মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার অধিকার হরণের প্রতিবাদে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সভা
ঢাকা: মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার অধিকার হরণের প্রতিবাদে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের এক সভা শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ৩য় তলার হলরুমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন বদরুদ্দীন উমর, কথাসাহিত্যিক শওকত আলী, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক আবরার চৌধুরী, প্রাবন্ধিক নূর মোহাম্মদ, অধ্যাপক আজফার হোসেন, ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সম্পাদক ডাঃ ফয়জুল হাকিম, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া, ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, প্রাবন্ধিক ফারুক ওয়াসিফ, ফিরোজ আহমেদ প্রমুখ।
সভার সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সংগঠিত হতে হবে, সংগঠন ব্যতিরেকে শুধু প্রতিবাদ সভা দিয়ে এই অধিকার পাওয়া ও রক্ষা করা যাবে না। তিনি বাংলা একাডেমির সমালোচনা করে বলেন, এবারের বই মেলায় তারা একবারের জন্যও নিহত লেখক ও প্রকাশকদের স্মরণ করেনি, কোন কালো ব্যাজ ধারণ, ১ মিনিটের নীরবতা পালন বা নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ কিছুই করেনি।
বদরুদ্দীন উমর বলেন, বাংলাদেশে এখন কবরের শান্তি বিরাজ করছে। কোর্ট, পুলিশ, আমলা এমনকি রাজনৈতিক দলগুলি পর্যন্ত সরকারের পায়ের তলায় আছে। তিনি বলেন, যারা ডেইলী স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিচার চাইছেন, জনগণ একই কারণে তাদেরও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে বিচার চাইতে পারেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষ প্রতিবাদের জন্য তৈরী হয়েছে, জনগণের জীবন এখন শুকনো পাতার মত- একটি স্ফুলিঙ্গ এখানে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। সেই ভয়ে ভীত হয়ে সরকার কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, এখন আমাদের রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হবে, ঘরের ভেতরের আলোচনায় কাজ হবে না।
কথাসাহিত্যিক শওকত আলী বলেন, মানুষ যতক্ষণ বেঁচে আছে ততক্ষণই সে নিজে বাঁচার চেষ্টা করে এবং অন্যকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে দেশে যারা ক্ষমতায় আছে তারা অন্যকে মেরে হলেও শুধু নিজে বাঁচার চেষ্টা করছে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার মানুষের মত প্রকাশের আতঙ্কে আছে। তিনি বলেন, মত প্রকাশকে দমন করা যায় কিন্তু মত ও চিন্তা তাতে উবে যায় না। অধ্যাপক আজফার হোসেন বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতাহীনতায় একটা স্ব-আরোপিত সেন্সরশীপ চলে আসে যা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। প্রাবন্ধিক নূর মোহাম্মদ জ্বালানী খাতে দায়মুক্তি আইনের সমালোচনা করে বলেন এর মাধ্যমেও কার্যত মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত করা হয়েছে।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রতিবাদ হচ্ছে বাছাই করে। কারুর জন্য প্রতিবাদ হচ্ছে, কারুর পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, চিন্তা ও বাক স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ হতো না। এই স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শিবিরে দাঁড়িয়েছে। ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান বলেন এখানে প্রতিবাদ হচ্ছে ব্যক্তিটি কে সেটা দেখে। তিনি বলেন, দুই বছর আগে যখন একটি পত্রিকার সম্পাদককে জেলে নেয়া হয় তখন সেভাবে কেউ প্রতিবাদ করেনি। তিনি বলেন মানবাধিকার এখানে শুধু বাছাই করা লোকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়েছে।
প্রসিত বিকাশ খীসা বলেন, সরকার জনগণের ওপর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধে সত্য নিহত হয়েছে, প্রান্তিক, দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হচ্ছে-এটা ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ১১ মাস জেলে থাকার কথা বলেছেন- কিন্তু তিনি তো দেশের মানুষকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ১১ দফা নির্দেশনা জারী করা হয়েছে সেটা তো দখলদার বাহিনীর নির্দেশনা। গত বছর সেখানে বৈসাবী-র র্যালী করতে দেয়া হয়নি, গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে।
ডাঃ ফয়জুল হাকিম বলেন, দেশে জাতীয় স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, এই অবস্থায় বাক স্বাধীনতা থাকার কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে যাতে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন, সীমান্তে হত্যা বা বিডিআর হত্যা কিছু নিয়েই কোন কথা বলা না যায়। তিনি বলেন, তাবেদার সরকারকে ক্ষমতায় রেখে মত প্রকাশ ও চিন্তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এখন সময় হয়েছে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনার জন্য সংগ্রাম করবার।
অধ্যাপক আবরার চৌধুরী বলেন, ১৯৭৩ সালে এই প্রেসক্লাবেই মৌলিক অধিকার রক্ষা কমিটি করতে হয়েছিল। সেই সংগ্রাম এখনো চালিয়ে যেত হচ্ছে।
