প্রবন্ধ

পাহাড় : পর্যটন এবং জাতীয়তাবাদী ‘উন্নয়ন’ এর আড়ালে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা

0

সহুল আহমদ

বান্দরবানে পাঁচ তারকা হোটেল তৈরি হওয়ার তথ্য প্রথম চোখে পড়ে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি সংবাদে। সেখানে হোটেল তৈরির তথ্য প্রদানের পাশপাশি আরো কয়েকটা তথ্য প্রদান করা হয়েছিল। যেমন, মূল হোটেল বিল্ডিংয়ের সাথে পর্যটকদের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের সুবিধার্থে ১২টি পৃথক ভিলা, আধুনিক কেবল-গাড়ি থাকবে, রাইড এবং সুইমিং পুলসহ বিভিন্ন ধরণের বিনোদনমূলক সুবিধাও থাকবে। এবং এটি ‘বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে’। অর্থাৎ, এই সংবাদই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে সামনের দিনগুলোতে পর্যটকদের কপালে কি ‘স্বর্গসুখ’ অপেক্ষা করছে!

প্রকাশিত সংবাদে আরো একটি তথ্য ছিল: প্রকল্পটি সিকদার গ্রুপের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ডিভিশন, ৬৯তম ব্রিগেড সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেড যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে।

পর্যটকদের জন্য নানামুখী চিত্তাকর্ষক উপাদান আয়োজনের পাশপাশি স্থানীয় আদিবাসীদের জন্যও চিত্তাকর্ষক কথা বলা হয়েছে: ‘হোটেল নির্মাণ হলে স্থানীয়দের জীবনমান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে’৷ কিন্তু, এই ‘সুযোগ’ কিসের বিনিময়ে সৃষ্টি হবে? সহজ উত্তর: জমি।

যে এলাকায় [বিনোদনমূলক] পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দা ম্রো জনগোষ্ঠীর আশঙ্কা হচ্ছে এই হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্রের কারণে ‘এক হাজার একর জমি বেহাত হয়ে যাবে৷ উচ্ছেদ হবে পাঁচ গ্রামের মানুষ৷’ প্রায় ১১৬টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হবে। প্রায় ১০ হাজার জুমচাষি উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। ডয়েচ ভেলের প্রতিবেদনে ওই এলাকারই বাসিন্দা রেং ইয়াং ম্রো বলেন, ‘তারা বলছেন ২০ একর জায়গায় হোটেল করবে৷ কিন্তু এরইমধ্যে আরো বেশি জায়গা জুড়ে তারা ঘিরে ফেলেছে৷ পাহাড় কাটা শুরু করেছে৷ ফলের বাগান নষ্ট হওয়ার পথে৷ পাহাড়ি ঝর্না বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ তারা পর্যটন কেন্দ্র করবে৷ ক্যাবল কার দিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ঘোরার ব্যবস্থা করবে৷ আমাদের আশঙ্কা এক হাজার একরের মতো জমি তাদের দখলে চলে যাবে৷ সরাসরি পাঁচটি গ্রাম ও তার বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ আর এর প্রভাবে আরো ১০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷’

অথচ এসব করা হচ্ছে পর্যটনের জন্য। আমাদের রাষ্ট্রের কাছে উন্নয়ন (এই ক্ষেত্রে উন্নয়নের চেহারা হচ্ছে পর্যটন) খুব গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি মানুষের চেয়েও। মানুষের ‘জীবনমান’ এর ‘সুযোগ’ তৈরির জন্য তাদেরকে উচ্ছেদ করতে হলেও করা হবে, তবু পর্যটনে কোনো ছাড় দেয়া চলবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন ‘জোরজবরদস্তিমূলক’ পর্যটন-নির্মাণ আঁতকা কোনো ঘটনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ইলিরা দেওয়ান সম্প্রতি শুদ্ধস্বরে প্রকাশিত একটি লেখায় বলেছিলেন, ‘বড়সড় সমাবেশ হয়েছে বলে আজ সকলেই জানলেন ম্রো’দের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে সেখানে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কখনো সদম্ভে, কখনো নীরবে পাহাড়িদের, এই ম্রো’দের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে রিসোর্ট, রাবার বাগান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে সে খবর কজনই বা রাখেন। আরেকদিকে রাতের আঁধারে অজানা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত জেনেও কেউ কেউ হচ্ছেন দেশান্তরী।’

