অমল ত্রিপুরা

পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তির আগে হাট-বাজার থেকে কত পরিমাণ জিনিসপত্র কেনা যাবে তা সেনাবাহিনীর কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হতো। অনুমতির বাইরে কোন জিনিসপত্র কেনা যেতো না। চুক্তির পর এখন ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে সেনাবাহিনীর অনুমতি নিতে হচ্ছে! ভাবতে অবাক লাগলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী পাহাড়িরা এখন এই পরিস্থিতির মুখোমুখি।
একাত্তরের আগে এদেশের মানুষেরও নিজের বাড়িতে অবস্থান করে নিরাপদে বসবাস করতে পারার নিশ্চিয়তা থাকতো না। পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী প্রতিনিয়ত নিপীড়ন-নির্যাতন, হয়রানি ও নারী ধর্ষণের মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এর জনগণের ওপর। ইতিহাসের পাতায় একাত্তরের আগেকার ঘটনাসমূহ তারই সাক্ষ্য বহন করে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শোষণ নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য বাংলার জনগণ নয় মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। এ যুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ সামন্যটুকু হলেও ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের সে অবদান অস্বীকার করেছিল। রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা সহজে তা ভুলে গিয়েছিল। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে পাহাড়িদের অধিকারের কথাতো দূরে থাক অস্তিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করা হয়নি। পাহাড়িদের দমন করতে ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সেই পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনা শাসন চলে আসছে। অধিকারের জন্য পাহাড়ি জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। ১৯৯৭ সালে সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির এক চুক্তির মাধ্যমে এই সশস্ত্র সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটলেও নিপীড়ন-নির্যাতন বহালই থেকে যায়।
‘পার্বত্য চুক্তি’র পর চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ শান্তির ধুয়ো তুলে পাহাড়ি জনগণকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। তবে সরকারের এই শান্তির ধুয়ো পাহাড়ি জনগণের কাছে ধোঁয়াশা থেকে যায়। ফলে পাহাড়ের তরুণ ছাত্র-যুব সমাজ ‘পার্বত্য চুক্তি’কে সমালোচনা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জারি রেখেছিল। তাঁরা ‘চুক্তির’ দ্বারা পাহাড়ি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না– এই বক্তব্য তখনকার সময়ে জনগণের নিকট তুলে ধরেছিল। তরুণদের এই বচন আজ সত্যি সত্যি বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। চুক্তির পরবর্তী আজ ২৫ বছর অতিক্রম হলেও পাহাড়িদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, পাহাড়ি জনগণ শান্তি ফিরে পায়নি।

এ বছর গত ১৭ জানুয়ারি রাঙামাটির লংগুদুতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর জোন কমান্ডার কর্তৃক এক পাহাড়ি বিবাহ অনুষ্ঠানে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীর ভাষ্যমতে ‘বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন বিয়ে বাড়ির পাশে একটি স্কুল মাঠে ডেকে নিয়ে ৩৭ বিজিবি’র রাজানগর ব্যাটালিয়নের জোন কম্যান্ডার লে. কর্নেল শাহ মো. শাকিল আলম ‘বিয়ের অনুষ্ঠানে কতজন আসবে? কারা কারা আসবে? কোথায় থেকে আসবে সবকিছু বিস্তারিত বিজিবিকে জানানো হয়নি কেন? এসব না জানালে কোন অনুষ্ঠানে করা যাবে না’ ইত্যাদি অকথ্য ভাষ্য ব্যবহার করে নানা হয়রানি করেন এবং শেষে জোনে হাজিরা দিতেও নির্দেশ প্রদান করেন।
