লিখেছেন- ইমতিয়াজ মাহমুদ
[ইমতিয়াজ মাহমুদ-এর ফেসবুক স্ট্যাটাসটি এখানে প্রকাশ করা হলো–সম্পাদক মণ্ডলী]
(১)
হুমায়ূন আজাদ স্যার তখনো আহত হননি। বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায়। অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে বিনাবিচারে মানুষ মারার অভিযানটা শুরু হয়েছে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা একেকজনকে গ্রেফতার করে, গ্রেফতার করে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে, পুলিশ তাকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যায়, হাসপাতালে লোকটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পুলিশ থেকে প্রেসকে জানানো হয় যে পুলিশি হেফাজতে লোকটির হার্ট এটাক হয়েছিল তাতেই নাকি সে মারা গেছে। সাথে জানানো হয় মৃত লোকটির নামে কয়টি মামলা ছিল, কয়টি জিডিতে ওর নাম ছিল ইত্যাদি। এই একই গল্প সবকয়টা হত্যার জন্য।
হুমায়ূন আজাদ শাহবাগে আসেন, টিভোলির সামনে বসে সন্ধ্যার দিকে এক কাপ দুই কাপ চা খান, কয়েকটা সিগারেট খান। সেসময় কিছু তরুণ তাঁকে ঘিরে বসে নানারকম আলাপ আলোচনা করেন। এই অধম সেখানে কয়েকবার গেছে। আমার বন্ধু আবদুল্লাহ চৌধুরী সেখানে প্রায় নিয়মিতই গিয়ে আড্ডা দিতো। হুমায়ূন আজাদ যে এইরকম বিনা বিচারে মানুষ মারাকে সমর্থন করতেন না সেটা বলা তো বাহুল্যই আরকি।
সেখানে যারা আসতেন ওদের অনেকেই অপারেশন ক্লিন হার্ট সমর্থন করতেন। ওরা স্যারের সামনে বসে এটা জাস্টিফাই করার চেষ্টা করতো- যে লোকগুলিকে মারা হচ্ছে এরা কতো খারাপ, ভয়ংকর সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, এদের বিচার করা সম্ভব না, এদেরকে মারা অন্যায় না ইত্যাদি। দেশে এইরকম লোক অনেকেই ছিল যারা এটা সমর্থন করতেন, ওদের সকলের বক্তব্য মোটামুটি একইরকম, যে ঠিকই আছে এইসব সন্ত্রাসীকে মেরে ফেলাই ঠিক আছে।
সরকারের বানানো যে গল্পটি বললাম আগে, সেই গল্পটি কেউই বিশ্বাস করতো না। হুমায়ূন আজাদ স্যার তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলতেন, এই লোকগুলি এতো মূর্খ যে এরা ঠিকমত একটা গল্পও বানাতে জানে না।
(২)
এরা আসলেই ঠিকমত একটা গল্পও বানাতে জানেনা। রমেলকে হত্যা করে ওর লাশটা পুড়িয়ে দিয়েছে। এটা যে অন্যায়, এটা যে একটা অপরাধ সেই কথা তো আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু সেটেলাররা ও ওদের রক্ষক প্রতিপালক বন্ধুরা সেটা এমনিই মানবে কেন? ওরা এখন গল্প বানাচ্ছে। গল্প বানাচ্ছে দুইরকম। একটা গল্পও হচ্ছে যে রমেল একটা বিরাট গুণ্ডা সন্ত্রাসী ছিল, ওকে গ্রেফতার করার সময় বেবিট্যাক্সির ধাক্কায় সে মরে গেছে। রমেলের মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা আর রমেল ঠিক নির্দোষ কিশোর ছিল না। আরেকটা গল্প ওরা ছড়াচ্ছে যারা রমেলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনলাইনে অফলাইনে প্রতিবাদ করেছেন ওদের স্ক্যান্ডালাইজ করে।
রমেলের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে যে গল্পটি যারা বানিয়েছে এরা আবার ব্যাপারটাকে খানিকটা হিন্দি সিনেমার মোট বানানোর চেষ্টা করেছে। আর্মির তাড়া খেয়ে রমেল নাকি পাহাড়ে উঠে পড়েছিল, পাহাড় থেকে গড়িয়ে সে রাস্তায় বেবিট্যাক্সির সামনে এসে পড়ে, আর তাতেই এমন আহত হয় যে সেই আঘাতে তার শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়। গল্পের সমাপ্তিটা বেশ মানবিক। রমেলের শেষকৃত্য নাকি হয়েছে যথাযথ নিয়মে ওর আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে। আত্মীয় স্বজনরা কারা? পুলিস আর কিছু বাঙালী নাম, সাথে একটা মাত্র চাকমা নাম- তিনি নাকি রমেলের মামা। ব্যাস।
এই গল্প আবার দয়চে ভ্যালে রেডিও বা স্থানীয় পুলিশ বা জেলা পুলিশের বক্তব্যের সাথে মিলে না।