নিও-লিবারেল জমানায় বাংলাদেশের মতন রাষ্ট্রগুলোর সহিংস চরিত্রকে বোঝার জন্য পর্যটনের স্বরূপ বোঝা দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা নিয়ে গবেষক হানা শামস আহমদের মাঠপর্যায়ের গবেষণা আমাদেরকে পর্যটনের সাথে সহিংহতার সম্পর্ক বিষয়ে আন্দাজ দিতে পারে।

ট্যুরিজম বা পর্যটন যে কোনো একটা অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে আড়াল করতে বা নিরবতার চাদরে ঢেকে একধরণের জনসম্মতি আদায়ে খুব কার্যকর কৌশল। এই ধরণের ট্যুরিজমের উদাহরণ কাশ্মীর, শ্রীলঙ্কা, ফিলিস্তিনে দেখা যায়। হানা শামস আহমেদ একই বিষয় লক্ষ্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও।

পর্যটন এবং উন্নয়নের নাম করে রাষ্ট্র, মিলিটারি, ক্ষমতাসীনরা জায়গাজমি দখল করে। আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে। এবং এইসব কিছু করার জন্য রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদী উগ্রতা দূর্দান্তরূপে কাজে লাগায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ‘বাঙ্গালি-মুসলমান’ এই জাতীয়তাবাদ খুব কার্যকর; পাহাড়িদের দ্বারা বাঙালি-মুসলমানরা আক্রান্ত হতে পারে; এমন একটা ভয়ের উৎপাদন-পুনরুৎপাদন একটা বিরাট এলাকা সামরিকায়িত করার পক্ষে সম্মতি আদায় করে। যদিও সেটা পর্যটনের নাম করে, কিন্তু যারা পর্যটক তারাও একধরণের ‘নিরাপদ’ অনুভব করেন। কিন্তু, কেন এই ‘নিরাপত্তা’ দরকার, অর্থাৎ কোন সংঘর্ষের কারণে সেখানে ‘নিরাপত্তা’র প্রয়োজন, সেই সংঘর্ষইবা কেন সে দিকে পর্যটকদের মনযোগ না দিলেও চলে। পর্যটকরা বরঞ্চ ‘পাহাড়ের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য’ উপভোগ করতে যাবেন, আদিবাসীদেরকে ‘দর্শনীয়’ উপাদান হিসেবে তাদের ছবি ও দৃষ্টির অবজেক্ট করে তুলবেন, আচার আচরণে নিজেদের ঔপনিবেশিক খায়েশ পূরণ করবেন- এইসবকেই খুব স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া হয়েছে।

অবশ্য দেশী বিদেশী গবেষকদের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অনুমতি ব্যতীত আদিবাসীদের সাথে কথা বলাতেও নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল অনেক সময়। কানাডার সরকার তার নাগরিকদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভ্রমনে সতর্ক করে দিয়েছিল।

মূলত রাষ্ট্র এই পর্যটন প্রকল্প দিয়ে আসলে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে, এটাকে ব্যবহার করে একটা অঞ্চলে তার আধিপত্য বজায় রাখে। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, যেটা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে হানা শামস তুলে আনেন যে, সেখানে প্রশাসনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রমাধিকারতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে পর্যটন ভূমিকা পালন করে। পর্যটন দিয়ে সেখানকার নিপীড়ক ও নিপীড়নের মধ্যকার নিপীড়নমূলক সম্পর্কের একধরণের নরমেলাইজ করা হয়।

আদিবাসী ট্যুরিজমই দেখিয়ে দেয় যে, এমন পর্যটন মোটেও রাজনীতি-নিরপেক্ষ বিষয় না। এর সাথে সম্পর্কিত প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দেয় যে এটা একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং এখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব জড়িত।

