মুক্তমত

পিসিপি প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছর : ছাত্র সমাজের কাছে জনগণের চাওয়া-পাওয়া

0

সুযশ চাকমা


বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি লড়াকু সংগঠন। আজ ২০ মে ২০২২ এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার আজ ৩৩ বছর পূর্ণ হলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে লড়াই-সংগ্রামে এ সংগঠনটির রয়েছে অনন্য অবদান। ১৯৮৯ সালের ২০ মে গঠনের পর লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা এই সংগঠনটির জন্ম দেন এবং প্রথম বারের মতো ঢাকার রাজপথে মৌন মিছিলের মাধ্যমে এ সংগঠনটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল।

সেই থেকে আজ অবধি সংগঠনটি তার সংগ্রাম জারি রেখেছে। তবে এখানে না বললেই নয় যে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সংগঠনটির বিভক্তি দেখা দেয়। এর একটি অংশ সরকার ও জেএসএস’র মধ্যেকার স্বাক্ষরিত চুক্তির পক্ষ নিয়ে সংগঠনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়ায়। মূলত এই অংশটিকে নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে লক্ষ্যচ্যুত করা হয়েছিল। তবে সংগঠনের মূল অংশটি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে এবং পরবর্তীতে এই সংগঠনের নেতারা পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি নিয়ে ইউপিডিএফ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং পিসিপি’র মূল অংশটি এই দলটির সাথে যুক্ত হয়।

এই বিভক্তির বেড়াজালে থাকা ঐতিহাসিক এই ছাত্র সংগঠনটি তেত্রিশ বছর পূর্ণ করে চৌত্রিশ-এ পা রাখছে। তেত্রিশ বছর কিন্তু কম সময় নয়। গুণে গুণে তিন দশকেরও বেশি সময়। নানা ঘাত-প্রতিবাদ ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে এত বছর ধরে সংগঠনটির টিকে থাকা নিশ্চয় গৌরবের। তবে কথা হলো, শুধু বয়স বৃদ্ধি হলে তো হবে না, তার দৈহিক গড়নটাও তো সেভাবে পোক্ত হতে হবে। অর্থাৎ সংগঠনের শক্তি ও আন্দোলনের পরিধিও সেভাবে বৃদ্ধি করতে হবে।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ যে অবদান রেখেছে তা ইতিহাসের অনন্য নজির হয়ে থাকবে। যেখানে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে জনগণ মুখ খুলে কথা বলার অধিকারও হারিয়েছিলো সেই কঠিন সময়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রুখে দাঁড়িয়েছিলো, রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। যার ফলে নিপীড়িত মানুষ মুখ খুলে কথা বলার সাহস পেয়েছিলো। জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র সমাজের যে কী ভূমিকা তা বিশ্বের অন্যান্য সফল আন্দোলনের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তা দেখিয়ে দিতে সক্ষম হয়। যার কারণে শাসকগোষ্ঠি তথা সরকার যেভাবে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলন দমনের নামে খুন, গুমসহ অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতন জারি রেখেছিলো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে তা থেকে অনেকটা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এটিই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলেনের সফলতার অন্যতম দিক।

লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-এর প্রথম মৌন মিছিল। ২১ মে ১৯৮৯, ঢাকা। ফাইল ছবি।

একটি ছাত্র সংগঠনের প্রাণ হচ্ছে ছাত্র সমাজ। ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই একটি ছাত্র সংগঠন বলিষ্ট নেতৃত্ব ও আন্দোলন বেগবান করতে পারে। নব্বই দশকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনে সফলতা অর্জনের প্রধান ভূমিকা পালনকারী হচ্ছে ছাত্র সমাজ। দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ব্যাপক সংখ্যক ছাত্র এই সংগঠনের সাথে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও গোটা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শাখা গড়ে ওঠে। এতে করে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ছাত্র-গণআন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হয়।

কিন্তু বর্তমানে ছাত্র সমাজের মধ্যে আন্দোলনের প্রতি উদাসীনতা লক্ষ্য করার মতো। এক্ষেত্রে অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে দায়ি করে থাকেন। এই সংঘাতের কারণে ছাত্ররা আন্দোলনে যুক্ত হতে চায় না—এমন কথাবার্তাও শোনা যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। এর মধ্যে একটি অংশ সকল ত্যাগ স্বীকার করে আন্দোলনে যুক্ত হয়। আরেকটি অংশ ছাত্রত্ব থাকা অবস্থায় আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে নিজের স্বার্থের কাজে জড়িয়ে পড়ে। হয় সে চাকুরিতে যোগ দেয়, নতুবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিয়োজিত হয়। আর বৃহৎ অংশটি আন্দোলনের সাথে যুক্তই হতে চায় না। তারা আন্দোলনে যুক্ত হওয়াকে বিপদ মনে করে একেবারেই দূরে দূরে থাকে। এই হচ্ছে বর্তমান ছাত্র সমাজের বাস্তবতার দিক।

মনে রাখতে হবে, শাসকগোষ্ঠি চায় ছাত্র সমাজ আন্দোলন থেকে বিরত থাকুক। সে লক্ষ্যে তারা নানা প্রলোভনের ফাঁদ পেতে ছাত্রদের আন্দোলন থেকে বিচ্যুত রাখতে চায়। এই থেকে ছাত্র সমাজকে সতর্ক থাকা জরুরী।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে এক অরাজকতা বিরাজ করছে। ভূমি বেদখল-উচ্ছেদ, নারী নির্যাতন, অন্যায় দমন-পীড়ন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র সমাজ নিরব হয়ে বসে থাকবে—এটা কখনো হতে পারে না। একটি জাতির ক্রান্তি লগ্নে ছাত্র সমাজকেই হাল ধরতে হয়।

ছাত্র সমাজের কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত ও ‍মুক্তিকামী জনগণের চাওয়া-পাওয়া অনেক। জনগণ চায় নব্বই দশকে যেভাবে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে ছাত্র-গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিলো আগামীতেও ছাত্র সমাজ একইভাবে গণআন্দোলন গড়ে তুলবে। সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে ছাত্র সমাজ এগিয়ে আসবে। সকল অন্যায় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ রুখে দাঁড়াবে।  

তাই, ছাত্র সমাজকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়েই পার্বত্য অঞ্চলের নিপীড়িত জনগণের এই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

২০.৫. ২০২২

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More