ফারুক ওয়াসিফ বলেন, বাংলাদেশে নাস্তিক-আস্তিক নামে কৃত্রিম দ্বন্দ্ব ও বিভাজন তৈরী করে জনগণের জান-জবান ও স্বাধীনতার লড়াইকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। ফিরোজ আহমেদ বলেন, ১৯৭২ সাল থেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কাজ করেছে তখনকার সরকার। তিনি বলেন, সংবিধানের ৭০ ধারার মাধ্যমেও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারকে হরণ করা হয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার অধিকার হরণের প্রতিবাদে সভায় ৯ দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিপুল সংখ্যক প্রতিবাদী লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সভায় গৃহীত ৯ দফা প্রস্তাবাবলী নিম্নরূপ:
১। বাংলাদেশে একের পর এক লেখক ও প্রকাশককে হত্যা করা হলেও এখনো পর্যন্ত সরকারের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কোন একটি হত্যাকাণ্ডেরও কিনারা করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এ ধরনের হত্যাকা- ঠেকানোর জন্য কোনো কার্যকর তৎপরতাও তাদের নেই; যা থেকে মনে হয় সরকারের এ ব্যাপারে সদিচ্ছা নেই। বরং এসব হত্যাকা- থেকে কিভাবে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায় সে নিয়েই সরকার ব্যস্ত। সরকার এখন লেখকদের কোমরে দড়ি ও হাতে হাতকড়া পড়িয়ে জেলে ঢুকিয়ে ও রিমান্ডে নিয়ে মতপ্রকাশ স্বাধীনতা ও চিন্তার অধিকার কেড়ে নেয়ার পথ ধরেছে। এর মাধ্যমে লেখক, প্রকাশক ও ছাপাখানার মালিকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে সরকার লেখক-প্রকাশকের ওপর হামলাকারী ও হত্যাকারীদের কার্যত সহায়তা করছে ও উস্কানী প্রদান করছে।
এই পরিস্থিতিতে এই সভা দেশের বিবেকবান ব্যক্তিদের প্রতি স্বাধীনভাবে সংগঠিত হবার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং চিন্তার অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলার জোর আহ্বান জানাচ্ছে।
২। বর্তমানে দেশে এক বিচারহীন ও জবাবদিহিতা শূন্য পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যার কোন প্রকৃত তদন্ত না হওয়া, নারায়ণগঞ্জে কিশোর ত্বকী হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো তাদের রক্ষায় সর্বোচ্চ মহল থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা প্রদান; সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন, তাদের ভূসম্পত্তি দখল; শিশুদের বিভৎসভাবে নির্যাতন ও হত্যা; জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্বেও তা অস্বীকার, বরং প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলশী হামলা নির্যাতনজ্জএসবই প্রমাণ করছে সরকার কোনো ধরনের অপরাধেরই বিচার করতে এবং অপরাধীদের দমন করতে অনিচ্ছুক।
এই সভা মনে করে ন্যায়বিচার প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং স্বাধীনভাবে সংগঠিত হবার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং চিন্তার অধিকারের সাথে তা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
৩। বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠী ইতিহাসকে ভয় পায়। স্কুল-কলেজের পাঠ্য বিষয় হতে ইতিহাসকে কার্যত উঠিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ পরিচিত ইত্যাদি যুক্ত করে সেখানে শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যা রাজনৈতিক বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন করে সেখানে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে এমন কিছু বিষয় সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। এতেও নিরাপদ বোধ না করায় তারা এখন ইতিহাস নিয়ন্ত্রণে বিশেষ আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে।
এই সভা মনে করে ইতিহাসচর্চার পথ রুদ্ধ হলে তর্ক-বিতর্ক পাল্টা মতের কোনো অস্তিত্বই আর থাকবে না এবং মানুষের চিন্তার অধিকারও কার্যত হরণ করা হবে।
৪। সরকার কঠোর থেকে কঠোরতর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে, জনগণের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ওপর আক্রমণ চািলয়ে যাচ্ছে এবং বিরোধী রাজনৈতিক মতকে কঠোরভাবে দমন করছে। বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ওপর সরকার নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও নিয়ন্ত্রণমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে, এবং ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকার সামাজিক মাধ্যমগুলির ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং এর ব্যবহারকারীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের চেষ্টা করছে। মত প্রকাশের ওপর এই ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক তৎপরতা ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রকাশ। ফ্যাসিবাদের অর্থ শুধু শারিরীক নির্যাতন বা খুন নয়। এটা এমন এক ব্যবস্থা যা শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, প্রশাসন, তথ্য ও গণমাধ্যম থেকে নিয়ে নিরাপত্তা পর্যন্ত প্রত্যেক ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে।
এই সভা মনে করে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং চিন্তার অধিকার রক্ষায় ফ্যাসিবাদের সকল প্রকার প্রকাশের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে। এই সংগ্রামের অর্থ হলো, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, প্রশাসন, তথ্য ও গণমাধ্যম থেকে নিয়ে নিরাপত্তাজ্জপ্রত্যেক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করা।