বর্তমানে নিওলিবারেল জমানায় পাহাড় হয়ে উঠছে ব্যবসায়িক হাব। বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা সেখানে গিয়ে ইনভেস্ট করছেন। যারা ইনভেস্ট করছেন তারা প্রায় সকলেই বাঙালি অভিজাত গোষ্ঠীর। এটা কিন্তু কেবল গবেষকের কথা না, একেবারে মন্ত্রী-কর্তৃপক্ষসহ সবাই বিষয়টাকে এভাবেই দেখেন। ফলে পাহাড়ে ভূমিধ্বসের ঘটনার পর তাদের আগ্রহ মূলত থাকে পর্যটনে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হলো এই দিকে, সেখানকার মানুষের জীবনের দিকে নয়।

বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপ, যারা পাহাড় নিয়ে কাজ করেন, তারা বহু হিসাব দেখিয়েছেন: কীভাবে পর্যটনের নামে সেখানে কতটা জায়গায় দখল করা হয়েছে, কতটা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যেমন বান্দরবানের নীলগিরির জন্য সেখানে ২০০ ম্রো ও মারমা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এবারের হিসাবটা উপরেই দেয়া হয়েছে।

এই ধরণের ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প বা জায়গা দখলের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয় বেশ কিছু কারণে। যেমন, আইনি ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা, সরকার কর্মকর্তার দুর্নীতি, সামরিকায়নের পক্ষে জনসম্মতি, সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে রাষ্ট্রীয় সম্মতি উৎপাদন, ট্যুরিজম সেক্টরে বৈশ্বিক পুঁজির প্রবেশ – এইসব কিছুই জমি দখলের দূর্দান্ত পরিস্থিতি হাজির করে।

এই ভূমি দখল করতে বা কেড়ে নিতে আদিবাসীদের কোনো ধরণের সম্মতি নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অনেকেই বলেন যে, কোনো নিয়ম মানাও হয় না। আবার এটাও বলা হয় যে, কাঠামোটাই এমনভাবে বানানো সেখানে আদিবাসীদের কিছুই করার থাকে না। সামরিক ব্যক্তি ও অভিজাত বাঙালিরা যা চান সে অনুযায়ীই হয়ে থাকে। আবার ভূমি দখলে ‘ধর্ষণ’কেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বিশেষত ভয় দেখিয়ে জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে, অন্য জায়গায় চলে যেতে, কম দামে জায়গা কিনে নিতে। পাহাড়ে যে বছরের পর বছর ধরে সিস্টেমেটিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেটা নিয়ে একেবারে মূলধারার প্রকাশিত বইপত্র রয়েছে। হানা শামস তাঁর গবেষণায় বলছেন, বর্তমানে পর্যটন সেখানে সেক্স-ট্রাফিকিং, চাইল্ড প্রস্টিটিউশন, ধর্ষণের মত ঘটনা আরো বাড়িয়ে তুলছে। বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামো এসব ঘটনাকে ইচ্ছেমতন রেহাই দিচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে পাহাড়ে জেনোসাইড-গণহত্যা-জাতিহত্যার অভিযোগ উঠেছিল সেটাতো ভেলাম ভ্যান সেন্দেল এর মতো বিখ্যাতদক্ষিণ এশীয় গবেষকরাও উল্লেখ করেছেন। ১৯৮৬ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলানের রিপোর্ট ‘জেনোসাইড’ শব্দটা উল্লেখ না করলেও ঘটনার ‘জেনোসাইডাল প্রক্রিয়া’ নিয়ে বিশদ আলাপ করেছে। গবেষক মার্ক লেভেনে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে বলেছেন ‘ক্রিপিং’ জেনোসাইড।তিনি এই জেনোসাইডের রাজনৈতিক-অর্থনীতির সন্ধান করেছেন, এবং সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন যে, এটা আসলে জাতিকেন্দ্রিক সংঘাত নয়। বরঞ্চ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প সেটাই এই জেনোসাডের জন্ম দিচ্ছে, কিন্তু এটা একটা জাতিগত বাহ্যিক রূপ নিচ্ছে, বা দেয়া হচ্ছে। তিনি এও বলেন, আধুনিক জেনোসাইড সাধারণত উন্নয়নের প্যাটার্নের মধ্যেই নিহিত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন’ কর্মসূচির পাশপাশি এর সাথে জড়িত পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়েও বিস্তারিত আলাপ করেছেন। তিনি এর জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাঠামোগত দুর্বলতা, গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতি ইত্যাদির দিকেও ইঙ্গিত দেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘উন্নয়ন’ নিয়ে মার্ক লেভেনের আলাপ কিন্তু আজকের নয়, ১৯৯৯ সালের।

