পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা করা হয়েছে : বাঘাইছড়িতে আলোচনা সভায় বক্তারা

0


বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ

মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে জুম্ম জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা করা হয়েছে। দীর্ঘ ২৮ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ চুক্তি এখন কার্যকারিতা হারিয়েছে।’

আজ ২ ডিসেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকের বাঘাইহাট, গঙ্গারাম মুখ, গঙ্গারাম হাজাছড়া ও বঙ্গলতলীতে ‘বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ প্রতারণা চুক্তির ২৮ বছর’ উপলক্ষে পৃথক পৃথকভাবে ইউপিডিএফের স্থানীয় ইউনিটের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

দুপুর ১২টা সময় সাজেকের বাঘাইহাট এলাকায় “ব যিয়ে চুক্তি আঝায় ন থেবং, চাগালা ভাঙি হোযেই এয পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনৎ লামি”, “অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়” এসব ব্যানার শ্লোগানে এলাকার ছাত্র-যুবককের নিয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় হিল উইমেন্স ফেডারেশনে দপ্তর সম্পাদক সমরিতা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফের সংগঠক ইয়ান চাকমা ও পিসিপির বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক শান্তি বিকাশ চাকমা।

ইয়ান চাকমা বলেন, আজ ২ ডিসেম্বর জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার একটি দিন। ২৮ বছর আগে এ দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তির নামে এই প্রতারণার দলিলে স্বাক্ষর করে জাতির ভাগ্য ও আন্দোলনকে ধুলিস্যাৎ করেন। এটা জুম্ম জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই নয়। এ চুক্তির সাংবিধানিক বৈধতা না থাকা ও আইনগত নানা দুর্বলতার কারণে দীর্ঘ ২৮ বছরেও সরকার বাস্তবায়ন না করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে। এই চুক্তি এখন কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে।  

তিনি সভায় উপস্থিত ছাত্র-যুবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যে চুক্তি ২৮ বছরে বাস্তবায়ন হয়নি সে চুক্তির আশায় না থেকে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল হতে হবে।

শান্তি বিকাশ চাকমা বলেন, জেএসএস নিজেও জেনেছে চুক্তি বাস্তবায়ন কখনো সম্ভব নয়, তবুও তারা চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। যদিও তারা ২৮ বছরে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে বড় কোন আন্দোলনে করেনি। ইউপিডিএফের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের কর্মসূচি দিলে সহযোগিতার কথা বললেও তারা উল্টো ইউপিডিএফকে ‘চুক্তি বিরোধী’ আখ্যায়িত করে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রেখেছে।

তিনি সকল সকল ষড়যন্ত্র নসাৎ করে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বেগবান করার আহ্বান জানান।


সাজেক গঙ্গারাম মুখ উজোবাজার এলাকার আয়োজিত সভায় ইউপিডিএফের সংগঠক কালো বরণ চাকমার সভাপতিত্ব ও ইংগেজ চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন পিসিপির বাঘাইছড়ি উপজেলা সহ-সভাপতি ইয়ানা চাকমা।

কালো বরণ চাকমা বলেন, জাতির সাথে প্রতারণা করার কারোর অধিকার নেই। দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী চুক্তির নামে জাতির সাথে প্রতারণা করে নিজের স্বার্থ অর্জন করেছে সত্য, জনগণের অধিকার এনে দিতে পারেনি। ২৮ বছরে না পারছে চুক্তি পূর্ণবাস্তবায়নে সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে, না পারছে ইউপিডিএফের পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে সামিল হতে।

তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব টিকে রাখতে হলে অবশ্যই পূর্ণস্বায়ত্তশাসন অধিকার অর্জন করতে হবে। তাই আগামী দিনে অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন এগিয়ে নিতে ছাত্র যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

ইয়ানা চাকমা বলেন, অধিকার কোন ফুলের পাপড়ি বিছানা নয়, অধিকার পেতে হলে রক্ত দিয়ে অর্জন করতে হবে। তাই দালাল, প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিহত করে জাতীয় আন্দোলনে নারী পুরুষ সবাই এক হয়ে লড়াই করতে হবে।

