মাটিরাঙ্গা প্রাণ কুমার পাড়ায় সেটলার হামলার প্রতিবাদে ও নিরাপত্তা বিধানের দাবিতে খাগড়াছড়ি প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে গ্রামবাসীরা

0
সিএইচটি নিউজ বাংলা, ৯ এপ্রিল ২০১৩, মঙ্গলবার
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার ৩নং বড়নাল ইউনিয়নের প্রাণ কুমার পাড়ায় সেটলার হামলার প্রতিবাদে ও নিরাপত্তা বিধানের দাবিতে আজ ৯ এপ্রিল মঙ্গলবার ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীরা খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে।
স্মারকলিপিতে তারা বলেন, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বড়নাল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত্ম প্রাণ কুমার পাড়ায় আমরা ২৭টি পরিবার বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছি। কিন্তু গত ২ ও ৫ এপ্রিল উপর্যুপরি সেটলার হামলার পর আমরা পরিবার পরিজনসহ গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছি এবং বর্তমানে আশ্রয়হীন অবস্থায় অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছি।
তারা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্মারকলিপিতে বলেন, গত ২ এপ্রিল সেটলাররা আমাদের পাড়ায় প্রথম হামলা চালায়। সেদিন রাত আনুমানিক ২টার সময় ৪০/৫০ জন সেটলার দুর্জয় ত্রিপুরার বাড়ি ঘেরাও করে ইউপিডিএফ সদস্যদের দেখেছো কিনা জিজ্ঞাসা করে। সে দেখেনি বলে উত্তর দিলে সেটলাররা তাকে মারধর করে। এ সময় হামলাকারীরা পল্টনজয় ত্রিপুরার (৪২) বাড়ির দরজাও ভেঙে দেয়। হামলার সময় সেটলারদের পিছনে বিজিবি’র পোশাক পরা লোকজন ছিল।
এই হামলার পর গত ৫ এপ্রিল সেটলাররা কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই দ্বিতীয় বারের মতো আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। সেদিন রাত আনুমানিক ১:৩০টার সময় আমতলী ও বড়নাল ইউনিয়নের চৌদ্দগ্রাম পাড়া, শরমাষ্টার পাড়া, জাফর পাড়া, করিম মাষ্টার পাড়া থেকে ২/৩ হাজার সেটলার চারদিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এরপর সেটলাররা পরিকল্পিতভাবে একজন বাঙালির বাড়ির টিনের চালের উপর কিছু ঢিল ছুঁড়ে মারে এবং পটকাবাজি ফুটিয়ে সন্ত্রাসী এসেছে বলে চিকার দিয়ে ধন কুমার ত্রিপুরা (৩৭) পিতা-জবিন্দ্র ত্রিপুরার বাড়িতে হামলা চালায় এবং তাকে বেদম মারধর করে। সেটলারদের হামলায় তিনি মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তার বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও ভাইয়েরা রক্ষা করতে ছুঁটে আসলে সেটলাররা তাদেরকেও বেদম মারধর করে। সেটলাররা তার বাড়ি, দোকান, টেলিভিশন ও সাইকেলসহ সকল জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে দেয় এবং দোকানের মালামাল ও মোবাইল লুট করে নিয়ে যায়।
সেটলারদের কর্তৃক মারধরের কথা উলেস্নখ করে তারা বলেন, সেদিন যারা সেটলারদের কর্তৃক মারধরের শিকার হয়েছেন তারা হলেন দুর্জয় ত্রিপুরা (২২), কান্তারাই ত্রিপুরা (৩০), চান্দে রাই ত্রিপুরা (২২), কাম্ভারাই ত্রিপুরা (২০), তপন বিকাশ ত্রিপুরা (২৫), জ্যোতিরায় ত্রিপুরা (২১), বোবা রাই ত্রিপুরা (১৮) কিশোর রাই ত্রিপুরা (২৮), শোভা রঞ্জন ত্রিপুরা (২৪), তৈমালা ত্রিপুরা, জয় ত্রিপুরা(২২)। এর মধ্যে তপন বিকাশ ত্রিপুরা পায়ে ও কানে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। তিনি এখন কানে শুনতে পাচ্ছেন না।