বর্তমানে পাহাড়ে যে পর্যটন আছে সেটা আসলে পুরোপুরি সহিংসতার উপর দাঁড়ানো। গবেষক হানা শামস আসলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটাইদেখান যে, কীভাবে রাষ্ট্র-প্রণোদিত এই পর্যটনের গোড়া ডমিন্যাশন ও রেপ্রিজেন্টেশনের উপনিবেশিক কায়দা কানুন এবং উপনিবেশিক জ্ঞানকান্ডের উপর নির্ভরশীল।

তবে, একটা বিষয় সবসময় আলাপে উঠে। যখন নারীদের অধিকার বিষয়ে আলাপ করবেন তখন অনেকেই বলে যে, মানবাধিকার নিয়ে বললেই তো হয়; আলাদা করে নারীদের জন্য কেনো আলাপের দরকার? বা এবার যখন মার্কিন মুলুকে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন শুরু হলো, তখন অনেকেই বলা শুরু করলেন, কেন? তাইলে কি অল লাইভস ম্যাটার না? তো, নারীবাদী চিমামান্দা গজি অ্যাদিচি বলেছিলেন যে, আপনি যখন নারীদের অধিকারের কথার বিরুদ্ধে মানবাধিকারের কথা বলবেন, তখন আসলে আপনি অস্বীকার করতে চান নারীর বিরুদ্ধে একটা পদ্ধতিগত দমনপীড়ন চলে, এবং সমাজে নির্দিষ্ট ও বিশেষভাবে লিঙ্গ-সমস্যা বিদ্যমান। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার নিয়ে থিয়োঙ্গোও একইভাবে বলেছিলেন, সাদাদের জীবন তো ক্ষমতাকাঠামোতে সবসময়ই ম্যটার করতো। একইভাবে আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে, এখানেও একইভাবে আওয়াজ তোলা যায়, কেন সারাদেশের মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা হচ্ছে না? আমরাই তো আদিবাসী ইত্যাদি। আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে আলাপ না করা বা ‘আদিবাসী’দের অস্বীকার করার মূল কারণ হচ্ছে এই রাষ্ট্রে যে একটা জাতিগোষ্ঠী ‘সিস্টেমেটিক্যালি’ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হচ্ছে সেটা অস্বীকার করা। এখানে বাঙালি-মুসলমান জাতীয়তাবাদকে দূর্দান্তরূপে কাজে লাগানো হয়ে থাকে।

এই জমানার আওয়ামী জাতীয়তাবাদীরা মানতেই চান না, বাংলাদেশে আদিবাসী আছে। তাদের এই সুর আসলে রাষ্ট্রীয় সুর। ২০১১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তো অফিসিয়ালি সেটা অস্বীকার করেছে। এক অফিসিয়াল বিবৃতিতে বলা হয়, ‘Steps should be taken to publicize/broadcast in the print and electronic media that there are no Indigenous people in Bangladesh. The month of August is recognized nationally as the month of mourning. Hence, such unnecessary celebration programmes in the name of Indigenous Day in this month should be avoided.’ [শামসের থিসিস থেকেই উদ্ধৃত করা হলো।]

