বাঘাইছড়িতে চার সংগঠনের যৌথ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত

বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ৮ জুন ২০২৫
রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখাসমূহের যৌথ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ রবিবার ( ৮ জুন ২০২৫) অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের ব্যানার শ্লোগান ছিল- “পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ ‘স্বায়ত্তশাসিত’ অঞ্চল ঘোষণা কর; বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানি না, বহু ভাষা ও বহু জাতির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই” এবং আহ্বান ছিল- “স্ব স্ব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভূমি অধিকার ও পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছাত্র-যুব-নারী সমাজ ঐক্যবদ্ধ হোন”।
‘আমরা করবো জয়…’ গানটির মাধ্যমে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। এরপর জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
যৌথ কাউন্সিল অধিবেশনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি বিশাখা চাকমার সভাপতিত্বে ও পিসিপি’র বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি পলেন চাকমা’র সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফের বাঘাইছড়ি উপজেলা সংগঠক অক্ষয় চাকমা, পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সদস্য রিসার্চ চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সদস্য এন্টি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা কমিটি পিংকু চাকমা ও পিসিপি’র রাঙামাটি জেলা শাখা’র অর্থ সম্পাদক ঝিমিত চাকমা। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সহসভাপতি সুখী চাকমা।
ইউপিডিএফ সংগঠক অক্ষয় চাকমা বলেন, আজকের এই যৌথ কাউন্সিল চার সংগনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই কাউন্সিলের মাধ্যমেই নতুন নেতৃত্ব আসবে। আগামীতে বাঘাইছড়ি উপজেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য ছাত্র-যুব-নারী সমাজকে সংগঠিত করতে নতুন কমিটিগুলোকে দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করতে হবে।
পিসিপি নেতা রিসার্চ চাকমা বলেন, ২৪’র গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনো কোন সেনা ক্যাম্প কিংবা সেনাশাসন প্রত্যাহার করা হয়নি।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পাবর্ত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ অধিকারের দাবিতে আন্দোলনে রাজপথে নেমেছিলো। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক অপশক্তির মাধ্যমে তা দমন করা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ওপর এখনো আমাদের আস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণ সংগঠিত হলে সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমাদের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জন সম্ভব হবে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী এন্টি চাকমা বলেন, পাহাড়ের নারীরা আজ নিরাপদ নয়। গত ১ মাসে পাহাড়ে দুটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কোন সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। প্রশাসন থেকে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এতেই প্রমাণ হয় যে, প্রশাসন ধর্ষকদের পাহারাদার। আমাদের নিরাপত্তা আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণে লড়াই সংগ্রামের বিকল্প নেই।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অব্যাহত সেনাশাসন, ভূমি বেদখল, নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্মান্তরকরণ করে অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেয়ার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। কয়েকদিন আগে বান্দরবানে এক খেয়াং নারীকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, মহালছড়িতে বাড়িতে ঢুকে কোলের শিশু সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে ধানক্ষেতে নিয়ে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত চলছে পাহাড়িদের ওপর দমন-পীড়ন।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আজকের এই কাউন্সিল আগামী দিনের লড়াইকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে। ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পাহাড়-সমতলে লড়াই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশে একটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে ঠিকই কিন্তু পাবর্ত্য চট্টগ্রামে জারিকৃত সেনা শাসন এখনো চলমান রয়েছে। অভ্যুত্থানের পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনা-শকুনের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে।
তিনি জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং নারী অধিকার নিশ্চিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল ঘোষনা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
পিসিপি’র রাঙামাটি জেলা শাখার নেতা ঝিমিত চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণকে দমিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন না হওয়ার জন্য একমাত্র দায়ি শোষকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ রাষ্ট্রষন্ত্র। ১৯৬০ সালে যখন কাপ্তাই বাঁধ দেয়া হয় তখন সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা পাহাড়িদেরকে নিজস্ব জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি হারা হয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতে হয়েছে। ভারতে শরণার্থী হতে হয়েছে।
তিনি বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-এর জন্ম হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম করার জন্য। সেই সংগ্রাম করতে গিয়ে আমাদের প্রতিভাবান নেতা মিঠুন, বিপুল, সুনীল সহ অনেক সহযোদ্ধাকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আমরা শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দিতে পারি না।
যুবনেতা পিংকু চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব জাতিসত্তা রয়েছে তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী ও শাসকগোষ্ঠি। যার কারণে ভবিষ্যতে যারা আন্দোলনে নেতৃত্বে দেবে সেই ছাত্র-যুব সমাজকে নানাভাবে দমিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তাই, জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নারী-পুরুষ সকলকে রাজপথে সংগ্রাম করা ছাড়া উপায় নেই।
সুখী চাকমা বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না করলে আমাদের সমাজ এবং নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। এখনই সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার, প্রতিবাদ করার। প্রতিটি নারী সমাজ বিভিন্ন সময়ে জাতির জন্য বহু অবদান রেখেছে। তাই আজকে আমাদের নিরাপত্তা ও নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
সভাপতি বিশাখা চাকমা বলেন, নারীদেরকে নানাভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সে বন্দি শিখল ভেঙে আমাদের যে অধিকার এবং নারীদের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে সংগ্রাম করতে হবে। তিনি নারীদের নিরাপত্তা জোরদার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদে সকল নারীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
কাউন্সিলের ২য় অধিবেশেনে চার সংগঠনের পুরাতন কমিটি বিলুপ্তি ও প্রস্তাবিত নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর সকলের সম্মতিক্রমে হিল উইমেন্স ফেডারেশেনর ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে সুখী চাকমাকে সভাপতি ও পরানি চাকমা সাধারণ সম্পাদক; গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের ২৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে শুক্র চাকমাকে সভাপতি ও টুকু চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে জ্যোতি চাকমাকে সভাপতি ও ইমন চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে অমিতা চাকমাকে সভাপতি ও রবিতা চকামাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে উপস্থিত সকলে করতালির মাধ্যমে নতুন কমিটিগুলোকে স্বাগত জানান।
এরপর সংগঠনগুলোর নেতৃবৃ্ন্দ নতুন কমিটির সদস্যদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
পরে নারী সংঘের নবগঠিত কমিটির সভাপতি অমিতা চাকমা যৌথ কাউন্সিল অধিবেশন সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।