বিজিবি সদস্যদের সামনেই সেটলাররা আমাদের মারধর করে- সুকুমনি চাকমা

0
* সুকুমনি চাকমা

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিসিএইচটিনিউজ.কম

[৩ আগস্ট তাইন্দংয়ে পাহাড়িদের গ্রামে মূল হামলার আগে সেটলারদের হাতে প্রথম মারধরের শিকার হন বান্দরশিং গ্রামের সুকুমনি চাকমা সহ ১২ জন পাহাড়ি। যাদের মধ্যে মেম্বার, কার্বারীও রয়েছেন। ৮ আগস্ট ধারণ করা এক সাক্ষাতকারে সুকুমনি চাকমা বলেন, বিজিবি সদস্যদের সামনেই সেটলাররা তাদেরকে মারধর করলেও বিজিবি সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। তারা তাদেরকে হামলা থেকে বাঁচাতে কোন চেষ্টাই করেনি। সুকুমনি চাকমার সাক্ষাতকারটি সম্পাদনা করে এখানে প্রকাশ করা হলো-সম্পাদক]সুকুমনি চাকমা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঘটনার দিন সকালে কামাল হোসেন বগাপাড়া দোকানে আসেন। সেখান থেকে ভগবান টিলায় একজন যাত্রী নিয়ে ফেরার পথে তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে প্রচার হয়। কামাল হোসেন নাকি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামকে ফোন করে একথা জানিয়েছে। এ কথা জানাজানি হলে বিভিন্ন গ্রামের কার্বারী, মেম্বার ও মুরুব্বীরা বান্দরশিং ক্রসিংয়ে যান। তারা বান্দরশিং গ্রামের কার্বারী অমৃত রঞ্জন চাকমাকেও ফোন করেন। এরপর অমৃত রঞ্জন চাকমা আমাদের ১০/১৫ জনকে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসেন। এছাড়া তিনি বান্দরশিং পাড়া ক্যাম্প থেকে কয়েকজন বিজিবি সদস্যকেও সাথে নেন। আমরা বিজিবি সদস্য সহ ক্রসিং এলাকায় গেলাম।

সেখানে গিয়ে অনেক খোঁজাখুজির পরও কামাল হোসেনকে না পেয়ে সেটলাররা বলাবলি করছিলো এখানে যে পাহাড়িরা রয়েছে তাদের উপরই হামলা করতে হবে। এ সময় সেখানে ২০-২৫ জন বিজিবি ও ৩ জন পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বগা পাড়া থেকে মেম্বার, কার্বারী ও বান্দরশিং পাড়ার কার্বারী অমৃত রঞ্জন চাকমা সহ আমরা ১২ জন সেখানে ছিলাম। বিজিবি সদস্যদের সামনেই সেটলাররা আমাদের মারধর করতে শুরু করে। আমরা তখন বাঁচার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিজেকে রক্ষার জন্য আমরা বিজিবি সদস্যদের জড়িয়ে ধরি। সেটলাররা বিজিবি সদস্যদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে এসে আমাদেরকে লাঠিসোটা দিয়ে মারধর করে। সেটলারদের দা’য়ের কোপে আমার হাতের কব্জি কিছুটা কেটে যায়। বিজিবি সদস্যরা এ সময় নীরব দর্শকের মতো চেয়ে থাকে।তিনি বলেন, সেটলাররা আমাকে হত্যা করার জন্য মারধর করতে করতে আলাদা করে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে আমার পরিচিত গিয়াস উদ্দিন নামে এক বাঙালি আমাকে রক্ষা না করলে আমাকে তারা হত্যা করে ফেলতো। তিনি (গিয়াস উদ্দিন) আমাকে ধরে নিতে দেখে হামলাকারী সেটলারদের বলেন তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? তারা চেয়ারম্যান সিরাজের নির্দেশে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে উত্তর দেয় । তখন তিনি সেটলারদের বলেন, তাকে এখন  নিয়ে যাবেন না। পরে যা হবার হবে। তিনি আমাকে আগলিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।

এরপর আরেক দল সেটলার আমাকে জোর করে হোন্ডায় তুলে নিয়ে যাবার সময় গিয়াস উদ্দিনও আমার সাথে হোন্ডায় উঠে বসেন। তানাক্কা পাড়া ক্যাম্পের পাশে এসে পৌছলে তিনি আমাকে হোন্ডা থেকে টেনে নামিয়ে ক্যাম্পে তুলে দিয়ে যান। ক্যাম্পে গিয়ে সাচু নামে একজন সিপাহী ও একজন হাবিলদার আমার হাত থেকে রক্ষক্ষরণ হতে দেখে ঔষধ লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন। তারা আমাকে ক্যাম্পে নিরাপদে থাকতে অভয় দেন। বিকাল সাড়ে ৫টার সময় ক্যাম্প কমান্ডার সুবেদার ক্যাম্পে চলে আসলে হাবিলদার ও সিপাহী তার কাছ থেকে ‘যে পাহাড়ি ছেলেকে আমরা রেখেছি তাকে কি করবো’ বলে জিজ্ঞাসা করেন। সুবেদার তখন তাদের বলেন, এ রোজার দিনে এ বিষয়ে আমাকে বলো না। তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করো। পরে সুবেদার আমাকে একা একা চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। আমি তাকে বলি স্যার আমি এখন আর একা একা যেতে পারবো না। এখন তারা(সেটলাররা) আমাকে পেলে মেরে ফেলবে। এরপর হাবিলদার ও সাচু নামে সিপাহি আমাকে বলেন, কোন অসুবিধা নেই। বগা পাড়ায় আমাদের টহল রয়েছে। আমাদের সাথেই নিয়ে যাবো। হাবিলদার সাহেব তখন আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, বগাপাড়া পর্যন্ত পৌছে দিলে আমি যেতে পারবো কিনা। আমি যেতে পারবো বলে উত্তর দিই। তখন তিনি বলেন, ঠিক আছে, আমরা আগে ইফতার করে নিই। এরপর আমরা আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো। ইফতারের পর তারা আমাকে বগাপাড়ায় পৌছে দেন। তখন রাত প্রায় ১০টা। হাবিলদার আমাকে বলেন, বান্দরশিং ক্যাম্পে আরো ১১ জন পাহাড়ি ছেলে রয়েছেন সেখানে গেলে তাদের নাগাল পাবেন। আমি চিন্তা-ভাবনা করে আর সেদিকে যাইনি। আমি সোজা ভারতের দিকে চলে যাই। রাতের মধ্যে একাই হেঁটে ফেনী নদী পার হয়ে সীমান্তে পৌঁছে সকলকে সেখানে নাগাল পাই। পরদিন বিকাল ৫টার দিকে আমরা গ্রামে ফিরে আসি।

দ্রষ্টব্য: সুকুমনি চাকমার উক্ত সাক্ষাতকারটি যেদিন ধারণ করা হয় সেদিনই তার ২ মাস বয়সী ছেলে আশামনি চাকমাকে অসুস্থ অবস্থায় খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হামলায় পালিয়ে যাবার কারণে খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আশা মনি চাকমা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। চিকিসকদের চেষ্টা সত্ত্বেও আশামনি চাকমাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ১০ আগস্ট সে মারা যায়। 

 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More