মন্তব্য প্রতিবেদন

পার্বত্য চট্টগ্রাম: সমস্যা রাজনৈতিক, সমাধান সামরিক!

0

মন্তব্য প্রতিবেদন



বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা-জনিত সমস্যা বলে মনে করা হতো। এজন্য ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেছিলেন এবং পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সেনা মোতায়েন করেছিলেন। এছাড়া তিনি শান্তিবাহিনীর ‘ইনসার্জেন্সি’ দমনের জন্য ‘কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সির’ কৌশল হিসেবে ১৯৭৯ সালে সমতল জেলা থেকে সেটলার এনে পাহাড়িদের জমিতে পুনর্বাসন শুরু করেছিলেন। তার এসব পদক্ষেপ সমস্যার সমাধান না করে বরং তা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

জিয়ার মৃত্যুর পর সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সরকারও প্রথমে সামরিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সমাধানের চেষ্টা চালান। কিন্তু তাতে সফল না হলে তিনি রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নেন এবং ১৯৮৫ সালে জনসংহতি সমিতির সাথে প্রথম সংলাপ শুরু করেন।

তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী খালেদা জিয়ার সরকারও রাজনৈতিক সংলাপ চালিয়ে যান। তবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কয়েক দফা আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এই চুক্তিকে ঘিরে শান্তির আশা জাগিয়ে তোলা হলেও চুক্তিতে একটি মস্ত বড় শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে যায়। ইউপিডিএফ চুক্তিটির এই দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে সমালোচনা করে। কিন্তু ইউপিডিএফের যৌক্তিক সমালোচনার অধিকার চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলো মেনে নিতে পারেনি। তারা ইউপিডিএফ-এর ওপর চরম দমনপীড়ন শুরু করে। চুক্তির সমালোচনা করে ইউপিডিএফ কোন অন্যায় বা অপরাধ করেনি। সংবিধানে মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, তারই প্রয়োগ তারা করেছে। কিন্তু চুক্তির সমালোচনা করার কারণে ইউপিডিএফের ওপর একদিকে বাংলাদেশ সরকার ও অন্যদিকে জেএসএসের দিক থেকে তীব্র আক্রমণ শুরু হয়। এখানে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ নেই। তবে এ প্রসঙ্গে এটা বলা যথেষ্ট হবে যে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের যে পরিস্থিতি সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে চুক্তি-উত্তর ইউপিডিএফের ওপর কীভাবে দমনপীড়ন শুরু হয়েছিল তা জানতে হবে।

যাই হোক, এখন সবাই জানেন, মানেন ও বলে থাকেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা হলো একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এমনকি সামরিক কর্তাব্যক্তিরাও তা স্বীকার করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অস্থিতিশীল ও অশান্ত পরিস্থিতি এ সত্যই প্রকাশ করে যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার যথার্থ রাজনৈতিক সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুত: বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি হলো পার্বত্য চুক্তির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও চুক্তির পক্ষগুলোর অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট মানসিকতার ফল। গণতন্ত্রহীনতা ও ফ্যাসিজম দেশে কী অবস্থার সৃষ্টি করে তা তো এদেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। এই ফ্যাসিস্টরা – সামরিক হোক, বা বেসামরিক হোক – শেষ বেলায় ব্যক্তিগতভাবে নিজের, সমাজের ও দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা যদি রাজনৈতিক হয়, তাহলে এটা প্রত্যাশিত যে রাজনৈতিকভাবে সেটা  সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু গত ২৭ বছরে আমরা সেই উদ্যোগ দেখতে পাইনি। বরং চুক্তির পর থেকে বল প্রয়োগ করে ফ্যাসিস্ট কায়দায় তথাকথিত ‘চুক্তিবিরোধীদের’ দমনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে চুক্তি স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ একজোট হয়েছে। সরকার চেয়েছে চুক্তির পর যাতে পাহাড়িদের মধ্য থেকে নতুন করে আন্দোলন গড়ে না উঠে। অপরদিকে জনসংহতি সমিতি মনে করে একমাত্র তারাই পাহাড়ি বা জুম্ম জনগণের বৈধ প্রতিনিধি। সেজন্য তারা চায় না পাহাড়িদের মধ্য থেকে অন্য কোন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠুক। ফলে দেখা যায়, চুক্তির পর ইউপিডিএফ প্রশ্নে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও জেএসএসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি মিলে যায়।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার নেই, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত তার নীতি এখনও বলবৎ আছে। হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাবাহিনীর কাছে ইজারা দিয়েছিল, ইউনূস সরকার সেই ইজারা বাতিল করেনি বা বাতিল করতে সক্ষম হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে নেই, আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে। তারাই পাহাড়ের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তারাই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিকভাবে সমাধান করতে গত ২৭ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ইউপিডিএফ-কে নির্মূল বা ধ্বংসের কর্মসূচি থাকার কারণে পাহাড়ে ঠ্যাঙাড়ে গ্রুপগুলোর অস্ত্রবাজি হয়ে থাকে, যেভাবে দেশের অন্যান্য জেলায়ও হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে কোন ‘ইন্সার্জেন্সি’ নেই। ইউপিডিএফের ওপর চরমতম দমনপীড়ন সত্ত্বেও তারা সশস্ত্র সংগ্রাম বা ‘ইন্সার্জেন্সির’ দিকে পা বাড়ায়নি। তারা গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এজন্য তারা দেশের অন্যান্য প্রগতিশীল দল ও সংগঠনের সাথে জোটভু্ক্ত হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা ইউপিডিএফের এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে মোকাবিলা করছে ’কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সির’ কলাকৌশল দিয়ে। তারা চোখ হলদে হয়েছে বলে জন্ডিসের চিকিৎসা করছে চোখের অপারেশন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এখনকার সমস্যার মূল কারণ এখানেই।

অথচ আমরা জানি রোগির ডায়ানসিসে যে রোগ ধরা পড়ে তাকে সেই রোগের চিকিৎসা করতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা যদি রাজনৈতিক হয়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে তার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিকভাবে সমাধান করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য, যেভাবে অতীতে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, কেবলমাত্র লেফট-রাইট জানা জেনারেলদের হাতে সমাধানের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাদেরকে অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে আসতে হবে এবং সমাধানের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের কোন বিকল্প নেই। (১৬ অক্টোবর ২০২৫)



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More