পি.পি.এস.পি.সি : পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন অধ্যায়
।। রবীন মেন্দর ।।
ভূমিকা : সাম্প্রতিক কালে পার্বত্য চট্টগ্রামে(পার্বত্য চট্টগ্রামে) রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এক ব্যাপক ও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেনাবাহিনীর লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসী গুন্ডাদের বলগাহীন তান্ডব ও উৎপাতে খাগড়াছড়ির জনজীবন বিষিয়ে উঠেছে। এদের দাপটে কেউ শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে পারছে না। তথাকথিত “পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণ পরিষদের সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি (P.P.S.P.C) নামধারী সন্ত্রাসী মাস্তানদেরকে সেনাবাহিনী খুন, তান্ডব ও ধ্বংসলীলা চালানোর লাইসেন্স প্রদান করেছে। সাধারণ বেসামকি প্রশাসনও এদের হাতে জিম্মি। পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসন সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র ও নীল নকশা বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী একটি সংস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই সেনাসৃষ্ট সন্ত্রাসীরা অপরাধ করেও immunity ভোগ করে চলেছে।
গজিয়ে ওঠার পটভূমি ও রহস্য : সন্ত্রাসীরা বা “মুখোশদের” (জনগণের ভাষায়) গজিয়ে ওঠার একটি পটভূমি রয়েছে। এর সৃষ্টি রহস্যও আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করার মধ্য দিয়ে ১৯৮৯ এর ২০ মে গঠিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্ম এক বিরল ঐতিহাসিক ঘটনা। নিপীড়ন নির্যতিন ও শোষণ বঞ্চনার পাহাড় ভাঙার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে লড়াই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিবাদী নতুন প্রজন্ম। জুম্ম তরুণ ছাত্র সমাজের এই ঐতিহাসিক ও সময়োপযোগী উত্থানে শোষক শাসক গোষ্ঠী হতচকিত হয়ে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা হরণকারী সেনা আমলারা পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের এই উত্থানকে সহজভাবে মেনে নেয়নি।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও পাহাড়ী গণপরিষদ অবিচলভাবে সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন ও কুকীর্তির চিত্র দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরে, প্রতিবাদ জানায় ও এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনপ্রতিবাদ গড়ে তোলে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামরত পাহাড়ী গণ পরিষদ ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রাকে স্তব্দ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকার ও সেনাবাহিনী নানান ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে। এই দুই সংগঠনকে মোকাবেলার জন্য সেনাকর্তারা তাড়াহুড়া করে দু’একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র সাম্প্রদায়িক বাঙালী সংগঠনের জন্ম দেয়। যেমন বাঙালী কৃষক শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ, পার্বত্য গণ পরিষদ ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, সরকার জুম্ম প্রতিক্রিয়াশীল দুলাগোষ্ঠীর সংগঠন প্রত্যাগত শান্তিবাহিনী কল্যাণ ট্রাস্ট ও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনকেও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বিরদ্ধে প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় এই দুই সংগঠনের বিরুদ্ধে সরকার ও সেনাবাহিনীর এই দূরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা হালে পানি পায়নি।