মতামত
মৃত্যুঞ্জয়ী বীর শহীদ মিটন ছাত্র-যুবসমাজের অগ্রপথিক
সত্যদর্শী
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও রাজপথে প্রতিবাদী ছাত্রদের প্রিয় শ্লোগানের একটি হচ্ছে, ‘ভয় করি না বুলেট-বোমা, আমরা সবাই জুম্মো/মুক্তি সেনা’! এ ‘সাহসী ধ্বনি’ ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন এবং বিশেষ করে ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর পর পর দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটিতে সেনা-সেটলার হামলায় খুন-লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও নাড়া দিয়েছে। তাদের দৃপ্ত পদচারণায় ও প্রতিবাদী আওয়াজে রাজপথ মুখর হয়েছে।

পানছড়িতে এক সমাবেশে বক্তব্যদানরত মিটন চাকমা। ফাইল ছবি
একটু গভীরভাবে লক্ষ করা দেখা যায়, অতীতে কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে ‘এ সাহসী ধ্বনিকে’ বাঁধা বুলি হিসেবে মুখস্ত আওড়িয়েছে। বাস্তবে বুলেট-বোমা তো দূরের কথা, জেল-জুলুমের ভয়ে অনেকে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে, এমনকী চোখ রাঙানি হুমকি ধমকে কুঁকড়ে গিয়ে বিচ্যুত হয়, নানা পিছুটান আর ধান্দায় আন্দোলন পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ও অন্যত্রও আন্দোলন সংগ্রামে এ ধরনের নজীর কম নয়। ইউপিডিএফ গঠন পর্বে ‘বোমা মারলেও পূর্ণস্বায়ত্তশাসন ছাড়বো না!’ এমন উচ্চ রব তোলার পরও আন্দোলন সংগঠন ছেড়ে পালাতে দেখা গেছে।
এ ধরনের তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিতদের উদ্দেশ্যে এক মহান বিপ্লবী নেতা যথার্থই বলেছেন, ‘….কিছু সংখ্যক লোক ভয়ঙ্কর অহঙ্কারি এবং কয়েকটি কেতাবী বুলিতে শিক্ষিত হয়ে নিজেদের সবজান্তা মনে করেন, লেজ ফুলিয়ে আকাশে তুলে ধরেন, কিন্তু ঝড় ওঠা মাত্রই তাদের অবস্থান শ্রমিক ও অধিকাংশ কৃষকের চেয়ে ভিন্ন হয়ে যায়।’
বাস্তব জীবনেও আমরা এর সত্যতা দেখতে পাই। এ ধরনের তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিতরা মুখে যত কথাই বলুক, নিজেদের প্রতিবাদী দেশপ্রেমিক হিসেবে জাহির করতে ‘গর্বিত বেড়ালের মত লেজ ফুলিয়ে আকাশে তুলে ধরুক’, কাজের ক্ষেত্রে সামান্য বাধার সম্মুখীন হলে এরা চুপসে যায়, নানা উছিলায় যুক্তি খাড়া করে পালানোর রাস্তা খুঁজতে থাকে। আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হয়ে তাদের অবস্থান একেবারে সাধারণ শ্রমিক কৃষকের চাইতেও নিচে নেমে যায়।

মিটন চাকমা। ফাইল ছবি
তাদের বিপরীতে শহীদ মিটন এমনই একজন উচ্চ শিক্ষিত যুবক, যার ছিল না আত্মস্বার্থ চিন্তা, ছিল না পিছু টান কিংবা কোন ধরনের ভনিতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা রাজপথে উচ্চারিত শ্লোগানকে সে কেবল ‘কথার কথা’ হিসেবে নয়, বাস্তব জীবনেও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতো। এজন্য ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব নিতেও পিছ পা হয়নি। জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে জীবনের মহান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে সে তার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। শাসকচক্রের লেলিয়ে দেয়া গণশত্রুদের বাড়াবাড়িকে সে বরদাস্ত করতে পারেনি। পানছড়িতে সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত থাকাকালে দুর্বৃত্তদের সশস্ত্র হামলায় ১০ নভেম্বর ২০২৪ একজন প্রকৃত বিপ্লবীর মতো বীরত্বের সাথে আত্মবলিদান দিয়েছে।
পিসিপি’র বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রধান দায়িত্বে থাকার সুবাদে অন্য অনেকের মতো শহীদ মিটনেরও নানা উছিলায় শহরে পড়ে থাকার সুযোগ ছিল। অনেকে যেমন অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ততা দেখায়! ফেইসবুক, মেসেঞ্জার, সোশাল মিডিয়ায়… মশগুল হয়ে “আত্মউন্নয়নের” নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। সাংগঠনিক কাজে পারতপক্ষে এ ধরনের কর্মীরা মাঠে যেতে চায় না, কখনও গেলে তড়িঘড়ি করে ফিরে আসে।
লক্ষ্যণীয় যে, শহীদ মিটন ছিল তাদের থেকে আলাদা, ভিন্ন ধাতুতে গড়া এক যুবক। ছাত্রত্ব শেষ করে বেশিদিন সে শহরে পড়ে থাকেনি। আন্দোলন ও সংগঠন এগিয়ে নিতে পার্টির আহ্বানে মাঠে নেমে পড়ে এবং স্বেচ্ছায় কাঁধে নেয় চ্যালেঞ্জিং কাজ। তার সামনে ছিল শত শহীদের রক্তস্নাত পথ! দুরন্ত সাহস নিয়েই সে পথেই এগিয়েছে, ‘বুলেট-বোমা’ কোন কিছু তোয়াক্কা করেনি! শত্রুর মোকাবিলা করে নিজেকে একজন সাহসী মহান বীরের সারিতে স্থাপন করেছে! মৃত্যুর পূর্বে তার শেষ বাক্য ছিল ‘আমি আর বাঁচব না, তোমরা লড়াই চালিয়ে নাও!’ স্বার্থ চিন্তা ও মৃত্যভয় জয়-করা বীর শহীদ মিটন দেশপ্রেমিক ছাত্র-যুবসমাজের সম্মুখে একজন আদর্শস্থানীয় অগ্রপথিক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।#
(১৭ নভেম্বর ২০২৪)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।