সেটলারদের হামলার ভয়ে ঘরছাড়া হওয়ার কারণে জাবারাং কল্যাণ সমিতি কর্র্তৃক নির্মিত প্রাণকুমার কার্বারী পাড়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ফলে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া এ এলাকার এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সেটলারদের হামলার ভয়ে পরীক্ষা দিতে পারছে না বলে তারা স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন।
স্মারকলিপিতে তারা বলেন, হামলাকারী সেটলারদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জড়িত রয়েছেন এবং বড়নাল ও আমতলি ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন মেম্বার এই হামলায় নেতৃত্ব দেয়। এ হামলার পর গত ৭ এপ্রিল বিজিবি সদস্যদের সামনে এক সেটলার বাঙালি (বিএনপির সাথে জড়িত) হুমকি দেয় যে, এলাকা ছেড়ে চলে না গেলে সবাইকে জবাই করা হবে। ফলে আমরা এখন খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। গ্রামে ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।
ঘরবাড়ি ছেড়ে ২৭টি পরিবার পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছেন উল্লেখ করে তারা স্মারকলিপিতে বলেন, হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ও বর্তমানে আমরা যেসব পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছি: ১. ধন কুমার ত্রিপুরা, ২. পল্টনজয় ত্রিপুরা, ৩. তোকলাই মনি ত্রিপুরা, ৪. রত্নাদেবী ত্রিপুরা (বিধবা মহিলা), ৫. জবিন্দ্র ত্রিপুরা, ৬. তৈমালা ত্রিপুরা, ৭. চাক্কেলা ত্রিপুরা, ৮. কান্ত্মা রায় ত্রিপুরা, ৯. শোভা রঞ্জন ত্রিপুরা, ১০. লতাবি ত্রিপুরা, ১১. চান্দে রায় ত্রিপুরা, ১২. দুর্জয় ত্রিপুরা, ১৩. জ্যোতিরায় ত্রিপুরা, ১৪. বিনন্ত ত্রিপুরা, ১৫. একআনা ত্রিপুরা, ১৬. দুইআনা ত্রিপুরা (গ্রামের কার্বারী), ১৭. তপন বিকাশ ত্রিপুরা, ১৮. রতন ভূষণ ত্রিপুরা, ১৯. কাম্ভারায় ত্রিপুরা, ২০. কিশোর রায় ত্রিপুরা, ২১. ধন মোহন ত্রিপুরা, ২২. বারন কুমার ত্রিপুরা, ২৩. শিয়ালছা ত্রিপুরা, ২৪. জীবন কুমার ত্রিপুরা, ২৫. জহরলাল ত্রিপুরা, ২৬. ভগ্ন কুমার ত্রিপুরা ও ২৭. সিদ্ধিজয় ত্রিপুরা।
স্মারকলিপিতে তারা বলেন, আগামী ১২ এপ্রিল থেকে আমাদের বৃহ সামাজিক উসব বৈসাবি শুরু হতে যাচ্ছে। প্রতি বছরই এভাবে আমদের এই আনন্দঘন মুহুর্তে সেটলাররা সম্পূর্ণ মিথ্যা অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ধরনের দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধিয়ে থাকে। এই উসবকে বানচাল করে দিতে ও আমাদের জায়গা জমি বেদখল করার উদ্দেশ্যে সেটলাররা এ হামলা চালিয়েছে বলে আমরা মনে করি।
স্মারকলিপিতে তারা চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হচ্ছে: ১. আমরা যাতে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারি তার জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করতে হবে, ২. অবিলম্বে হামলাকারী সেটলার ও তাদের সহযোগীদের গ্রেফতার ও যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে, ৩. ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ ও যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের যথাযথ চিকিসার ব্যবস্থা করতে হবে ও ৪. ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তার জন্য প্রয়োজনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
স্মারকলিপিতে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন- ধন কুমার ত্রিপুরা, পল্টনজয় ত্রিপুরা, কান্তারাই ত্রিপুরা, শুভারঞ্জন ত্রিপুরা, দুর্জয় ত্রিপুরা, তপন বিকাশ ত্রিপুরা, কিশোরা রাই ত্রিপুরা ও চান্দেরাই ত্রিপুরা প্রমুখ।  স্মারকলিপি দেয়ার সময় আমতলি ইউনিয়নের মেম্বার জলক্ক ভূষণ ত্রিপুরাও উপস্থিত ছিলেন।
——

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More