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সারাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। এই অনুকূল সময়ে বিশেষতঃ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সর্বত্র থানা ও গ্রাম পর্যায়ে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। সেনাবাহিনী নেতৃত্ত্বহীন, বেসামাল ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। জনজীবনের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে শিথিল হয়ে পড়ে। অবর্ণনীয় নিপীড়ন নির্যাতনের জগদ্দল পাথরভারে ন্যুজ জুম্ম জনতা আবার মেরুদন্ড খাড়া করে দাঁড়িযে ওঠে। হতাশা-নিরাশার ঘোর কেটে যায়। দু’ চোখে আবার ভেসে ওঠে এক স্বপ্ন-স্বাধিকার, মুক্তি।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের এই দ্রুত বিস্তার ঠেকাতে সেনাবাহিনী এই সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের ওপর চড়াও হয়। দমনপীড়ন শুরু করে। একের পর এক নেতা কর্মীকে আটক করে। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট সকল আটকাদেশই অবৈধ ও আইন বহির্ভুত বলে রায় দেয়। সরকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে যায়। সরকার ও সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র আরো বেশী নগ্ন ও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। ১০ এপ্রিল’৯২ লোমহর্ষক লোগং গণহত্যা, ২০ মে’৯২ রাঙ্গামাটিতে দাঙ্গা, ১৩ অক্টোবর ’৯২ সমাবেশে সেনাবাহিনীর হামলা ও ভরদাস মুনির মৃত্যু, ১০ ফেব্রুয়ারী ’৯৩ খাগড়াছড়িতে পুলশের বর্বরতা, ১৭ নভেম্বর ’৯৩ নানিয়ারচড় গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য পাহাড়ী গণ পরিষদ ও ছাত্র পরিষদের দৃর্বার অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়া। কিন্তু যে সংগঠন জনগণের সমর্থনে ও সাহায্য সহযোগিতায় বেঁচে থাকে, তাকে ধ্বংস করা যায় না। সরকারও শত দমন পীড়ন চালিয়ে প্রতিবাদী এই দুই সংগঠনকে কিছুই করতে পারেনি।
হতাশ হয়ে সরকার ও সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত ভেসে যাওয়া লোকের মতো খড়খুটো ধরে শেষ রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মন্ত্রী জনসংহতি সমিতি ও সরকারের আলোচনার সময় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে বলেছিলেন “ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও গণ পরিষদকে দেখিয়ে ছাড়বো।”
অতঃপর চট্টগ্রাম ডিভিশনের জিওসি খাগড়াছড়ি এসে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল আশফাক আহমেদ সহ সেনাবাহিনীর স্থানীয় চেলাচামুন্ডাদের সাথে গোপন অভিসারে মিলিত হন। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার জন্য তথাকথিত P.P.S.P.C গঠনের নীল নকসা এসব গোপন মিটিঙে প্রণীত হয়। ফলে গত বছর ২৬শে সেপ্টেম্বর এক হাস্যকর মিছিল তামাশা মধ্যে দিয়ে সেনা সর্দারদের মিলনের ফসল P.P.S.P.C জন্মলাভ করে। এই হচ্ছে সন্ত্রাসী মুখোশদের সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ও রহস্য।
পি.পি.এস.পি.সি-এর উদ্দেশ্য : সেনা সৃষ্ট তথাকথিত পিপিএসপিসি সন্ত্রাসী গুন্ডাবাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ হচ্ছে, তাদের ভাষায়, পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ‘সন্ত্রাস’ প্রতিরোধ রোধ করা।
পি.পি.এস.পি.সি-র মাধ্যমে সরকার আসলে কি চায়?
