতদের দখলে চলে যায়। [সূত্র : Anti Slavery Society 1984:Appendix 1]

বাংলাদেশের আদমশুমারী অনুযায়ী , ১৯৭২ সালে স্থানীয় পাহাড়ি ছিল ৮১% এবং বহিরাগত বাঙালি ১৯%, ১৯৮১ সালে স্থানীয় পাহাড়ি ৬২%,বহিরাগত ৩৮%, ১৯৯১ সালে স্থানীয় পাহাড়ি ৫১.৫%,বহিরাগত ৪৮.৫%। (সূত্র:সিএইচটি কমিশন,২য় সংস্করণ-১৯৯৪)।২০০৩ সালে এই অনুপাত স্থানীয় পাহাড়ি ৪৭%,বহিরাগত ৫৩%।বর্তমান সময়ে পরিসংখ্যান করলে হয়তো এই অনুপাত দাঁড়াবে পাহাড়ি ৪০%,বহিরাগত ৬০%।

রাষ্ট্রের এই বিশাল জনসংখ্যামিতির পরিবর্তন পরিকল্পনার সাথে ইসলামী সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া এবং আধিপত্য ও সমানতালে চলতে থাকে। প্রাপ্ত তথ্যমতে,১৯৬১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদ ছিল ৪০টি, মাদ্রাসা ছিল ২টি,১৯৭৪ সালে মসজিদের সংখ্যা হয় ২০০ টি, মাদ্রাসার সংখ্যা হয় ২০ টি। জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮১ সালে মসজিদের সংখ্যা হয়েছে ৫৯২টি এবং মাদ্রাসা ৩৫টি।বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদের সংখ্যা ৩০০০ এবং সরকারি-বেসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৮০০।

এবং বাংলাদেশ সরকার সামরিক খাতেও দ্রুত বাজেট বাড়ায়। ১৯৭৫ সালে ৪২মিলিয়ন ডলার, ১৯৭৬ সালে ৮৬ মিলিয়ন ডলার, ১৯৭৭ সালে ১৩৬ মিলিয়ন ডলার, ১৯৭৮ সালে ১৪০ মিলিয়ন ডলার, ১৯৮০ সালে ১৩৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়। (Source: The Chittagong Hill Tracts Militarization,oppression and the hill tribes by Anti slavery Society)।

বর্তমানে জাতীয় বাজেটের ২৫ ভাগ সামরিক খাতে রাখা হয়।পাশাপাশি অন্যান্য খাত থেকে ও সামরিক বাজেটে যোগ করা হয়।বৈদেশিক সহযোগিতা তো রয়েছে।

রাষ্ট্র সামরিক বাজেট,মুসলিম বাঙালি পূর্ণবাসন, ইসলামি সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশ থেকে বৈদেশিক সহযোগিতা পায়।নিচে একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হল:

FOREIGN AID TO BANGLADESH BY PRINCIPAL DONORS
(in Million US$
)

Name of Donor1988-891989-901990-91
Japan340335345
ADB300274290
IDA297463334
Canada119104112
EEC664753
USA95100102
FR Germany575055
Netherlands524327
United Kingdom445231
UN (Exclu. UNICEF)665899
UNICEF2524
Sweden313722
Denmark185133
Norway253520
Saudi Arabia158

Foreign aid to Bangladesh; Source:Angelfire.com

সাম্প্রতিক সময়ে গত ০১ অক্টোবর ২০২০ http://www.thedailystar.net এ “পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ছে রোহিঙ্গারা’’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।বিভিন্ন মিডিয়া’য় উঠে আসা তথ্যমতে,এর আগে ও বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিকদম, লামা ও থানচিতে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করেছে।শুধুমাত্র বান্দরবান জেলায় আনুমানিক ৩০,০০০ এর অধিক রোহিঙ্গা বসতিস্থাপন করেছে। অপরদিকে ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটি জেলায় ১২০ রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবার এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ৫৬ পরিবার খুঁজে পাওয়া গেছে।প্রকৃত অনুপ্রবেশের সংখ্যা এর বেশি। এই যে রাষ্ট্রের ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্ণ চেঞ্জ এবং বহিরাগত অনুপ্রবেশে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এই অঞ্চলে স্থানীয় জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব,জীবিকা,বিকাশ এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। শুধুমাত্র এই অঞ্চলে ২০১৭ সালে ভয়াবহ ভূমিধসে ১৫৩ জনের অধিক মানুষ মারা গেছে।

আজ পাহাড়ের ভূমিপুত্ররা প্রান্তিকতার শেষ সীমানায় এসে পড়েছে। তাঁদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তাঁদের শেষ ঠাঁই নেওয়া,বুকে আগলে রাখা সাজেক, চিম্বুক এবং থানচির মতন দুর্গম অঞ্চলও আজ রাষ্ট্রের ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্নের আওতায় এসেছে। সেখানে আজ বহিরাগত মুসলিম বাঙালিদের আধিপত্য বাড়ছে। এবং নতুন করে বহিরাগত সেটেলার পূর্ণবাসন হচ্ছে,মসজিদ হচ্ছে,পাঁচ তারকা হোটেল,মটেল-রিসোর্ট,পর্যটন হচ্ছে।

আজ পাহাড়ের ভূমিপুত্ররা যদি রাষ্ট্রের তৈরি করা প্যাটার্নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে এবং নিজস্ব প্যাটার্ন তৈরি করতে না পারে তাহলে তাঁর অস্তিত্ব,আত্নপরিচয়,ভূমি হারানোর গ্যারান্টি নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র পাহাড় হারানোর গ্যারান্টি যখন আমাদের দিচ্ছে, এখন রাষ্ট্রকে সঠিক জবাব দেওয়ার দায়ও আমাদের।দয়া করে এই দায় কেউ এড়িয়ে যাবেন না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখকের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More