আর যারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন ওদের সম্পর্কে গালাগালি তো চলছেই। সেটেলার আর উগ্র ধার্মিক আর দক্ষিনপন্থি রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সাথে এইসব গালাগালিতে রাঙ্গামাটির বেশ কিছু আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীও যুক্ত হয়েছেন। এইসব গালিবাজদের বক্তব্য কি? আসলে এদের কোন বক্তব্য নাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ওদের কথা জানতে পারবেন। কিছু সংখ্যক লোক আমাকে ইনবক্সেও গালাগালির সাথে নানান কথা জানিয়েছে।
(৩)
এদের কথা হচ্ছে, আমর নাকি ঢাকায় বসে আদিবাসীদের দালালী করছি, আমরা প্রকৃত সত্য জানিনা, রমেল চাকমা এক বিরাট সন্ত্রাসী দলের বিরাট এক কমান্ডার, বড় বড় সব রাফেল কামান বন্দুক ছিল ওর কাছে, সেইসব অস্ত্র হাতে সে নাকি বেশ পোজ দিয়ে ফটোও তুলেছে। আমরা এইসব কিছুই না জেনে খালি খালি লাফাচ্ছি। আমরা যেন কয়েকদিন রাঙ্গামাটি গিয়ে থাকি।
একদল আবার ক্যারেক্টার এসাসিনেশনে নেমেছে। সেই কাজটাও গাধাগুলি ঠিকমত করতে পারছে না।
ওরা কয়েকটা ফেইক ফেসবুক প্রোফাইল খুলেছে আদিবাসী মেয়েদের নাম আর ছবি দিয়ে। সেরকম একটাতে বেশ কায়দা করে প্রচার করছে যে জনৈক ইমতিয়াজ মাহমুদ নাকি নগদ চল্লিশ লক্ষ টাকা নিয়ে সেনাবাহিনী ও বাঙালীর ভাবমূর্তি ধ্বংসের জন্যে এক অশুভ মিশনে নেমেছে। এই চল্লিশ লক্ষ টাকা থেকে নাকি বেশ কিছু বাম ছাত্রনেতা, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদকেও দেওয়া হয়েছে। এইরকম একটা পোস্টে দেখালাম কায়দা করে আমার একটা ফটোও জুড়ে দিয়েছে। নিজের ঢোল নিজেই পিটাই, সেই ছবিটাতে আবার আমাকে দেখতেও বেশ ভালো লাগছে।
শুভানুধ্যায়ী তরুণরা এইসব আমার আমাকে ইনবক্সে জানাচ্ছেন। দেখেন আপনার নামে কিসব ছড়াচ্ছে ওরা। দেখে আমি একটু আতঙ্কিত হলাম। না, ওদের ভয়ে না বা কলঙ্কের ভয়ে না। এখন যদি কোন বাম ছাত্র নেতা বা সাংবাদিক বা রাজনৈতিক নেতা এসে যদি আমাকে বলেন, যে, ভাই আমার ভাগের টাকাটা গেল কই? ওদেরকে জবাব দেওয়া তো কঠিন হয়ে যাবে আরকি। নগদ চল্লিশ লাখ পেলে অবশ্য খারাপ হতো না। ক্যাননের নতুন মার্ক ফোরটা কিনতে পারতাম, সাথে এক সারি লেন্স।
বন্ধুদেরকে বলি, এইসব দেখে বিরক্ত হবেন না বা রাগ করবেন না। ঐ সেটেলারগুলির আর করার কি আছে। পাহাড়ে ওদের থাকাটাই তো অবৈধ। সেনাবাহিনীর আশ্রয় আর সরকারের রেশন ছাড়া ওরা ওখানে থাকতে পারতো? ওদের না আছে নৈতিক মনোবল না আছে ওদের পক্ষে কোন গ্রহণযোগ্য যুক্তি। এরা তো এইসব করবেই।
(৪)
এইসবই করবে ওরা। মিথ্যাচার করবে। উদ্ভট যব যুক্তি তুলবে। গালি দিবে। ভয় দেখাবে। আর আপনার নামে স্ক্যান্ডাল ছড়াতে চেষ্টা করবে। এছাড়া ওদের করার কি আছে।
মিথ্যাচার কবে কারণ সত্য ওদের পক্ষে নেই। সত্য হচ্ছে যে ওরা অবৈধ সেটেলার। জিয়াউর রহমান ওদেরকে নিয়ে উদ্দেশ্যমুলকভাবে পাহাড়ে ঢুকিয়েছে যাতে করে পাহাড়ের ডেমগ্রাফিক প্যাটার্ন পাল্টে দিতে পারে। এটা অন্যায়। এটা অবৈধ। এমনিতে মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে বসবার করে সেটা এক কথা। কিন্তু রাষ্ট্র যখন একটি এলাকায়, যেখানে লোকজনের একটু স্বতন্ত্র নৃতাত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে, সেখানে ওদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে বাইরে থেকে লোক ঢুকাতে থাকে- এটা অন্যায়। এই সত্যটা ওরা জানে। ওরা জানে যে ওরা সেখানে অন্যায়ভাবে আছে।
উদ্ভট যুক্তি দেখাবে কারণ ওদের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত কোন কথা নাই। এই যে রমেলের কথাটাই দেখেন। একজন মানুষ, একটা ছোট ছেলে, সে যতবড় অপরাধীই হোক, তাকে তো বিনাবিচারে হত্যা করা অন্যায়। এটা আইনের চোখে একটি খুন। অপরাধ। রমেল সন্ত্রাসী ছিল, চাঁদাবাজ ছিল এইগুলি কোন কথা হলো? আরে তোরা যদি জানিসই যে সে অপরাধী ছিল তাইলে বিচার করে ওর জেল দিতি, ফাঁসি দিতি- বিনা বিচারে মারলি কেন?
