মন্তব্য প্রতিবেদন।।
গতকাল বৃহস্পতিবার দীঘিনালার বাবুছড়ায় কালাচাঁদ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হেডম্যান ও কার্বারী সম্মেলনে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারকে পুনর্বাসনের আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়ে প্রথম আলোর রিপোর্টে বলা হয়, ‘সম্মেলনে সেনা কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, ২১টি পরিবারকে পুনর্বাসনের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তবে ২১টি পরিবারকে নিয়ে কেউ যেন কোনো অপরাজনীতি করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে ২১টি পরিবারের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। সবাইকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সহযোগিতা করলে বিষয়টির সমস্যা সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তারা।’ [প্রথম আলো ৩ মার্চ ২০১৭ সংখ্যা] সম্মেলনে উপস্থিত হেডম্যান, কার্বারী ও জনপ্রতিনিধিরা ২১ পরিবারকে পুনর্বাসনের দাবি জানালে সেনা ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপরোক্ত বক্তব্য দেয়া হয়।
তবে উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারকে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি নতুন নয়। সর্বশেষ গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল দীঘিনালা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শহীদ হোসেন চৌধুরী, বিজিবি প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ ও ক্ষতিগ্রস্ত ২১ পরিবারের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গত এক বছরে উক্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোন কিছু করা হয়নি। খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার কথা মত পুনর্বাসন প্রক্রিয়া তদারকির জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল এবং এই কমিটির কাজ কিছুদূর অগ্রসরও হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ তিনি তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেলে পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের কাজ শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে উচ্ছেদকৃতদের মানবেতর জীবন যাপন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

২০১৪ সালের ১০ জুন উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে ২১ পরিবারের শিশুসহ ৮৭ জন নারী পুরুষ নিজ ভূমে পরবাসীর মতো দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। তার আগে ১৪ মে গভীর রাতে ৫১ বিজিবির সদস্যরা তাদের গ্রাম দীঘিনালা ইউনিয়নের যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ায় অবস্থান নিয়েছিল। পরে ১০ জুন তারা পুলিশ ও সেটলারসহ যৌথভাবে পাড়াবাসীর উপর হামলা চালিয়ে ২১ পরিবারকে উচ্ছেদ করে। এ সময় নারীসহ অনেকে গুরুতর আহত হন। শত শত গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার, নির্যাতন ও কারাভোগের শিকার হতে হয়।
বিজিবির অন্যায় ও বেআইনী উচ্ছেদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করা হলে মহামান্য আদালত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেন। কিন্তু বিজিবি উক্ত আদেশ অমান্য করে বেদখলকৃত জমিতে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে। এটা বিজিবির সুস্পষ্ট আদালত অবমাননা, যা কোন মতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের মধ্যে বেশ কয়েকজন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তাদের শিক্ষাজীবন বর্তমানে বাধাগ্রস্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। উচ্ছেদ ঘটনার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সাথে কথা বলেন, তারা স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবির সাথেও সাক্ষাত করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনও ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে ও উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর সাক্ষাতকার নেয়। অপরদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়া ছাড়া কিছুই করা হয়নি। এমনকি ত্রাণ সাহায্য পর্যন্ত দেয়া হয়নি। ফলে উচ্ছেদ হওয়া অসহায় পরিবারগুলো স্থানীয় জনগণের সীমিত সাহায্য নিয়ে কোনমতে দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
২১ পরিবারের দুঃখ দুর্দশার প্রতি প্রশাসনের ঔদাসিন্য ও নির্লিপ্ত মনোভঙ্গি কেবল পীড়াদায়ক নয়, তা আমাদের একই সাথে ক্ষুদ্ধ করে তোলে। চাকমাদের একটি কথা আছে ‘তুক্যা উল্ল্যানা’, যার আক্ষরিক বাংলা তর্জমা হলো ‘টুপি ওল্টানো’। কেউ কাউকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে এই কথাটি ব্যবহার করা হয়। একই অর্থ প্রকাশের জন্য চাকমারা অন্য একটি বাগধারা ব্যবহার করে থাকে। সেটা হলো ‘মাধার তুক্যা আদুত দেনা’। এর বাংলা অনুবাদ এ রকম: ‘মাথার টুপি হাঁটুতে পরা’। ২১ পরিবারকে পুনর্বাসন বিষয়ে দেয়া প্রতিশ্রুতির বার বার লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রশ্ন: বিজিবি, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন আর কতবার ‘তুক্যা উল্ল্যাবে’? আর কতবার তারা ‘মাথার টুপি নামিয়ে হাঁটুতে পরবে’?
——————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।