প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লিফলেট

পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াই জোরদার করার আহ্বান পিসিপি’র

0

নিজস্ব প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ ।। “শাসকচক্রের নীলনক্সা ভেস্তে দিতে ছাত্র-জনতা এক হোন, দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল ও লেজুড়দের মুখোশ উন্মোচন করে দিন, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াই জোরদার করুন” এই আহ্বানের শিরোনামে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ ২০ মে ২০২২ একটি লিফলেট প্রকাশ ও প্রচার করেছে।

উক্ত লিফলেটে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সরকার ও শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে জাতিসত্তা শাসন ও শোষণের কারাগারে রূপান্তরিত করেছে অভিযোগ করে বলা হয়, ‘অপারেশন উত্তরণ’ এর নামে জারি রেখেছে এক অঘোষিত সেনাশাসন। শাসকগোষ্ঠী উন্নয়নের নামে বিভিন্ন মুনাফালোভী কর্পোরেট কোম্পানিকে অবৈধভাবে পাহাড়িদের জায়গা-জমি লীজ দিয়ে ভূমি বেদখল এবং সেটেলার পূনর্বাসন অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া পাহাড়ে প্রতিনিয়ত শিশু ও নারী ধর্ষণ, রাতের আঁধারে পাহাড়িদের বাড়িঘরে তল্লাশি, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের মিথ্যা মামলায় জেলে প্রেরণ, কারাফটক থেকে পুনঃগ্রেফতার, বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, সেনা মদদপুষ্ট ভাড়াটে চিহ্নিত সন্ত্রাসিদের দিয়ে অপহরন-খুন-গুম নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ সীমাহীন ভয় ও আতঙ্কে দিন যাপন করছে।

সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখলের মাত্রা অতীতের চেয়ে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে অভিযোগ করে লিফলেটে আরো বলা হয়, এসবের মধ্যে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়িতে পক্ষীমুড়ায় সনে রঞ্জন ত্রিপুরার নির্মিত ঘর রাতের আধাঁরে ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকের নামে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের নেতৃত্বে জোরপূর্বক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া, পানছড়ির ঝর্ণাটিলায় পাহাড়িদের ফলজ বাগান কেটে দিয়ে সেটেলার পুনর্বাসনের পাঁয়তারা, বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে স্থানীয় ম্রোদের উচ্ছেদ করে সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক পাঁচ তারকা হোটেল নির্মানের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জায়গার উপর বান্দরবান জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে অবৈধভাবে জমি লীজ নিয়ে লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ কোম্পানি ভূমি বেদখলের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করার জন্য তাদের জুম ও বিভিন্ন ফলজ বাগানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তাদেরকে অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে কোনো প্রকার প্রতিরোধ আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত না হয়, সে লক্ষ্যে পরিকল্পনা মাফিক শাসকগোষ্ঠীর পদলেহনকারী দোসর বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে। পাহাড়িদের প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল করে সরকার তার নীলনক্সা বাস্তবায়ন করছে। এমতাবস্থায় জনগণের পক্ষের সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবী।

লিফলেটে জাতিসত্তাদের ধ্বংস করতে শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তের শেষ নেই অভিযোগ করে আরো বলা হয়, ২০১১ সালে ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতিসত্তাদের উপর উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গণবিরোধী ‘১১ দফা’ নির্দেশনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত জাতিসত্তার কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের সরকারি মাধ্যমিক-১ শাখা হতে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাত্যহিক সমাবেশকালে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর শপথবাক্য পাঠ সংক্রান্ত’ সার্কুলারে নির্দেশনা মূলত আওয়ামী লীগের আত্মপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ‘শেখ মুজিবর রহমান’কে প্রতিষ্ঠা করতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই শপথনামার মধ্য দিয়ে এদেশের ৪৫টির অধিক ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তাদের উপর সরকার উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধরা প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াস এবং দেশের ভিন্ন ভাষা-ভাষী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহকে অস্বীকার ও উপেক্ষা করা হয়েছে।

সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার বলা হলেও বর্তমান লুটেরা সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বর্ধিত আবেদন ফি বাড়িয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর আর্থিক শোষণ চালিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান শিক্ষা নীতি হচ্ছে টাকা যার শিক্ষা তার। পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা পরিষদসমূহের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে অদক্ষ শিক্ষকদের। যার ফলে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থা দিন দিন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

লিফলেটে ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়:

১. লেজুড়বৃত্তি-সুবিধাবাদী পথ পরিহার করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রাম জোরদার করুন।
২. জাতির ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে বেগবান করতে পিসিপি’র পতাকা তলে সমবেত হোন।
৩. নব্বই এর ছাত্র গণজাগরণের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বেগবান করুন।
৪. লেজুড়, দালাল, ধান্দাবাজ ও গোয়েন্দা সংস্থার ভাড়া-খাটা ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তদের মুখোশ উন্মোচন করে দিন ও প্রতিহত করুন।
৫. নারী নিপীড়ন, ভূমি বেদখল, পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা ও সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সরব হোন।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, জনমত গড়ে তুলুন।
৭. ১ম ও ২য় শ্রেণীর সরকারি চাকুরিতে কোটা পুনর্বহাল ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়িদের জন্য সংরক্ষিত কোটা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হোন, সংগ্রাম গড়ে তুলুন।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উক্ত লিফলেটে সরকারের প্রতি প্রতি আহ্বান জানিয়ে লিফলেটে বলা হয়:

১. সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাও।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন মেনে নাও।
৩. পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দাও, অবিলম্বে বান্দরবানে লামায় ¤্রাে ও ত্রিপুরাদের ভূমি ফিরিয়ে দাও।
৪. রাতের আঁধারে ঘরবাড়ি তল্লাশি ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ কর।
৫. ১ম ও ২য় শ্রেণী সরকারি চাকুরিতে পাহাড়িদের জন্য নির্ধারিত কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল কর। পিসিপি’র শিক্ষা সংক্রান্ত ৫দফা মেনে নাও।
৬. পিসিপি নেতা কুনেন্টু ও রুপায়ন চাকমাসহ সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দাও। কারাফটক থেকে পুনঃগ্রেফতার বন্ধ কর।
৭. পাহাড় থেকে সেনাশাসন তুলে নাও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত কর।
৮. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বর্ধিত আবেদন ফি বাতিল কর।
৯. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারী নিপীড়ন বন্ধ কর।
১০. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কমাও।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More