আর আপনি যখন এগুলি কথা বলবেন, আপনাকে গালি দিবে সেটেলাররা। কেন? কেননা ওদের পক্ষে সত্যও নাই, যুক্তিও নাই। ওদের একমাত্র ভরসা হচ্ছে গালি দেওয়া আর ভয় দেখানো। দালাল বলবে, খারাপ গালি দিবে। খারাপ গালি তো ওরাই দিবে- কারণ ওদের সাংস্কৃতিক মান তো আপনার মত ভালো না যে বাপ মা তুলে গালি দিতে ওদের বাধবে। গালি তো ওরাই দিবে।
আর ভয় দেখাবে। কেননা সেটাই ওদের শক্তি। আমাকে ভয় দেখাবে আপনাকে ভয় দেখাবে। আমাকে মাঝে মাঝেই লেখে, গালি দেয়, বলে আয় রাঙ্গামাটি, দেখে নেব। আমি কখনো কখনো জবাবও দিই- ভাই, আসল নাম ঠিকানা জানান, রাঙ্গামাটি গিয়ে নাহয় আপনার বাড়ীতেই উঠবো, কি দেখতে চান দেখিয়ে দিব। এতো যখন দেখে নেয়ার শখ, কি আর করা।
(৫)
না, আমি হাসি ঠাট্টা করছি বটে। কিন্তু পাহাড়ে যারা আছেন, যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, সাবধানে থাকবেন। এরা তো যখন তখন যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নেয়। আজকে রমেলকে মেরেছে, এরকম ঘটনা তো এবারই যে প্রথম ঘটলো তা তো নয়। সাবধান থাকবেন।
সমতলের বন্ধুরা, আপনারা যারা সেইভাবে পাহাড়ে কখনো থাকেননি আপনারা বুঝতে পারবেন না আদিবাসীরা সেখানে কি অবস্থার মধ্যে বসবাস করে। নিজের বাসভূমিতে ওরা বাস করে সর্বদা ভয় আতঙ্ক আর অপমানের মধ্যে। প্রশাসন বলেন, আর্মি বলেন কেউই আদিবাসীদের প্রাপ্য মর্যাদাটা দেয় না। সেটেলাররাও এমন আচরণ করে যেন ওরাই পাহাড়ের মালিক আর আদিবাসীরা জংলী অসভ্য। আর্মি পুলিশ সেটেলারদেরকে প্রশ্রয় দেয়। আর আদিবাসীরা বাস করে এইসব অপমান সহ্য করে।
আপনি ভাবেন তো! আপনার বাড়ীতেই বাইরের লোক এসে আপনাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে, আপনার জায়গা জমি দখল করে নিবে, আপনার মেয়েদেরকে অত্যাচার করবে, আপনাকে বলবে অসভ্য জংলী, আপনার কেমন লাগবে?
এইটাই ইস্যু। এটা দালালীর ব্যাপার না বা পক্ষপাতিত্বের ব্যাপার না। এটা মানুষ হিসাবে মানুষের মর্যাদার প্রশ্নে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপার। আদিবাসীরা তো মানুষ নাকি? ওদের প্রতি অন্যায় হবে, আমি একজন মানুষ হয়ে যদি মানুষের পক্ষে শুধু মুখের কথাটা বলে একটা প্রতিবাদও না করি তাইলে আমি কিসের মানুষ? আমার সন্তানকে আমি কি বলে মুখ দেখাবো?
আগামীকাল যখন আমি আমার সন্তানদের বলবো সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে, তখন ওরা যদি আমাকে প্রশ্ন করে আমার পাহাড়ের মানুষের প্রতি যখন অন্যায় হয়েছে তখন আমি কি করেছি, আমি কি জবাব দিব?
_________
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।