পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট

0
ছবি: সন্তু লারমার চুক্তিতে স্বাক্ষর, ২ ডিসেম্বর ‘৯৭ (বামে) ও শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র সমর্পণ, ১০ ফেব্রুয়ারি ‘৯৮ (ডানে)। সংগৃহিত

মিল্টন চাকমা, সংগঠক ইউপিডিএফ, খাগড়াছড়ি



১৯৮০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ এবং জনসংহতি সমিতি ছিল একেবারে কোনঠাসা অবস্থা। সেনাবাহিনী ও সেটলারদের হামলা থেকে বাঁচতে ৬০ হাজার পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত। যারা দেশে ছিল, তারাও বড় গ্রাম, আদর্শ গ্রাম ও শান্তি গ্রাম নামক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী, যেখানে সেনাবাহিনীর অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না। শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম দমনের জন্য সেনাবাহিনীর সৃষ্ট লায়ন বাহিনী, টাইগার বাহিনী ও গপ্রক (গণ প্রতিরোধ কমিটি, যাকে সাধারণ জনগণ গুগরুক বাহিনী বলে ডাকতো) ইত্যাদি নামের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাদের উৎপীড়নে যেমন জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ, তেমনি তাদের দমনে জেএসএস পুরোপুরি ব্যর্থ।

১৯৮৯ সালের ২৫ জুন বাংলাদেশ সরকার তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন ঘোষণা করে। জেএসএস এই নির্বাচন বিরোধীতা করে ও বানচালের ঘোষণা দেয়। কিন্তু জেএসএস নেতৃত্ব নির্বাচন বানচাল করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে শান্তিবাহিনী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে শরণার্থীরা দলে দলে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরতে থাকে। জেএসএস নেতৃত্ব তাদেরকে কোনভাবে আটকাতে সক্ষম হচ্ছিল না। এদিকে শান্তিবাহিনীর সদস্যরাও জেএসএস নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারিয়ে একে একে দল ত্যাগ করে অস্ত্রসহ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করছিল। যাদের আত্মসমর্পনে করতে বিবেক সাঁয় দিচ্ছিল না, তারা যুদ্ধের মাঠে না যাওয়ার জন্য বিভিন্ন অজুহাত খুঁজে নিস্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছিল অথবা শরণার্থী শিবিরে মুখ লুকিয়ে ছিল।

জেএসএসের এই চরম দুঃসময়ে প্রসিত খীসার (বর্তমানে ইউপিডিএফ সভাপতি) নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব ছাত্র-গণ আন্দোলন সন্তু লারমার মুমুর্ষু নেতৃত্বের জন্য যেন দেবতার প্রেরিত এক আশির্বাদ হয়ে দেখা দেয়। পাহাড়ে হতাশার ঘোর অন্ধকারে আশার আলো জ্বেলে দেয়। ত্রিপুরার শরণার্থী শিবির থেকে পাহাড়ি বা জুম্ম শরণার্থীদের পালিয়ে আসা বন্ধ হয়। শান্তিবাহিনীর সদস্যদের দলত্যাগ ও আত্মসমর্পনও বারিত হয়। জনগণ নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন ফিরে পায়, আর সন্তু লারমার জেএসএস নেতৃত্বের কপালের ভাঁজ দূর হয়। অপরদিকে ছাত্র-গণ আন্দোলনের কারণে সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনও কমে যায়, ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীগুলো খড়কুটোর মতো ভেসে যায় এবং গুচ্ছগ্রামের জনগণ বন্দীদশা থেকে মুক্তি পায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ধরপাকড়, হয়রানি, নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রসিত খীসা। # ছবিটি ইউপিডিএফের ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহিত

প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গণ আন্দোলন সূচিত হওয়ার পর থেকে জেএসএসকে কার্যত আর কোন আন্দোলন করতে হয়নি। এই আন্দোলনের জোয়ারকে কাজে লাগিয়ে তারা সরকারের সাথে আপোষনামায় উপনীত হয়। ১৯৯১ সালের ১০ আগস্ট জেএসএস একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে, যদিও এই ঘোষণার আগে বড়, মাঝারী কিংবা ছোট আকারের কোন যুদ্ধ তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করতে পারেনি। সরকারও সোৎসাহে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়ে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখে।

এরপর থেকে সরকার ও জেএসএসের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ ও যুদ্ধ বিরতির মেয়াদ বৃদ্ধির পালা চলতে থাকে। সাধারণতঃ যুদ্ধ বিরতির সুযোগ নিয়ে যুদ্ধে নিয়োজিত পক্ষগুলো নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি ও নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। কিন্তু জেএসএস নেতৃত্ব এসময়ে সে ধরনের কোন কিছু করেনি। যুদ্ধ বিরতির সময় তাদের না করতে হয়েছে আন্দোলন, তারা না নিয়েছে নতুন যুদ্ধের বা নতুন সংগ্রামের প্রস্তুতি। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরের আগে সরকারের ওপর চাপ দেয়ার জন্য যখন জুম্ম জনগণের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার ছিল, ঠিক তখন বোকার মতো সন্তু লারমা নিজের আত্মসমর্পনের পথ পরিস্কার করতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, ১৯৯৫ সালের ১০ জুন পানছড়ির লোগাঙের ধুদুকছড়ায় আন্দোলনের বিরোধীতা করে জনসমাবেশে ঘোষণা দেন: গুলতি মেরে, সড়ক অবরোধ করে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা যায় না। তার এই বক্তব্য সে সময় জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রদীপ লাল ও কুসুম প্রিয় চাকমাসহ অনেকে প্রকাশ্যে সন্তু লারমার এই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। (অনেকের ধারণা, এই সমালোচনার কারণে সন্তু লারমা আত্মসমর্পনের পর প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের দু’জনকে খুন করেন।)

আগেই বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার পর জেএসএস আর কোন আন্দোলন করেনি। একের পর এক বৈঠক করে অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে “ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি” স্বাক্ষর করে। এই হলো সংক্ষেপে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পটভূমি।

আজ পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, প্রসিত খীসার নেতৃত্বে সে সময় ব্যাপক ছাত্র-গণ আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি না হলে জেএসএসের পক্ষে তাদের প্রিয় “ঐতিহাসিক চুক্তি” স্বাক্ষর করা কখনই সম্ভব হতো না এবং তাদের পরিণতি হতো অত্যন্ত করুণ। ইউপিডিএফ নেতার জন্য কোন কৃতিত্ব দাবির জন্য নয়, বরং বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য তুলে ধরতেই এই লেখাটির অবতারণা করা হলো।

(৪ ডিসেম্বর ২০২৫)

* লেখা সংগ্রহ: ইউপিডিএফের ফেসবুক পেইজ



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More