পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা স্থগিত করা প্রসঙ্গে

মন্তব্য প্রতিবেদন
রাঙ্গামাটিতে একটি উগ্রবাদী সেটলার সংগঠনের হরতাল ও অবরোধের হুমকীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আগামী ১৯ অক্টোবরের সভা স্থগিত করা হয়েছে। ভূমি কমিশনের সভা ডাকা, তারপর এক হুমকীতে তা স্থগিত করা – আসলে এসবই সাজানো নাটক। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান ও উগ্র সেটলাররা হলো নট বা অভিনেতা, আর তাদের গুরু বা পরিচালক-নিয়ন্ত্রক হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনা-শাসকগোষ্ঠী। তারাই আড়ালে থেকে প্রয়োজন মাফিক এদের নাচায়।
এবারে এদেরকে নাচানোর প্রয়োজন হলো কেন? এর উত্তর হলো এই: গুইমারায় সেনা-সেটলার হামলার পর দেশের জনগণের সামনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি নতুনভাবে প্রকটিত হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে রাজনৈতিক সমাধানের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি তলানিতে নেমে গেছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে ইউনূস সরকারের নির্লিপ্ততাও সবার নজরে পড়েছে। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রশমিত করার জন্য পুরোন নাটক নতুনভাবে মঞ্চায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে এবং সে কারণে ভূমি কমিশনের সভা ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান আসলে কার ইশারায় কাজ করছেন? কমিশনের আইন মোতাবেক তার তো সভা ডাকার একচ্ছত্র ক্ষমতা আছে। বলতে গেলে একমাত্র তিনিই যখন ইচ্ছা তখন সভা আহ্বান করতে পারেন। এক্ষেত্রে কমিশনের অন্য সদস্যদের কোন ভূমিকা নেই। কিন্তু তারপরও কেন তিনি এতদিন সভা ডাকেননি? গুইমারা হামলার পরই-বা কেন হঠাৎ সভা ডাকলেন?
অপরদিকে যে কারণ দেখিয়ে উগ্র সেটলাররা ভূমি কমিশনের সভার বিরোধীতা করেছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তারা বলছে যে, কমিশনের ১২ সদস্যের মধ্যে বাঙালিদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। প্রথমত, তাদের এই কথার মধ্যে সামান্যতম সত্যতা নেই। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার, ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই যখন বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তখনও এই কমিশনের গঠন-কাঠামো একই ছিল। কই, সে সময় এসব উগ্র সেটলাররা তো তার ডাকা ভূমি কমিশনের সভার বিরোধীতা করেনি। তাহলে এখন বিরোধীতার মানে কী?
ভূমি কমিশনে যাদেরকে সদস্য করা হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত। কারণ তারা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠান এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন তিন সার্কেল চীফ তো ব্যক্তি নন, তারা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং কমিশনে পাহাড়ি-বাঙালির প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু তারপরও কতিপয় উগ্রবাদীর এসব অযৌক্তিক ও অন্যায্য দাবিতে দেয়া আন্দোলনের হুমকীর মুখে ভূমি কমিশনের সভা স্থগিত করার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে, সরকারের শক্তিশালী রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকলে এবং রাজনৈতিকভাবে ভূমি সমস্যার সমধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে, এই কমিশনের পক্ষে আদৌ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যার কারণ, উৎপত্তি ও অন্যান্য বিষয়ের সাথে তার সম্পর্ক জানা না থাকলে আলাদাভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয়, হোমিওপ্যাথি রোগের চিকিৎসা করে না, রোগির চিকিৎসা করে। একজন আদর্শ হোমিওপ্যাথ রোগীর সম্পূর্ণ রোগ লক্ষণ, রোগীর মানসিক লক্ষণ, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ক্ষুধা-পিপাসা ইত্যাদি সকল লক্ষণ সংগ্রহ করে রোগীর একটা সম্পূর্ণ চিত্র গঠন করেন এবং তারপর similia similibus curentur (like is cured by like) অর্থাৎ সম-লক্ষণের নীতিতে ঔষধ প্রদান করেন। তিনি বিচ্ছিন্নভাবে একটি রোগ লক্ষণের যেমন চর্মরোগের চিকিৎসা করেন না, তিনি সাগ্রমিকভাবে রোগির চিকিৎসা করেন। রোগি যদি সামগ্রিকভাবে সুস্থ হয় তাহলে তার চর্মরোগ আরোগ্য হবে। অপরদিকে তিনি যদি সার্বিকভাবে রোগির চিকিৎসা না করে একটি রোগ লক্ষণকে আদালাভাবে বিচার করে চিকিৎসা করেন, তাহলে তিনি রোগ সারাতে পারবেন না, রোগি সুস্থ হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হলেও সেটা বিচ্ছিন্নভাবে করার চেষ্টা অবশ্যই ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ এর সাথে সেটলার ইস্যু, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার (ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া), স্বশাসন ইত্যাদি অন্যান্য বিষয়গুলোও জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ একটির সাথে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। সে কারণে কোন একটি সমস্যাকে আলাদাভাবে সমাধান করা যাবে না। ভূমি সমস্যাকে সামগ্রিক রাজনৈতিক সমস্যার অংশ হিসেবে বিচার করে সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের অনেক দুর্বলতা রয়েছে। কেবল এই কমিশন দিয়ে পাহাড়ের ভূমি সমস্যাকে সমাধান করা যাবে না। কারণ এখানে ভূমি সমস্যা হলো রাজনৈতিক সমস্যা, তাই কেবল আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর সমাধান আশা করা বাতুলতা মাত্র।
(১৭ অক্টোবর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।