পাঠক খেয়াল করে দেখবেন, কি অদ্ভুত কলাকৌশলে শোকের মাসের সাথে আদিবাসী দিবস উদযাপনকে বিপরীতে ঠেলে দেয়া হলো। কেউ কেউ এইটাকে বলেছেন ‘সংখ্যাগুরুর স্বৈরশাসন’। কিন্তু রাষ্ট্রের এই অস্বীকারটাকে স্রেফ ‘অস্বীকার’ বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। মাসউদ ইমরান মান্নু ‘বাঙালিত্ববাদ: জাতীয়তাবাদি ইতিহাস-রচনার রাজনীতি’ নামক ছোট এক পুস্তিকায় এই অস্বীকারের সুলুক সন্ধান করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন এই অস্বীকার আসলে আমাদের ইতিহাসরচনার ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি চূড়ান্ত আলামত। নৃবিজ্ঞানী প্রশান্ত ত্রিপুরা তার বইগুলোতে দেখিয়েছেন, কীভাবে এখানকার জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কিত ঔপনিবেশিক ও বর্জনমূলক ধ্যানধারণা অন্যান্য জাতিসত্ত্বা ও তাদের ভাষাকে উপেক্ষা করছে, এবং করে যাচ্ছে।

বাহাত্তরের সংবিধানের বিতর্কটা মনে থাকলে আশা করি যে কোনো পাঠকের মনে পড়বে, কীভাবে একজন প্রতিনিধি সংবিধানে বহুজাতিসত্ত্বাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পীড়াপীড়ি করছেন, এবং কীভাবে একটি বৃহৎস্বর সেটাকে তুচ্চ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিচ্ছে। এই বৃহৎস্বরই যে পাহাড়কে রক্তাক্ত করার অন্যতম কারণ সেটা আমাদের বহু মূলধারার বুদ্ধিজীবীও ধরতে পারেন নি। ধরতে পারার কথাও নয়, তারাও তো সেই বৃহৎস্বরেরই অংশ, এমনকি প্রচারকও ছিলেন। যেমন, আমাদের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সবুজ পাহাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরণাধারা’ বইটার কথা বলা যেতে পারে। তার মতে, সামরিক বাহিনীর সাথে সাধারণ জনগোষ্ঠীর যে মানসিক দূরত্ব সেটাকে কাজে লাগিয়ে ‘উপজাতি’ শান্তিবাহিনীরা সেনাবাহিনীর নামে অপপ্রচার চালিয়েছে। তাই তিনি মনে করেন, ‘সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উদ্ধার করা দরকার’। সেই উদ্ধারকার্যে সামরিক বাহিনীর আমন্ত্রণেই হুমায়ূন আজাদ গিয়েছিলেন।

পাহাড়ে কীভাবে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, কীভাবে চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে পাহাড়ে দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিল, এমন ‘সাম্প্রতিক’ কোনো ইতিহাসের খবরাখবর না দিয়েই তিনি তার বিশ্বাসের কথা বলেন: ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষীরা এসব কিছু করতে পারে।’ তিনি সামরিক বাহিনীর যুক্তিও তুলে ধরেন, ‘কোন বিদ্রোহই প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা দিয়ে দমন করা যায় না, রক্ত ঝরাতে হয়…।’ তিনি উপনিবেশিক শাসকদের মতো করে রায় দেন, ‘পূর্বপুরুষের বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে অনেক সময় রচিত হয় উত্তরপুরুষের সুখ… বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সমগ্র জনগণের মতোই পাহাড়ি জনগণকে আধুনিক গণতান্ত্রিক অধিকারসম্পন্ন সচ্ছল শিক্ষিত মানুষে পরিণত করা’। অর্থাৎ, হুমায়ূন আজাদের মতে আজকের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভেতর লুকিয়ে আছে আগামী দিনের সুখ। হুমায়ূন আজাদ প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ও লেখক ছিলেন, ফলে তার অনুসারী ও অনুগামীর সংখ্যাও ব্যাপক। তাদের লেখাতেও এই ‘বৃহৎসুর’ পাওয়া যায়। উদাহরণ বেশি দেয়ার দরকার নেই।