পার্বত্য চট্টগাম বিষয়ে ওয়াকিবহাল সবাই জানেন যে, মুখোশধারী সন্ত্রাসী গুন্ডারা সেনা ষড়যন্ত্রেরই ফসল। আগেই বলা হয়েছে যে, নতুন পরিস্থিতিতে পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে পি.পি.এস.পি.সি নামক মুখোশধারীদের জন্ম দেয়া হয়। এরশাদশাহীর পতনের পর এই নতুন পরিস্থিতি উদ্ভব ঘটে, যার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী আগে কখনো পরিচিত ছিল না। যাই হোক সরকার ও সেনাবাহিনী তথাকথিত পি.পি.এস.পি.সির মাধ্যমে নিুলিখিত লক্ষ্য সমূহ অর্জন করতে চায় ঃ
(ক) মুখোশধারীদেরকে পিজিপি, পিসিপি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে তিন সংগঠনকে ঘায়েল করা। তিন সংগঠনকে সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া।
(খ) জুম্ম সমাজের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং Potential যুব সমাজকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করা যাতে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।
(গ) পার্বত্য চট্টগ্রামে নৈরাজ্য, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা এবং এইভাবে সৃষ্টি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা।
(ঘ) দেশে ও বিদেশে জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, সংস্কৃতি কর্মী, মানবাধিকার কর্মী তথা গণতন্ত্রপ্রেমিক জনগণের মধ্যে তিন সংগঠন সম্পর্কে মিথ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।
(ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ বিরতির সময়ও সেনা সন্ত্রাস জার রাখা, যাতে সাধারণ জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তিন সংগঠনকে সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থনদান করতে নিরুৎসাহিত বোধ করা।
মুখোশধারীদের Backgroud : কাটা দিয়ে কাটা তোলার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে জুম্ম সমাজের পচে যাওয়া, অধঃপতিত সমাজ বিরোধী কতিপয় দুশ্চরিত্র ও লম্পটদের দিয়ে এই মুখেশবাহিনী গঠন করা হয়েছে। কথায় বলে “রতনে রতন চিনে—-।” পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী বাঙালী সব লম্পটরাই এখন ঐক্যজোট গঠন করেছে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে। মুখোশধারীদের অনেকের বিরুদ্ধে ৪/৫টি ফৌজধারী মামলা রয়েছে এবং অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানাও জারী আছে। মুখোশধারীগুন্ডারা চাঁদাবাজী, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে গত বছর ফেব্র“য়ারীতে গণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয় এই সব অপরাধ সংঘটনের দায়ে। এই গণ আদালতের রায়ে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ী বাঙালী নির্বিশেষে সন্তোষ প্রকাশ করে। জাতীয় দৈনিক গুলোতেও কার্টুনসহ এই গণ আদালতের খবর গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়। অথচ এইসব মাস্তান অপরাধী চক্রটিই আজ সেনাবাহিনীর প্রধান মিত্র। একজন Criminal আর একজন Criminal এরই বন্ধু হতে পারে। সেনাবাহিনী মহা অপরাধী, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবতার বিরুদ্ধে তারা অপরাধ সংঘটন করছে। সংক্ষেপে, এইসব মুখোশধারীরা সকল ধরনের পাপাচার্য্যে আসক্ত।
পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে না : গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী থাকা সত্ত্বেও এবং অপরাধ সংঘটনের সময় হাতেনাতে ধরা পড়লেও পুলিশ এইসব মুখোশধারীদের গ্রেফতার করতে পারে না। বরং পুলিশকে এইসব সন্ত্রাসীদের স্বতঃস্ফুর্ত গণরোষ থেকে রক্ষা করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, গত ৪ নভেম্বর ’৯৫ সন্ত্রাসী মুখোশধারীরা মাইক্রোবাস যোগে স্বশস্ত্রভাবে পানছড়িতে যায় এবং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও পাহাড়ী গণ পরিষদের নেতা কর্মীদের ওপর হামলা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে