অনলাইন ডেস্ক:
পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীনে প্রায় দশ বছরের বেশি সময় যাবত আমার নিয়মিত যাতায়াত। গত দশ বছরে উন্নয়ন নাম দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যা করা হয়েছে তার বেশিরভাগ ই উন্নয়ন নাকি আগ্রাসন, এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। উন্নয়ন শব্দটাতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের এখন সবচেয়ে বেশি ভয়, কেন? নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তা কিছুটা পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছি।
বান্দরবান শহরের ঠিক পাশেই নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র থেকে শুরু করে চিম্বুক সড়ক অর্থাৎ বান্দরবান থানছি সড়কের জীবননগর পেরিয়ে রেঞ্জের শেষ পাহাড় ওয়ালিংতং পর্যন্ত যে পাহাড় সারিটি বিস্তৃতি লাভ করেছে, সেটিই মূলত চিম্বুক রেঞ্জ নামে পরিচিত। বান্দরবানের বেশিরভাগ জনপ্রিয় পর্যটন স্পট নীলাচল, শৈলপ্রপাত, নীলগিরি, নীলদিগন্ত, জীবননগর এর সবকিছুই মোটামুটি এই চিম্বুক রেঞ্জের উপর বা রেঞ্জের নিচের পাহাড়ের উপরই পড়েছে।
বান্দরবান- থানছি সড়কের বান্দরবান পেরুলেই সবার আগে নজরে আসবে ক্যাসিনো কান্ডে জেলে থাকা যুবলীগ নেতা জিকে শামীমদের সিলভার ওয়াইন রিসোর্ট। ম্রোদের বিশাল জায়গা দখল করে, ম্রো পাড়ার পানির উৎস বন্ধ করে কাটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে এই জায়গা। ম্রোদের জায়গা দখল করে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নিজ খরচে একটি পুলিশ ফাড়িও বানিয়ে দিয়েছে। পরবর্তীতে ক্যাসিনো কান্ডে জিকে শামীম গ্রেফতার হওয়ায় সেই জায়গাটি আর পুলিশ নেয় নি, কিন্তু সিলভার ওয়াইন স্পা রিসোর্টের কার্যক্রম চললাম আছে।
আরেকটু এগুলেই হাতের ডানে ও বামে অনেক রিসোর্ট দেখতে পাবেন, চিম্বুক সড়কের উপর দিয়ে যে বিদ্যুৎ লাইন থানছি পর্যন্ত চলে গেছে, সেই আলোয় রাতে বেশ ঝলমল করে উঠে রিসোর্ট গুলো, কিন্তু আশেপাশের আদিবাসী পাড়াগুলোতে সেই আলোর ঝলকানির কোনো স্পর্শ খুজে পাবেন না।
পাহাড় আর মেঘের সাথে চলতে চলতে রাস্তার দু ধারে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের লাল যাত্রী ছাউনি আর সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন। চিম্বুকের উপর আপনার গাড়ি যেখানে যাত্রা বিরতিতে দাড়াবে সেটি সেনাবাহিনীর ক্যান্টিন, সেখানে পচাশি টাকা দিয়ে ব্রয়লার মুরগীর বিরিয়ানি খেয়ে, গাড়িতে চেপে আরেকটু এগুলেই কাপ্রু পাড়ার উপরে পাবেন ক্যাফে নীল নামে বিজিবির আরেকটি ক্যান্টিন। এই জায়গাটি বিজিবি দখলে এসেছে অদ্ভুতভাবে, সেই গল্প তোলা থাক। কাপ্রু ম্রো পাড়া বা ক্যাফে নীল এর এই জায়গা থেকে আরেকটু এগুলেই সেই কাংখিত নীলগিরি।
নীলগিরি থেকে জীবনগর পর্যন্ত এই বিশাল জায়গার প্রায় পুরোটা জুড়েই মূলত পরিকল্পনা হচ্ছে সেনা কল্যান সংস্থা ও শিকদার গ্রুপের পাচ তারকা হোটেল নির্মানের। এখানে চিম্বুকের বুকের চারশো বছর পুরোনো কাপ্রু ম্রো পাড়া সহ, নীলগিরির নিচের এরা পাড়া ও আরো দুটি পাড়ার প্রায় আটশো একর জায়গার উপর নজর পড়েছে এই ভূমি দস্যুদের। যা গত রবিবারের কাপ্রুপাড়ায় ম্রোদের মানববন্ধন ও কালচারাল শো ডাউনের মাধ্যমে অনেকেই জানতে পেরেছেন। জীবননগর এর পর এই চিম্বুক সড়কটি রেঞ্জের দিকে না এগিয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে বলি পাড়া হয়ে গিয়ে ঠেকেছে সাংগু তীরবর্তী থানছি পর্যন্ত।