এই মুহূর্তে আবারো লেখার শুরুর দিকে যাই। বলা হয়েছিল প্রকল্পটি সিকদার গ্রুপের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেড যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে। এই সিকদার গ্রুপ কে বা কারা? প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে এই গ্রুপের টাকা পাচারের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে তাদের রয়েছে বিপুল সম্পত্তি। প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে, ‘সিকদার গ্রুপের এসব সম্পদ বাড়তে শুরু করে এক দশক ধরে। আর তাদের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক খারাপ হতে শুরু করে ওই সময় থেকে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কোনো অর্থ বিদেশে নেয়নি পরিবারটির কোনো সদস্য।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে যারা বিদেশে বিনিয়োগ করেছে, তাদের মধ্যে সিকদার গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। অনুমোদন ছাড়া কেউ দেশের বাইরে টাকা নিলে অর্থ পাচার আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে।’ সম্প্রতি সিকদার গ্রুপ আলোচনায় আসে এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে। গত ১৯ মে এই অভিযোগে সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মামলায় জানানো হয়, সিকদার গ্রুপ ব্যাংকটির কাছে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ প্রস্তাব দিলে এর বিপরীতে গ্রুপের বন্ধকি সম্পত্তি পরিদর্শনে যান ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। সেসময় এ ঘটনা ঘটে, যোগ করেন তিনি। কিন্তু ২৫ মে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামী এই দুই ভাই নিজেদের মালিকানাধীন আরঅ্যান্ডআর এভিয়েশনের একটি উড়োজাহাজকে ‘রোগীবাহী’ হিসেবে দেখিয়ে ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। বিভিন্ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে সিকদার গ্রুপের যে চিত্র উঠে আসছে তাতে ‘মাফিয়া’ ও ‘পাচারকারী’ চরিত্রই হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বান্দরবানে পাঁচ তারকা হোটেল ও পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে এমন ‘মাফিয়া’ ও ‘সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট’ একত্রে কাজ করছে। যদিও সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ‘যেখানে সেনাবাহিনী এই কাজের সাথে জড়িত সেখানে কোনো অনিয়ম হবে না৷ হতে দেয়া হবেনা৷’ অথচ দেশী-বিদেশী গবেষণায় পাহাড়ে সহিংসতা সেনাবাহিনীকেই সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করা হয়েছে! মার্ক লেভেনে থেকে শুরু করে হানা শামস আহমেদ পর্যন্ত সবাই সেনাবাহিনীর দিকেই আঙুল তুলেছেন।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে একটা সরল সমীকরণ হাজির করেছে। আমাদের মানে এই ভূখণ্ডের সবাই: পাহাড়ে-সমতলে। উদাহরণ হিসাবে এই ঘটনাকেই নেয়া যেতে পারে। বর্তমানে জারি থাকা ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে আওয়ামী-রেজিম যে জাতীয়তাবাদী প্রপাগান্ডাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে, সেই একই জাতীয়তাবাদকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ভিন্ন জাতিসত্তাকে অস্বীকার করতে। অর্থাৎ, এখানে জাতীয়তাবাদ দুটো পর্দা হিসাবে হাজির। এক, জাতীয়তাবাদী-পরিচয়বাদী রাজনীতি দিয়ে এই ‘মাফিয়াতন্ত্র’ গুম-ক্রসফায়ারসহ নানা ধরনের আইনি জুলুমের মচ্ছব তৈরি করেছে, এবং বহুলাংশে সমতলেই। দুই, পাহাড়ে অন্যান্য জাতিসত্তাকে ‘শত্রু’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে কল্পিত পাহাড় ‘জয়’ এবং ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা’র শ্লোগানে সংখ্যাগরিষ্ঠকে বুদ করে পাহাড়ের জুলুমকে আড়াল করছে বা জুলুমের পক্ষে সম্মতি আদায় করছে। এই জাতীয়তাবাদী প্রচারণার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে সেনাবাহিনী ও তার ‘শ্রেষ্ঠত্ব’। এতে জ্বালানিস্বরূপ আমাদের বুদ্ধিজীবীদের লেখাপত্র তো রয়েছেই, উপরে কেবল একটা নমুনা দিলাম। আবার, এই সিকদার গ্রুপ রাষ্ট্রীয় সহায়তাতেই একদিকে দেশের জনগণের টাকা বাইরে পাচার করছে, অন্যদিকে বাঙালি এলিটদের প্রতিনিধিস্বরূপ পাহাড়েও গড়ে তুলছে ব্যবসায়িক হাব, উচ্ছেদ করছে সেখানকার বাসিন্দাদের। সেদিক থেকে বাংলাদেশের আপামর জনগণ আওয়ামী ফ্যাসিবাদ, নিওলিবারেল জমানার গ্লোবাল পুঁজি (ম্যারিয়ট হোটেল), দেশীয় মাফিয়া ও অর্থ-পাচারকারী এবং সেনাকর্পোরেটতন্ত্রের খপ্পরে পড়েছে। অর্থাৎ একটা বহুজাতিক-বহুমুখী-রাজনৈতিক মাফিয়াতন্ত্রের খপ্পরে যেমন পাহাড়ের বাসিন্দারা পড়েছেন, তেমনি পড়েছেন সমতলের বাসিন্দারাও। এই সরলীকরণ কোনোভাবে পাহাড়ে জারি থাকা পদ্ধতিগতভাবে বৈষম্যকে ছোট করে দেখাচ্ছে না, বরঞ্চ এটা দেখাচ্ছে যে, পাহাড়ে-সমতলে প্রধান শত্রু আপাতত বহুলাংশে একই। এর সঙ্কট রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই নিহিত আছে: এই অগণতান্ত্রিক-মাফিয়াতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই। বাহাত্তরের গণপরিষদে জাতি পরিচয় নিয়ে মানবেন্দ্র লারমার যুক্তি-তর্কের কথা মনে রাখলেই এর অগণতান্ত্রিক চেহারার খোঁজ পাওয়া যাবে।