এলাকার জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে আসেন এবং মুখোশধারী গুন্ডাদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেন। ব্যাপক গণ প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসীরা পানছড়ি থানায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পুলিশ তাদের কাছ থেকে তিনটি পিস্তল ও কিছু রামদা উদ্ধার করে। কিন্তু এইসব সন্ত্রাসী মুখোশধারীদের গ্রেফতার করাতো দূরের কথা, খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার ও এসপি সাহেবের কড়া নির্দেশে পুলিশ তাদের রাত্রে অতিথির মতো আপ্যায়ন করার পর ভোর সকালে কড়া প্রহরায় খাগড়াছড়ি ব্রিগেড অফিসে পৌঁছে দিতে বাধ্য হয়। তাছাড়া মাস দু’এক আগে মুখোশধারীরা গভীর রাতে পানখাইয়া পাড়ায় উৎপাত শুরু করলে গ্রামবাসীররা তাদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পুলিশ সন্ত্রাসীদের রক্ষা করে এবং জনতার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে। কি বিচিত্র এই দেশ! অথচ এই পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর চেলাররা নিজেদের স্বার্থে আইনের দোহাই দিতে ক্ষান্ত হন না।
মুখোশধারীদের প্রহসনমূলক মিছিল : এইসব সন্ত্রাসী মুখোশধারীদের দিয়ে প্রতারণামূলক ও হাস্যকর মিছিল আয়োজন করতে সেনাবাহিনী দেদার টাকা খরচ করে। এ যেন মিছিল নয়, এক মহা তামাশা। বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন ও আশ্বাস দিয়ে গরীব নিরীহ লোকজন জড়ো করা হয় এবং পরে তাদের হাতে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দিয়ে পুলিশ ও সাদা পোশাকধারী সেনা মাস্তানদের কড়া প্রহরায় মিছিলে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এইসব নিরীহ লোকজনকে কখনো আর্থিক সহায়তা প্রদানের নামে, কখনো “গ্যাস কোম্পানীতে” চাকরী দেয়ার নামে আবার কখনো আওয়ামী লীগ এর মিছিলে যোগদানের নামে নিয়ে আসা হয়। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও পাহাড়ী গণ পরিষদের নামও ভাঙানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পি.পি.এস.পি.সি মুখোশধারীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত চিত্র : জন্মের পর থেকে সেনাবাহিনীর ঔরসজাত পিপিএসপিসি মুখোশধারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষতঃ খাগড়াছড়িতে এক সন্ত্রাসের রাজত্ত্ব কায়েম করে। তারা সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সুপরিকল্পিতভাবে রাতের আঁধারে পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়। তাদের আক্রমণের থাবা থেকে নিরীহ স্কুল শিক্ষক, সংবাদ কর্মী ও ব্যবসায়ীরাও বাদ যাননি। মুখোশধারী গুন্ডারা সেনা বাহিনীর নির্দেশে বেশ কয়েকজন পাহাড়ী গণ পরিষদ ও ছাত্র পরিষদের নেতা কর্মীকে অপহরণ করে, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রীদের লাঞ্ছিত করে ও তাদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের রিং মাষ্টার মেজর মাহবুবের নির্দেশে খাগড়াছড়ি শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে তারা চিঠি দিয়ে বড় অংকের চাঁদা দাবী করে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না দিয়ে “জানে শেষ” করার হুমকি দেয়। কারণ তাদের সাথে মেজর মাহবুব আছে।
জেলা প্রশাসকও জড়িত : খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইসমাইলও সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসী খেলার সাথে জড়িত। গত ৪ঠা অক্টোবর ডিসি সাহেব সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মদদদানের জন্য মুখোশধারীদের সর্দার অলক চাকমাকে একটি গোপন চিঠি দেন, যার স্মারক নং হচ্ছে-১১/৯৫-৩২২। জেলা প্রশাসকের এই কান্ড দেখে খাগড়াছড়ি এলাকার জনগণ তাজ্জব বনে যান। সেনা বাহিনী আর গুন্ডা মাস্তানেরা না হয় মাস্তানী সন্ত্রাসীতে একাকার হয়ে গেছেন। কিন্তু সাধারণ জেলা প্রশাসনের এতে জড়ানোর মানে কি? ছিঃ ছিঃ ডিসি সাহেব!
মুখোশধারীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা : খুব সম্ভবতঃ সেনা পরিকল্পনাকারীদের আশা ছিল যে, মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিলে পাহাড়ী গণ পরিষদ ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তাদের ওপর তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং এইভাবে একটি আত্মঘাতি সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। আর এই সুযোগে সেনাবাহিনী অশুভ ফায়দা লুটতে সক্ষম হবে। কিন্তু বোকার স্বর্গে বসবাসকারী এইসব সেনা অফিসারদের হতবাক করে পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন সন্তাসী P.P.S.P.C এর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে।
মুখোশধারীদের আত্মসমর্পণ ও গোপন তথ্য ফাঁস : সাধারণ ক্ষমার সুযোগ গ্রহণ করে অনেক মুখোশধারী সদস্য তিন সংগঠনের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এদের মধ্যে অলয় চাকমা, দেবাশীষ চামা, উপেন ত্রিপুরা, বোধিমিত্র চাকমা, অনিদত্ত চাকমা সেনাবাহিনীর অত্যন্ত প্রিয় ও বিশ্বাসভাজন ছিল। এদের একের পর এক আত্মসমর্পণের ফলে সেনাকর্তারা শংকিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে যে কয়জন মুখোশধারী সেনাদের হাতে রয়েছে সেনাবাহিনী তাদেরকে Confinement -এ রেখেছে বলে জানা গেছে।
আত্মসমর্পণকারী মুখোশধারীরা সেনাবাহিনীর অনেক গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছে। পাহাড়ী গণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রসিত বিকাশ সহ পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উচ্চপদস্থ নেতৃবৃন্দকে হত্যার পরিকল্পনা সেনাবাহিনী নিয়েছে বলে আত্মসমর্পণকারী একাধিক মুখোশ জানিয়েছে।
এমনকি তাদের মধ্যে কেহ কেহ প্রসিত বিকাশ খীসাকে খুন করতে অস্বীকার করায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং পরে পালিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করেছে। সেনাবাহিনীর হিট লিষ্টের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে প্রসিত খীসা, বিম্বিসার খীসা, বিপ্লব ত্রিপুরা ও ক্যজরী মারমা রয়েছেন বলে আত্মসমর্পণকারীরা স্বীকার করেছে। সেনাবাহিনীর এ ধ্বংসাত্মক ও ঘৃণ্য পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ তাদের নেতাদের রক্ষার জন্য চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। তারা তাদের নেতাদের রক্ষার জন্য সবকিছু ত্যাগ স্বীকার করবে বলে জানিয়েছে।
আত্মসমর্পণকারীরা আরো জানিয়েছে যে, তাদেরকে প্রতিদিন মাদক জাতীয় দ্রব্য এমনিক চট্টগ্রাম থেকে ভাড়া করা গণিকাবালাও সরবরাহ করা হয। মেজর মাহবুবই এইসব ব্যঅপারাদি দেখাশোনা করেন।
সন্ত্রাসীদের আস্তানা : মুখোশধালী সন্ত্রাসীদের প্রথমে শালবনের একটি প্রাইমারী স্কুলঘরে রাখা হয়। পরে সেনাবাহিনীর নির্দেশে ও সহযোড়ীতায় মুখোশধারীরা খাগড়াছড়ি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের হোষ্টেলটি জোরপূর্বক বেদখল করে নেয়। সেখানে অবস্থানরত শিক্ষকদের তারা ভীতি প্রদর্শন করে তাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে একের পর এক আত্মসমর্পনের প্রেক্ষিতে তাদেরকে এই হোষ্টেল থেকে সরিয়ে নিয়ে সেনা নিবাসে রাখা হয়েছে।
গণপ্রতিরোধ ও এ্যাকশান : খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ী ও বাঙালী জনগণের সর্বস্তরের মধ্য থেকে বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও জেলা প্রশাসক এইসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থাই আজ পর্যন্ত নিতে পারেনি। গত ১৪ ডিসেম্বর ’৯৫ খাগড়াছড়ি জেলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এলাকার জনগণের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই স্মারকলিপিতে তারা পিপিএসপিসি সন্ত্রাসীদের কয়েকটি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বর্ণনা করেন। এমন কি সন্ত্রাসীরা ডি.সি সাহেবের বাস ভবন আক্রমণ ও ভাঙচুর করলে মহামান্য ডিসি কিছুই করতে পারেনি। “Arrest them, arrest them” বলে চিৎকার করলেও পুলিশ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে পারেনি। মুখোশধারী গুন্ডাদের একের পর এক সন্ত্রাসী তান্ডব ও অসহনীয় উৎপাতে অতীষ্ট হয়ে এবং জেলা প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় খাগড়াছড়ি এলাকার জনগণ এই মুখোশধারী সন্ত্রাসী গুন্ডাদের প্রতিরোধ করতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে আসেন। পানছড়ি ও দিঘীনালায়ও এরা প্রবল গণপ্রতিরোধের মুখোমুখি হয়।
