।। মানবমিত্র চাকমা ।।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্মা গান্ধী নামে জগদ্বিখ্যাত, তার নেতৃত্বে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। ১৯২০ – ২২ সাল ব্যাপী চলা সেই সময়ে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতির এই আন্দোলন উপনিবেশিক বৃটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। চৌরিচৌরায় পুলিশের উপর জনতার সহিংস হামলার পর গান্ধীজী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। বৃটিশ সরকার পরে তাকে ও কংগ্রেসের অন্য নেতাদের গ্রেফতার করে ও ব্যাপক দমনপীড়ন চালায়। তবে পরবর্তীতে এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে।
দুই পর্বে প্রকাশিত এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের শেষ পর্বে আন্দোলনের পটভূমি, কারণ ও সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি
ভারতের জনগণ বৃটিশ উপনিবেশিক শাসন শোষণে ছিল জর্জরিত। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হলেও তাদের আন্দোলন ছিল সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন ও কিছু মামুলী সভা সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গান্ধীজী বুঝেছিলেন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কার্যকর একটি সংগঠনে পরিণত করতে হলে কংগ্রেসকে ঢেলে সাজাতে হবে। তিনি কংগ্রেসকে বাৎসরিক বক্তব্য দেয়ার প্রতিযোগিতার মঞ্চ হিসেবে না দেখে একটি জনসম্পৃক্ত ধন্য মিলিট্যান্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করতে উদ্যোগী হন। অসহযোগ আন্দোলন এই আবেদন নিবেদনের গণ্ডি থেকে থেকে আন্দোলনকে মুক্ত করে এবং পার্টি নেতৃত্বের সাথে জনগণের মিলন ঘটায়। আন্দোলন শুরুর কিছু দিন পূর্বে অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগে বৃটিশ সৈন্যরা একটি সমাবেশে গুলি চালিয়ে ৩৭০ জনকে হত্যা ও এক হাজার জনকে আহত করে। এই ঘটনা ভারতীয় সমাজকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। গান্ধীজী ‘শয়তান’ বৃটিশ সরকারের সাথে সহযোগীতা করাকে ‘পাপ’ বলে ঘোষণা করেন।
এ ছাড়া বৃটিশ সরকার রাউলাট বিল পাস করে। এই বিলের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা। এটাকে সরকারের ব্যাপক দমন নীতির পূর্বাভাস বলে মনে করা হয়েছিল এবং জনগণের মধ্যে তা তীব্র অসন্তোষের জন্ম দেয়।
অন্যান্য কারণ:
১) বৃটিশ সরকার প্রথম মহাযুদ্ধে ভারতের সম্পদ, অর্থ ও জনবল তার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। আনুমানিক ১০ লক্ষ ২৫ হাজার ভারতীয় যোদ্ধা বিভিন্ন যুদ্ধ ফ্রন্টে নিয়োজিত ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকে নিহত হয়েছিলেন। এছাড়া ভারতীয়রা বৃটিশের যুদ্ধ তহবিলে ৬ কোটি ২১ লক্ষ পাউন্ড জমা দেন। এ কারণে তারা আশা করেছিলেন যুদ্ধ শেষে বৃটিশ সরকার প্রতিদান হিসেবে ভারতকে স্বশাসন দেবে। কিন্তু তাদের আশা নিরাশায় পরিণত হতে বেশী দিন লাগেনি।
২) কংগ্রেসের পুরোনো নেতাদের ( যেমন বাল গঙ্গাধর তিলক, বেসান্ত ইত্যাদি) সরকারের কাছে আবেদন নিবেদনের ফল না হওয়া। তাদের স্বশাসন (হোম রুল) এর আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।
৩) যুদ্ধ ভারতীয়দের জীবনে অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে আসে। পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বিদেশী পণ্যের আমদানি শুরু হয়; অপরদিকে কৃষি পণ্যের দাম বাড়েনি। ফলে কৃষক ও শ্রমিকরা চরম কষ্টে ও অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়।
৪) খেলাফত নেতাদের দাবি মানতে সরকারের অস্বীকৃতি। ফলে তারা অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব মেনে নেয় এবং গান্ধীজীকে এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানায়। কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। গান্ধীজী এক বছরের মধ্যে স্বরাজ অর্জনের ঘোষণা দেন।
আন্দোলনের সাফল্য ব্যর্থতা