গঙ্গারাম হাজাছড়ায় আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউপিডিএফ সংগঠক কমন চাকমা ও সঞ্চালনা করেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্রগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার অর্থ সম্পাদক সুজয় চাকমা।

এতে বক্তব্য রাখেন হিল ইউমেন্স ফেডারেশন রাঙামাটি জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক বিশাখা চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি শুক্র চাকমা।

বিশাখা চাকমা বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি অধরাই রয়েছে। ২৮ বছর প্রমাণ হয়েছে চুক্তি একটি ‘অশান্তি চুক্তি’। এই চুক্তির মাধ্যমে যদি শান্তি ফিরে আসতো তাহলে আমাদের আর আন্দোলন করতে হতো না। তিনি অধিকার আদায়ের জন্য ইউপিডিএফের পতাকাতলে সমবেত হয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানান।

শুক্র চাকমা বলেন, অধিকারের সংগ্রামে যুবকদের অগ্রণী সৈনিক হতে হবে। দালাল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠিগুলোকে প্রতিহত করে পূর্ণস্বাশত্তশাসনে পতাকা তলে সমবেত হতে হবে।

কমন চাকমা বলেন, ১৯৯৭ সালের আজকের এই দিনে সন্তু লারমা জুম্ম জনগণের সাথে প্রতারণা করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আওয়ামী লীগের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। বর্তমান ছাত্র-যুবকদের এই চুক্তির ইতিহাস জানতে হবে।

তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছরেও সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না। কিন্তু জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন না করে ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে সংঘাত জিইয়ে রেখেছে। ইউপিডিএফ সংঘাত চায় না বলেই বার বার জেএসএস’র প্রতি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছে।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণের কাঙ্ক্ষিত অধিকার ও মুক্তি আনতে পারেনি। তাই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনকে একমাত্র মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিয়ে ছাত্র-যুব সমাজকে আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে।


বঙ্গলতলিতে
 অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ইউপিডিএফ সংগঠক বিটু চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর বাঘাইছড়ি উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ইমন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি উপজেলা সাধারণ সম্পাদক পরানী চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা সাধারণ সম্পাদক সমর চাকমা ও ইউপিডিএফ সংগঠক আদর্শ চাকমা।

ইমন চাকমা বলেন, আমরা সকলের জানি আজকের পার্বত্য চুক্তির ২৮ বছর হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তির মাধ্যমে আমাদের জুম্ম জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। এই চুক্তি আমাদেরকে ‘উপজাতি’ বানিয়েছে। আসলে আমরা কি ‘উপজাতি’?  

তিনি বলেন, আজকে ইউপিডিএফ এই আলোচনা সভা করছে এই কারণে যে, চুক্তি করে যে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে তা জানার জন্য। আমরা যদি ইতিহাস না জানি তাহলে বার বার ভুল করবো। জেএসএস নানা কথা বললেও এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ভাগ্যের যে পরিবর্তন হয়নি তা ২৮ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। ভবিষ্যতে চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে তাও আশা করা যায় না।

পরানী চাকমা বলেন, আজকে চুক্তির ২৮ বছর পূর্ণ হলো, কিন্তু এই চুক্তির মাধ্যমে আমাদের জুম্ম জনগনের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। তিনি চুক্তির আশায় না থেকে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে এগিয়ে আসার জন্য নারী সমাজসহ ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।

সমর চাকমা বলেন, চুক্তির আগে জেএসএস জুম্ম জনগণের স্বার্থে আন্দোলনে করেছে বলে জনগণ সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু জনগণের ঘামে, রক্তে গড়া আন্দোলনকে তারা প্রতারণামূলক চুক্তির মাধ্যমে শেষ করেছে। চুক্তির মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হলেও জেএসএস এখন সরকার-শাসকগোষ্ঠির হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আদর্শ চাকমা বলেন, আমরা সবসময় ন্যায়ের পথে থাকবো। জনগণের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবো। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখন একটি মৃত চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাই আমাদের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে হবে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More