বন্দুকভাঙার মারিচুকে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের ষড়যন্ত্র বন্ধের দাবিতে প্রচারপত্র

0

রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙা ইউনিয়নের মারিচুক মোনে (পাহাড়ে) সেনা ক্যাম্প স্থাপনের ষড়যন্ত্র বন্ধের দাবিতে এবং পবিত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে।

গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ বন্দুকভাঙ্গা ভূমি রক্ষা কমিটি, লংগদু ভূমি রক্ষা কমিটি ও বন্দুকভাঙা-যমচুক-মারিচুক দায়িকদায়িকা পরিষদ-এর উদ্যোগে এ প্রচারপত্র্রটি প্রকাশ করা হয়।

প্রচারপত্রটিতে বলা হয়, আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন যে, রাঙ্গামাটি জেলার বন্দুকভাঙা ইউনিয়নের মারিচুক মোনে (পাহাড়ে) পাহাড়ি গ্রামবাসী ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জমি বেদখল করে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প নির্মাণের গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।

গত ১ জানুয়ারী ২০২৫ তারিখ থেকে এই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এদিন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাচ্যাপাড়া, কুরামারা, ওগোইছড়া, ডেবাছড়া, তংতুল্যা, পানছড়ি মোন আদাম, পানছড়ি, রূপবান, তিবিরাছড়া, ভাঙামুরা ও বড়কলকসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক অপারেশন চালায়। ২ জানুয়ারী তারা কিজিংছড়া গ্রামের রাস্তা থেকে এক যুবককে ধরে মারপিট করতে করতে নিয়ে যায়। আইএসপিআর তাকে ইউপিডিএফ সদস্য বলে প্রচার করে জানায় যে, সে সেনাদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো তাকে জীবন্ত ধরা হয়েছিল। স্থানীয় গ্রামের জনগণ তার সাক্ষী। তাকে ধরে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে নিহত ওই যুবকের নাম চাইংপা মার্মা, বয়স ৩৯, বাড়ি মানিকছড়ি। তিনি তার এক বন্ধুর সাথে লংগদু বেড়াতে এসেছিলেন।

তাকে হত্যার পর ৩ জানুয়ারি হারিক্ষ্যং আর্মি ক্যাম্প থেকে একদল সেনা সদস্য মারিচুক মোনে যায় এবং শান্তি কুমার চাকমার দুই ছেলে কিরণজ্যোতি চাকমা ( রাইচ্যা) বয়স-৪৫ ও  দেবজ্যোতি চাকমার (৪০) পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করে বাড়ি দুটি দখলে নিয়ে সেখানে অবস্থান করে। এ সময় কিরণজ্যোতি চাকমা তার শ্বশুড় বাড়িতে ধান রোপনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেনা সদস্যরা উক্ত দুই পরিবারের সদস্যদেরকে শান্তি কুমার চাকমার বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখে। বর্তমানে দেবজ্যোতি চাকমার পরিবারকে তাদের বাড়িটি ফিরিয়ে দেয়া হলেও, সেনারা এখনও কিরণজ্যোতি চাকমার বাড়িতে অবস্থান করছে। ফলে তিনি ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।

ক্যাম্প স্থাপনের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে প্রচারপত্রে বলা হয়, সেনারা যেখানে অবস্থান করছে সেখানে অর্থাৎ মারিচুকে একটি সেনা ক্যাম্প স্থাপনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। ক্যাম্প স্থাপন করা হলে তিন ব্যক্তির জমি বেদখল হবে। তারা হলেন শান্তি কুমার চাকমা বয়স ৮০ (কিরণজ্যোতি ও দেবজ্যোতি চাকমার পিতা), লক্ষী কুমার চাকমা, বয়স ৭৫, ও শান্তি রঞ্জন চাকমা, বয়স ৫৫। তারা হলেন তিন সহোদর ভাই, তাদের নামে সেখানে প্রত্যেকের ৫ একর করে ১৫ একর জমি রয়েছে। তাদের পিতা মানিকচন্দ্র চাকমা কাপ্তাই বাঁধের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে হারিক্ষ্যং-এর চেঙ্গীপাড় থেকে মারিচুক পাহাড়ে এসে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই জমিতে তাদের সৃজিত বিভিন্ন ফলজ, বনজ, ঔষধী গাছ ও সেগুন বাগান রয়েছে। এই জমি দখল করে ক্যাম্প করা হলে তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না ও জীবন ধারণের উপায় থাকবে না। তারা তাদের জমি ও সম্পত্তির ভোগদখল থেকে বঞ্চিত হবেন।
এছাড়া উক্ত জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করা হলে অন্য গ্রামবাসীদেরও অনেক সমস্যা দেখা দেবে। যেমন, ১) ওই জমির আশেপাশে আরও যাদের জমি রয়েছে, তারাও আর তাদের জমিতে যেতে পারবে না। ২) গ্রামের মেয়েরা জঙ্গলে গিয়ে বন্য তরকারী, ফলমূল, লাকড়ি, দৈনন্দিন নিত্য ব্যবহারের জন্য গাছ-বাঁশ, বেইন বা কোমর তাঁতের জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে পারবে না। ৩) ক্যাম্পের জন্য পাহাড়, বন ও গাছপালা কাটা হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৪) এলাকায় চরম পানি সংকট দেখা দেবে। এমনিতেই সেখানে প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে ভয়াবহ পানির সংকট দেখা দেয়। ৫) এলাকাবাসীর বিহারে যেতে সমস্যা হবে। কারণ ক্যাম্প করা হলে বিহারে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তারা ঠিকমত ধর্মচর্চা করতে পারবে না।