৫। সংবিধানের কোন ধারার প্রতি জনগণের কোনো অংশের মধ্যে অনাস্থা থাকলে, সংবিধানের কোন ধারা জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করছে বা জনগণের কোন অংশকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করছে বলে কেউ মনে করলে এবং এসব বিষয়ে কথা বললে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদটিতে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ধারা বলে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের দাবি, সংবিধানের যে কোন সমালোচনা এমনকি সাংবিধানিক সংস্কারের দাবিও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করবার ক্ষমতা সরকার ও রাষ্ট্রকে প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে নাগরিকদের সংগঠন করার অধিকারও খর্ব করা হয়েছে। সংবিধানের সংশোধিত ৩৮ নং ধারায় যে কোন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত বিশেষতঃ বাম প্রগতিশীল দল ও সংগঠনসমূহের কার্যকলাপকে সরকার খেয়াল খুশিমত সংবিধানের পরিপন্থী ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করতে পারবে।
এই সভা মনে করে, সংবিধানের সমালোচনা করবার, সংবিধান সংস্কার বা নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের দাবি উত্থাপনের অধিকারকে প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। সভা মনে করে, নাগরিকগণের সংগঠন করার অখ- স্বাধীনতা ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র হতে পারে না। সভা মনে করে, সংবিধানের উপরোক্ত ধারাগুলি জনগণের সংগঠিত হবার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং চিন্তার অধিকার অবলোপন করে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের পথ প্রশস্ত করেছে।
৬। বাংলাদেশ বহু ভাষা-ভাষী, জাতি-সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বীর দেশ। প্রত্যেক ভাষা-ভাষী, জাতি ও ধর্মাবলম্বীর সমতা-মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর ভিত্তিতে সকল জাতি-জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বিকাশ সম্ভব হতে পারে। এই সভা মনে করে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মাবলম্বীর মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য ও বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতি প্রধানত দায়ী। সভা অবিলম্বে এই নীতি বাতিলের দাবি জানাচ্ছে।
৭। এই সভা সম্প্রতি সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নির্যাতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর মোল্লার মৃত্যু, এই ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ত উদাসীনতা এবং নির্যাতনকারীদের রক্ষা ও সহায়তা প্রদানের তীব্র নিন্দা জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও সংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করার ফলেই হাফিজুরের মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটতে পেরেছে। সভা তাই মনে করে যে, হাফিজুর মোল্লার মৃত্যু একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকা- এবং এর দায়-দায়িত্ব ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।
৮। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে যে ফ্যাসিস্ট নীতি কায়েম করতে চাইছে তার ফলে তীক্ষ্ম, গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনার অঙ্গন প্রায় নিষ্পত্র। এর ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে বর্তমান শাসকশ্রেণীর আত্মশুদ্ধি ঘটার সম্ভাবনা নেই; কঠোর সংগ্রামের ভিতর দিয়ে এর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এই সংগ্রামে রাষ্ট্রনেতার চেয়ে শিল্পরচয়িতার দায়িত্ব কোন অংশে কম নয়।
এই সভা মনে করে বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীদেরকে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ থেকে পরিত্রাণের পথ সকলের আগে দেখতে হবে এবং সকলকে দেখাতে হবে।
৯। সারা বিশ্বে কোথাও শান্তি নেই, সর্বত্রই অশান্তি ও হানা হানির পরিবেশ। যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি এখন সাম্রাজ্যবাদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি। কেননা যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত ব্যয় ছাড়া তাদের পুঁজিপতিদের মুনাফা এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বজায় রাখা এখন একেবারেই অসম্ভব, তাই প্রত্যেকটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের অর্থনীতিই যুদ্ধ অর্থনীতির সাথে অবিচ্ছেদ্য। সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, নিজেদের ঘণীভূত হতে থাকা অন্তর্নিহিত সঙ্কট থেকে উদ্ধার লাভের জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ জড়িয়ে দিচ্ছে; তার ফলেই বিশ্ব জুড়ে আজ আঞ্চলিক যুদ্ধ, আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, যুদ্ধ পরিবেশ, বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য অদৃষ্টপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ক্রমাগত আরও বৃদ্ধির পথে। এই পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল প্রত্যেকটি দেশই এ যাবৎকাল যেটুকু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিজেদের দেশে জারী রাখতে পেরেছিল সেটা আর তাদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের শাসন ব্যবস্থা লক্ষণীয়ভাবে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করছে। বাংলাদেশেও আমরা সেটাই দেখছি। তাই সারাবিশ্ব যেমন, তেমনি বাংলাদেশও আজ এক দুষ্কাল অতিক্রম করছে।
পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ আজ শুধু শ্রমিকের ও শ্রমজীবী জনগণেরই শত্রু নয়, তারা সমগ্র মানব জাতির শত্রু। এই উপলব্ধি আজ বিশ্বব্যাপী জনগণের মধ্যে বিস্তার লাভ করছে এবং বিশ্বব্যাপী ঐক্যের বাস্তবতা সৃষ্টি করছে। এই সভা এই আন্তর্জাতিক ঐক্যের অংশীদার হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করছে।
———————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।