গতকাল (৩ ফেব্রুয়ারি) আবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া এলাকায় ঘর নির্মাণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বাজার থেকে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী কাছে আবেদন করে অনুমতি নেওয়ার খবর সোশ্যাল মিডিয়ার ছড়িয়ে পড়লে এই নিয়ে অনেকে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সমালোচনা করছেন। যদিও সেনা-বিজিবি কর্তৃক বাবুছড়া ও সাজেকে পাহাড়িদের নতুন করে ঘর বাড়ি নির্মাণে বাধা প্রদান করা হচ্ছে গত বছরেরও আগে থেকে। এর মূল কারণ হলো দীঘিনালা সাধনা টিলা এলাকায় বহিরাগত সেটলার বাঙালি পুনর্বাসন করার প্রক্রিয়া বার বার ব্যর্থ হওয়া ও সমতল থেকে আসা পর্যটকদের আকর্ষণীয় করাতে সাজেকের মেইন সড়কের আশে-পাশে থেকে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা এবং পরবর্তী সময়ে সেসব স্থানে সেটলার বাঙালি পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে থাকা পাহাড়ি জনগণের এই দুঃখ, দুর্দশার কথা হয়তো দেশের জনগণ জানে না কিংবা জানতে দেওয়া হয় না, আর জানলেও এসব বিষয়গুলো তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। এদিকে, পাহাড়িদের মধ্য থেকে একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা শাসক গোষ্ঠীর সাথে আঁতাত করে নিজেদের স্বার্থ আদায় করছে। এই স্বার্থের জন্য অপর জনের কাছে নিজেরা যেমন বিক্রি হচ্ছে, অন্যদেরও বিক্রি করার ধান্ধায় রয়েছে। সমাজের মানুষেরা বিপদে আছে জেনেও তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। পাহাড়ি জাতির আত্মমর্যাদাবোধকে তারা ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে।
লংগুদু বিয়ের অনুষ্ঠানে বিজিবি’র হয়রানি ও দীঘিনালায় সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘর নির্মাণে অনুমতি নেওয়ার ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই আশির দশকের পরিস্থিতিকে আরো একবার পাহাড়ি জনগণকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও অধিকারকামী পাহাড়ি জনগণের মধ্যেকার সশস্ত্র সংগ্রামকে পুঁজি করে পাহাড়িদের ওপর কী নির্মম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানো হয়েছিল তার জ্বাজ্জল্য প্রমাণ এখনো আমাদের পূর্বসূরিরা বলে থাকেন। হাট-বাজারে গেলে সেনাবাহিনী অনুমতি নিতে হত। অনুমতি মিললে কে কত কেজি চাল, ডাল, লবন, আলু, মরিচ ইত্যাদি ক্রয় করতে পারবে সেটি সেনা চৌকি থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হত। এই ঘটনাটি এখনো ঘটছে লংগুদু, দীঘিনালা, সাজেকে। আগামীতে হয়তো তিন পার্বত্য জেলায় এটা ছড়িয়ে পড়বে। পাহাড়িদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে পরিকল্পিতভাবে এদেশের শাসক গোষ্ঠী একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে। এমতাবস্থায় আগামীতে পাহাড়ের পরিস্থিতি আবারো সেই আশির দশকের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে–এমন আশঙ্কা না করে পারা যায় না।
এদেশের লুঠেরা শাসক গোষ্ঠি চারিদিক থেকে ঘিরে ধরছে পাহাড়ি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করতে। পাহাড়ি জনগণের স্বাভাবিক নিঃশ্বাস ফেলার মতো কোন পরিস্থিতি সেখানে নেই, ধীরে ধীরে তাদের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা যতই পাহাড়ি বলে চিৎকার করি না কেন পাহাড়িরা আজ পাহাড়ের মানুষ নয়। পাহাড়ি জনগণ নিজ এলাকায় এখন পরবাসী হিসেবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা আজ নিজভূমে পরবাসী!
এমন পরিস্থিতিতে আশিস চৌধুরীর ‘পরবাসী’ কবিতার নীচের লাইনগুলো এখানে প্রণিধানযোগ্য।
“লুঠেরা আর তঞ্চকের দল
চারিদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে
এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে
এই দেশ এই দেশ এ আমার দেশ বলে
যতই চিৎকার করি না কেন
আসলে আমার দেশেই আমি পরবাসী আজ…
আর আমি নিজভূমে পরবাসী”।
* লেখক পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক।
[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।