এ সব কারণে আমরা এলাকাবাসী চাই না, মারিচুকে বা আশেপাশে কোথাও সেনা বা নিরাপত্তা বাহিনীর কোন ক্যাম্প স্থাপন করা হোক। এখানে এ ধরনের ক্যাম্পের কোন প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনীর কাজ যদি জনগণের স্বার্থে হয়, তাহলে আমরা বলছি এলাকাবাসী তথা জনগণের স্বার্থে মারিচুকে সেনাবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করা থেকে বিরত থাকুক। কারণ জনগণকে উচ্ছেদ করে তাদের অসুবিধা সৃষ্টি করে ক্যাম্প স্থাপন করা হলে তা তাদের স্বার্থে কীভাবে হবে? ক্যাম্প স্থাপনের পেছনে সেনাবাহিনীর যুক্তি যদি এই হয় যে, সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করার জন্য উক্ত ক্যাম্প স্থাপন করা প্রয়োজন, তাহলে আমরা তা বিশ্বাস করি না। কারণ তারা তাদের নাকে ডগায়, তাদের ক্যাম্পের পাশে সন্ত্রাসীরা বন্দুক নিয়ে দিনে দুপুরে ঘোরাফিরা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি করলেও তারা তাদের ধরে না। এমনকি তারা সন্ত্রাসীদেরকে মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয় বলে এন্তার অভিযোগ রয়েছে এবং আমরা তা প্রতিদিন স্বচক্ষে দেখে চলেছি।

গণ হয়রানি, কুটিরের সম্পত্তির ধ্বংস সাধনের চিত্র তুলে ধরে প্রচারপত্রে বলা হয়, সেনা অপারেশনে জনগণকে হয়রানি ও কুটিরের (বৌদ্ধ বিহার) সম্পত্তির ক্ষতি করা হয়েছে। ৪ জানুয়ারী সেনাবাহিনী নানিয়াচর উপজেলার সদর ইউনিয়নের খুল্যাং পাড়া, বুড়িঘাট ইউনিয়নের ভাঙামুরো ও রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের তিবিরাছড়া (ত্রিপুরাছড়া) এলাকায় অপারেশন চালিয়ে ৭ গ্রামবাসীকে আটক করে নানিয়াচর জোনে নিয়ে যায়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি শেষে পরদিন বিকেল ৪টায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। 
এছাড়া অপারেশনের সময় সেনারা একটি হ্যালিপ্যাড নির্মাণের জন্য যমচুগ বনাশ্রম ভাবনা কেন্দ্রের ১৫০টি সুপারি গাছ জোরপূর্বক কেটে দেয়, বিনা পারিশ্রমিকে তাদের মালামাল বহনে লোকজনকে বাধ্য করে। এতে গ্রামবাসীরা প্রচুর হয়রানির শিকার হয় এবং তাদের নিজেদের জরুরী কাজ ফেলে রাখতে হয়। সেনারা গ্রামবাসীদের গতিবিধিও নিয়ন্ত্রণ করে, মারিচুক ও যমচুক থেকে কাউকে বাইরে যেতে দেয়নি এবং বাইরে থেকেও কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয়নি। ফলে গ্রামের লোকজন বিবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়। অনেকের জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও ডাক্তারের কাছে যেতে পারেনি।