মুখোশধারীদের বিরদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও মদদদান বন্ধ করার দাবীতে খাগড়াছড়িতে গত ৯ জানুয়ারী হাজার হাজার লোকের সমাবেশ ও মিছিল বের হয়। ৮ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন। তার আগের দিন গভীর রাতে মুখোশধারীরা সেনাবাহিনীর আলখেল্লা পরে স্বশস্ত্রভাবে পাহাড়ী গণ পরিষদ নেতা বিম্বিসার খীসার বাড়ীতে হানা দেয়। সেনা সদস্যরাও তাদের সাথে ছিল। এখবর দ্রত ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাহসী জুম্ম জনতা স্বনির্ভর এলাকায় জড়ো হয় এবং মুখোশধারী গুন্ডাদের প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে। এ সময় সেনাবাহিনী জতার উদ্দেশ্যে নির্বিচারে গুলি চালায় এবং অমর বিকাশ চাকমা নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে।
শুধু প্রতিরোধ নয়, মুখোশধারীদের ওপর ব্যাপক Action শুরু হয়েছে। খাগড়াছড়ির প্রতিবাদী অসম সাহসী যুব সমাজ গত ৬ ও ৮ ফেব্র“য়ারী মুখোশধারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক সফল অভিযান পরিচালনা করে। তারা দুই সন্ত্রাসীকে বাজার এলাকা থেকে ধরে নিয়ে আসে এবং এক বস্তা হকিস্টিক, চাইনিজ কুড়াল ও রামদা উদ্ধার করে। এর আগে দিঘীনালার মেরুং এলাকায়ও এক সন্ত্রাসীকে জনতা ধরে ফেলে এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
সেনাকর্তাদের লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত
সন্ত্রাসী ও অরাজকতা সৃষ্টি ছাড়া সেনা বাহিনী মুখোশধারীদের মাধ্যমে তাদের ইস্পিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। বরং সেনাবাহিনীর এই কৌশল সাধারণ জনগণকে অধিকতর সক্রিয়ভঅবে স্বাধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামে জড়িয়ে ফেলেছে। জনগণ এখন নিজেরাই তাদের শত্র“দের মোকাবিলা করছেন। জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনের জন্য চিহ্নিত সন্ত্রাসী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ব্যবহার করার কৌশল নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন দেশে insurgency দমনের নামে প্রতি বিপ্লবী কৌশল হিসাবে এই কৌশল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও এর আগে তথাকথিত টাইগার বাহিনী, লায়ন বাহিনী, গ.প্র.ক বা গুগ্রক বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের মুখে সেগুলোর কোন অস্তিত্ব আজ নেই। বর্তমান পিপিএসপিসি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরও যে একই পরিণতি ঘটবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
উপসংহার : যুদ্ধ বিরতির জন্য সেনাবাহিনী পূর্বেকার মতো বর্তমানে সরাসরি মাঠে নামতে পারছে না। তাই তারা এখন পর্দার আড়ালে থেকে ধ্বংসাত্মক ও ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে। নতুন পরিস্থিতিতেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জারী রাখার এটি একটি তথাকথিত -এর কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তাদের এই কৌশল অচিরেই মুখ থুবরে পড়তে বাধ্য। কারণ দিকে দিকে এইসব মুখোশধারী সন্ত্রাসী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে প্রবল গণপ্রতিরোধ শুরু হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা আরো জোরদার হবে। সংগঠিত জনগণের প্রতিরোধের মুখে সব ধরনের কৌশলই পরাস্ত হতে বাধ্য। জনগণই শক্তির উৎস।#
সূত্র: স্বাধিকার বুলেটিন নং ২, প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ‘৯৬