জীবননগর পেরিয়ে চিম্বুক সড়ক ছাড়িয়ে জংগল বেস্টিত যে উচু উচু পাহাড়সাড়িটি বা চিম্বুক রেঞ্জের পাহাড় সাড়িটি আরো সামনের দিকে এগিয়ে গেছে সেদিকের অনেক ম্রো পাড়ায় আমার দীর্ঘ সময় যাওয়া- থাকা ও তাদের জীবনযাপন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। গতবার যখন চিম্বুক রেঞ্জের উপর ক্রাতলাই পাড়ায় ছিলাম, সেই ক্রাতলাই কারবারি বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলো প্রায় দশদিন, নিকটস্থ কোনো হাসপাতাল নেই, মারা গেলেও কেউ টেরটি পর্যন্ত পাবেনা। তার দুটো বাচ্চা এর আগে ডায়রিয়া ও ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা সহ পরবর্তীতে আমরা ওখানে খাবার স্যালাইন সহ নিত্য প্রয়োজনীয় ঔষধ পাঠাতে সক্ষম হই।
চিম্বুক রেঞ্জের উপরের পাড়ায় ডায়রিয়া ও ম্যালেরিয়ায় প্রতি বছর প্রচুর জীবন ঝড়ে পড়ে। এরকম শত শত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে, দেখার কেউ নেই, জানারও কেউ নেই। এদিকে নেই কোনো স্কুল, নেই আশেপাশে কোনো বাজার ঘাট, নেই কোনো রাস্তা, কোনো পাড়ায় নেই কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। এখানে প্রতিদিন মানুষ লড়াই করে বেচে থাকে, যেদিন লড়াই করতে পারে না সেদিন মানুষের জীবন হেরে যায়। সাধারণ রোগেই মৃত্যু এখানে খুব সহজ একটি বিষয়। এখানে এখনো উলংগ একটি ম্রো বা খুমি শিশু দাড়িয়ে থাকে একটি অর্ধগলিত সুরপা বা শজারু কখন পোড়ানো শেষ হবে, কখন একটু আমিষের ছোয়া পাবে? তবুও আমরা উন্নয়নের বিজ্ঞাপন দেই, দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে, দেশ শত ভাগ স্যানিটেশন এর আওতায় এসেছে, কোথাও কোনো সমস্যা নেই, চারদিকে শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়ন।
জীবননগর পেরিয়ে চিম্বুক রেঞ্জের বাকি অংশ যেখানে এখনো মানুষ গহীনের জীবনযাপন করে, যেখানে এখনো উন্নয়নের এই মহাসড়ক গিয়ে ঠেকে নি। যেখানে মানুষের কোনো মৌলিক চাহিদা পূরন হয় না, যেখানের ম্রোদের কথা এখনো মানুষ জানে না, এখন দেখি তারাই উন্নয়নের মহাসড়ক এর পাশে থাকা ম্রো পাড়াগুলোর চেয়ে অনেকগুন ভালো আছে। যদি উন্নয়নের মানে হয় উচ্ছেদ, যদি উন্নয়ন মানে হয় এই দরিদ্র মানুষের বুকের উপর পা দিয়ে দাড়িয়ে থাকা পর্যটন, তারকা হোটেল।
আজ শিকদার গ্রুপ ও সেনা কল্যান সংস্থা যদি পর্যটন এর নামে চিম্বুক রেঞ্জের সড়কের শেষ মাথা জীবননগর অবধি দখল করে পাচতারকা হোটেল বানিয়ে ফেলে, আগামীতে রেডিসন, স্কয়ার ওরা এসে এই চিম্বুক রেঞ্জের পাহাড় চূড়া দিয়ে ক্রাতলাই পাড়া কিংবা ক্রাতলাই কারবারির পাড়া ছাড়িয়ে ওয়ালিংতং পর্যন্ত পাচ তারকা হোটেলের সাড়ি বানাবে না তার গ্যারান্টি কি??
উন্নয়নের এই মহাসড়ক কি আদিবাসীদের জীবন মান উন্নয়নের মহাসড়ক নাকি উন্নয়নের নামে আগ্রাসনের মহাসড়ক, ভূমিপুত্রদের ভূমিহীন করে দেয়ার মহাসড়ক, পাহাড়ের গাছ কেটে, পাথর উউত্তোলন করে ঝিড়ি ঝর্না শুকিয়ে মেরে ফেলার মহাসড়ক, পাহাড়ে দশ বছর কাটিয়ে এখনো বোধগম্য হলো না। এই দেশের শিক্ষিত সমাজের কাছে দাবি, আমাকে বুঝিয়ে বলুন, আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বলতে আপনারা কি বুঝেন?? পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের বুকের উপর দিয়ে পাকা রাস্তা মানে কি আসলেই উন্নয়ন, নাকি আগ্রাসন????
রেজাউল করিম সুমন
১২ নভেম্বর ২০২০, রংপুর।
নোট: লেখা ও ছবিগুলো রেজাউল করিম সুমনের ফেসবুক থেকে নেওয়া।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।