কুটিরের নামে মিথ্যা প্রচারের বিষয়ে এতে বলা হয়, সেনারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাগলি ছড়া গ্রামের সন্নিকটে অবস্থিত ধূতাঙ্গ মোন অরণ্য কুটির নামে একটি বৌদ্ধ বিহার সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার চালায়। জানা যায়, গত ২ জানুয়ারী সকালে লংগদু জোন কমান্ডার লে. কর্নেল হিমেল মিঞা (পিএসসি) গ্রামের এক বাসিন্দাকে নিয়ে কুটিরটি দেখতে যান। এ সময় কুটিরে বসবাসকারী ভিক্ষু শ্রীমৎ পবিত্র ভান্তে রাঙামাটি সদরে অবস্থান করছিলেন। হিমেল সাহেব কুটির, কুটিরের প্রাঙ্গন ও চারপাশ ছবি তুলেন। পরদিন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) কুটিরের প্রাঙ্গনকে ইউপিডিএফের প্রশিক্ষণ মাঠ হিসেবে বর্ণনা করে ছবিসহ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে যা দেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।
সেনাবাহিনীর এই নির্জলা মিথ্যা প্রচার দেখে আমরা অত্যন্ত হতবাক ও উদ্বিগ্ন হয়ে যাই এবং ভান্তেকে এ ব্যাপারে জানিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করি। তিনি আমাদের কথায় সেনা কর্তৃপক্ষকে ফোন করে এভাবে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার সম্পর্কে জানতে চান। কমান্ডার তাকে বলেন যে, এতে কুটিরের কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু তিনি এজন্য ভান্তের কাছে ক্ষমা চাননি, আইএসপিআরও তার ভুল সংশোধন করে বিবৃতি দেয়নি। ফলে মিডিয়ায় উক্ত কুটির সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য থেকে যাবে, যা পড়ে ভবিষ্যতে কারও মনে কুটিরটি সম্পর্কে অহেতুক ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে।
আমরা মনে করি কুটিরটি সম্পর্কে সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে যে মিথ্যা প্রচার করেছে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এ তা আমলযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশে জোর যার মুল্লুক তার। এখানে যার জোর থাকে, শত অপরাধ করলেও তার কোন শাস্তি হয় না। অপরদিকে আমাদের মত যারা নিরীহ সাধারণ নাগরিক, তাদেরকেই বিনা অপরাধে হয়রানি ও নিগ্রহের শিকার হতে হয়। সেনাবাহিনী জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলে, বেতন পায়, অথচ তারা সেই জনগণের ওপর বিনা কারণে অত্যাচার চালায়।

আর সহ্য করা হবে না উল্লেখ করে প্রচারপত্রে বলা হয়, কিন্তু আমরা আর এ ধরনের অন্যায় অনাচার জুলুম মুখ বুজে সহ্য করতে রাজী নই। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে আমাদের ওপর অত্যাচার করা হলেও আমরা এতদিন মুখ ফুটে কিছুই বলিনি। আমরা যত বেশি নিরব রয়েছি, তত বেশি অত্যাচারিত হয়েছি। আমাদের আর ভয় পাওয়া চলবে না, কারণ আমরা কোন অন্যায় করছি না। আমাদের ওপরই অন্যায় করা হচ্ছে। যারা অন্যায়কারী তাদেরই ভয় পাওয়া উচিত। হ্যাঁ, আমরা ভয়ে প্রতিবাদ করছি না বলে, অন্যায়কারীরা আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে সাহস পাচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি সবাই এক হয়ে রব তুলি, প্রতিবাদ করি, তাহলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে অতীতে তাই দেখা গেছে। জনগণের ঐক্যের কাছে জালিম শাসকদের পরাজয়, পতন ঘটেছে।

প্রচারপত্রে ৬ দাবিতে আওয়াজ তোলার আহ্বান জানানো হয়।

১) অবিলম্বে মারিচুক মোনে পাহাড়ি উচ্ছেদ করে সেনা ক্যাম্প নির্মাণের ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

২) মারিচুকে কিরণজ্যোতি চাকমার বাড়িতে অবস্থানরত সেনা সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে হবে।

৩) গ্রামবাসীদেরকে আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া হয়রানি, আটক ও বিনা পারিশ্রমিকে জোরপূর্বক বেগার খাটানো চলবে না।

৪) ধূতাঙ্গ মোন অরণ্য কুটির সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারের জন্য ভান্তে ও কুটির কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে; ও সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংশোধনী দিতে হবে।

৫) সন্ত্রাসী খোঁজার নামে সেনা অপারেশন বন্ধ করতে হবে এবং সেনা ক্যাম্পের পাশে অবস্থানকারী প্রকৃত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে হবে।

৬) যমচুকে হ্যালিপ্যাড নির্মাণ করা চলবে না (সেখানে হ্যালিপ্যাড নির্মাণ করা হলে ভিক্ষুদের ধ্যান-সাধনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে); হ্যালিপ্যাড নির্মাণের জন্য সুপারি গাছ কেটে দেয়ার জন্য কুটির কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More