ফলে বহুজাতির বাংলাদেশ গড়ার জন্য এই রাষ্ট্রের কাঠামোকেই বদলে দেয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই; রাষ্ট্রের ‘মাফিয়াতন্ত্র’ ‘গুমতন্ত্র’ ‘ক্রসফায়ারতন্ত্র’মতো আরো বহু তন্ত্রকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। এখানে আমাদের লড়াই একই। বান্দরবানে এই পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন তাতে সামিল হওয়া আমাদের সকলেরই উচিৎ। আমরা সকলেই এই মুহূর্তে একই শয়তানের খপ্পরে রয়েছি। শয়তানের স্বরূপটা আশা করি পাঠক বুঝতে পারবেন।

১) Hana S Ahmed, ‘Tourism and state violence in the Chittagong Hill Tracts of Bangladesh’; in  Mohammad Tanzimuddin Khan & Mohammad Sajjadur Rahman (ed.) Neoliberal Development In Bangladesh: People on the Margins, UPL, 2020

২) দেখতে পারেন: ভেলাম ভ্যান সেন্দেল ও এলেন বল, বাংলার বহুজাতি: বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতির প্রসঙ্গ, ১৯৯৮

৩) দেখতে পারেন: Amnesty International Report, ‘Bangladesh: Unlawful Killings and Torture in the Chittagong Hill Tracts’, 1986

৪) Mark Levene, ‘The Chittagong Hill Tracts: a case study in the political economy of ‘creeping’ genocide’, Third World Quarterly, Vol 20, No 2, 1999

৫) দেখতে পারেন: মাসউদ ইমরান মান্নু, ‘বাঙালিত্ববাদ: জাতীয়তাবাদী ইতিহাস-রচনার রাজনীতি’, পাবলিক নৃবিজ্ঞান, দৃক।

৬) প্রশান্ত ত্রিপুরার বই: ‘ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ’ (২০২০), ‘বহুজাতির বাংলাদেশ স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস’ (২০১৫) ও অন্যান্য।

৭)  হুমায়ূন আজাদ, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা, আগামী, ২০১৪

 

Sohul Ahmed, activist, and author. Topics of interest are politics, history, liberation war, and genocide. Published Books: Muktijuddhe Dhormer Opobabohar (2017), Somoyer Bebyocched (2019), and Zahir Raihan: Muktijuddho O Rajnoitik Vabna (2020)

 

সৌজন্যে: শুদ্ধস্বর ডটকম

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More