লালা লাজপত রায় ও সি আর দাস সহ কংগ্রেসের পুরোনো নেতারা প্রায় সবাই অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছিলেন। অপরদিকে কংগ্রেসের বাইরে তথাকথিত মডারেট বা লিবারেল বা উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু ভারতীয় নেতা এই আন্দোলন থেকে কেবল নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন তা নয়, তারা বৃটিশ সরকারের সাথে একীভূত হয়ে যান এবং সরকারের মন্ত্রী ও অন্যান্য পদে অধিষ্ঠিত হয়ে গণআন্দোলন ও কংগ্রেসকে দমনে সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করেন। এক কথায় তারা নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের দালাল, প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী হয়ে যান। এদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্রীনিবাস শাস্ত্রী। তিনি বৃটিশ সরকারের ইচ্ছায় বিভিন্ন বৃটিশ ডমিনিয়নে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফর করে তার নিজ দেশের জনগণ ও কংগ্রেসের কড়া সমালোচনা করে বক্তব্য দেন।
কিন্তু এসব সত্বেও অসহযোগ আন্দোলন ব্যাপক জনগণকে নাড়া দেয় ও সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এই আন্দোলন জনগণের মনে সাহস, মনোবল ও শক্তি সঞ্চার করে এবং আন্দোলনকারী পার্টি হিসেবে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। এতদিন দুর্বল, ভীরু, হীনমন্য হয়ে থাকা জনগণ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বৃটিশ পণ্য বর্জনের ফলে ভারতীয় কারখানার মালিকরা ভালো মুনাফা আয় করেন। বৃটেন থেকে চিনি, লোহা ইত্যাদি পণ্যের আমদানি কমে যায়।
চৌরিচৌরা সহিংসতার প্রেক্ষিতে গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু তারপরও বৃটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার ও ৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়। একইভাবে কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদেরও গ্রেফতার করা হয়। গান্ধীজীর এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে মতিলাল নেহেরু ও চিত্ত রঞ্জন দাস কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন।
সমসাময়িক কালের ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের মতে, এই আন্দোলন বৃটিশ শাসনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে যথেষ্ট সফল হয়েছিল। এমনকি তা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের ভিত্তি তৈরি করেছিল। জওহরলাল নেহেরু লিখেছেন, ‘গণঅভ্যুত্থান ও প্রকৃত বিপ্লবী আন্দোলনের সব সময় দু’ ধরনের ফল দেখা যায়: একদিকে তা আম জনতাকে বা তাদের পক্ষের লোকজনকে সাহসী করে তোলে এবং তাদের ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটায়। অন্যদিকে একই সময় তা প্রতিপক্ষকে মনস্তাত্বিকভাবে দমন ও প্রতিহত করে।’
এ. আর. দেশাই লেখেন, ‘যে জাতীয় আন্দোলন ১৯১৭ সাল পর্যন্ত উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তা শ্রমিক ও কৃষকের অংশগ্রহণের কারণে প্রথমবারের মতো গণভিত্তি লাভ করে।’
উপসংহার
যারা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তারা ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন। গান্ধীজী ইয়াং ইন্ডিয়ায় লেখেন, ‘দুঃখ কষ্ট ভোগ করার ক্ষমতা যাঁর নেই তিনি অসহযোগ করতে অক্ষম। প্রয়োজন দেখা দিলে যিনি তাঁর সম্পত্তি এমনকি পরিবার পরিজনও ত্যাগ করতে শেখেননি তিনি কখনও অসহযোগ করতে পারেন না।’ এ ধরনের দৃঢ় মানসিকতা না থাকলে অসহযোগ আন্দোলন কখনও সফল হতে পারে না। কংগ্রেস নেতারা ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন বলে সাধারণ জনগণ তাদের উপর আস্থা রাখতে পেরেছিলেন এবং তারাও জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ও বহু ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করেছিলেন। আন্দোলনের নেতাদের এই ত্যাগ না থাকলে অসহযোগ আন্দোলন কখনই সফল হয় না। পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনার সময় এ দিকটি অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে।
সহায়ক গ্রন্থ ও ওয়েবসাইট:
১. মহাত্মা গান্ধীর নির্বাচিত রচনা, ভলিউম ৫, সত্যের আহ্বান, প্রথম সংস্করণ, জানুয়ারী ২০০০, নবজীবন পাবলিশিং হাউজ, আহমেদাবাদ।
- An Autobiography, Jawaharlal Nehru, Penguin Books India 2004.
- //en.wikipedia.org/wiki/Indian_National_Congress
- //knowindia.gov.in/knowindia/culture_heritage.php?id=6
- //www.importantindia.com/16194/causes-and-importance-of-non-cooperation-movement/
- //www.historydiscussion.net/articles/non-cooperation-movement-1920-22-undertaken-by-the-indian-national-congress/2093
- //en.wikipedia.org/wiki/Non-cooperation_movement
- //www.mkgandhi.org/biography/nnviolnt.htm
* ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসহযোগ আন্দোলন -১
—————————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।